বই-খাতাপত্রে ২৭০০ ফুটের কিছু বেশী উঁচু বিজয় শৃঙ্গ বা তাজিন ডং-কে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া বা সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হিসেবে উল্লেখ করা হলেও যারা বান্দরবানের গহীনে বিভিন্ন অভিযানে ছিলেন তাদের প্রায় সবারই জানা যে, জিপিএস এবং গুগল আর্থের রীডিং অনুযায়ী তাজিন ডং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া তো নয়ই বরং সর্বোচ্চ চূড়ার তালিকায় তাজিন ডং এর অবস্থান অষ্টাদশ, উনবিংশ কিংবা তারও পরের কিছু। তারও আগে সরকারীভাবে প্রায় ৩২৩৪ ফুট উচু কেওক্রাডং পাহাড়কে সর্বোচ্চ চূড়া হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও, পরে কোন এক অজানা কারণে তাজিন ডং-কে সর্বোচ্চ চূড়ার ভূষনে ভূষিত করা হয়েছিল যা, একই সাথে তর্কসাপেক্ষ, হাস্যকর এবং বিস্ময়সুচকও বটে। এতসব যুক্তিতর্কের পর স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, কোনটি আসলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিন্দু!!!
বান্দরবানের গহীনে বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তের মদক রেঞ্জে অবস্থিত সাকা হাফং, মদক তং, ক্লাংময়, ত্লাংময়, বর্ডার হুম ইত্যাদি নানা নামে ডাকা, এস,আর, টি, এম (শাটল র্যাডার টপোগ্রাফি মিশন), 1:200,000 সোভিয়েত মিলিটারি টপোগ্রাফিক ম্যাপ, 1:250,000 ইউ,এস আর্মি টপোগ্রাফিক ম্যাপ এবং বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অভিযানের জিপিএস রীডিং অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ট থেকে কমবেশী ৩৪৮৭ ফুট উচু, অটল-অতিকায় দানবের মত দাঁড়িয়ে থাকা এই পাহাড়টাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিন্দু হিসেবে অভিযান প্রিয় সহস্র মানুষের কাছে সবসময় তার প্রাপ্য সম্মান এবং স্বীকৃতি পেয়ে আসলেও জাতীয় স্বীকৃতির মুকুটটা এখনও শোভা পায়নি এই সুবিশাল পাহাড়ের কপালে। আর তাই আমরা যারা পাহাড়কেই ধ্যান-জ্ঞান মনে করে পথ চলি তাদের বিশ্বাস একদিন হয়ত জাতীয়ভাবেও সর্বোচ্চ চূড়ার স্বীকৃতি মিলবে আমাদের দেশের সীমানা প্রাচীরের ভূমিকায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশাল পাহাড়ের।
এবার আসি অন্য কথায়। সীমান্তের বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতি, কষ্টসাধ্য পথ, জোঁক, সাপ, ভালুক ইত্যাদি বন্যপ্রাণীর আক্রমনের আশংকা সব কিছুকে উপেক্ষা করেও প্রতি বছর অসংখ্য অভিযানপ্রিয় মানুষ ছুটে যান এই স্বপ্নচূড়া জয়ের স্বপ্ন গায়ে মেখে। সফলতা-ব্যার্থতা, দুঃখ-আনন্দ, ক্লান্তি-শ্রান্তি সব মিলিয়ে সাকা হাফং যেন পবিত্র কোন তীর্থ যাত্রা। এ যাত্রার পূর্ব প্রস্তুতির হ্যাপাও নিতান্ত কম নয়। কিভাবে যাবো, কি কি সাথে নিবো, কোথায় থাকবো, খাবো কি এমন হাজারো প্রশ্নোত্তরের ঝামেলা শেষ না করে বেরুনো কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত নয় আর তাই অভিজ্ঞ কিংবা আগে সামিট করে এসেছেন এমন মানুষজনদের মতামত নেয়াও জরুরী হয়ে পড়ে ভীষণ রকম।
আর তাই যারা এই মুহুর্তে ঐ পূর্ব প্রস্তুতি পর্বে আছেন কিংবা যাদের আর তর সইছেনা এই তীর্থ যাত্রায় শামিল হওয়ার ঠিক তাদের জন্যই আমাদের লেখাটার এই বাকী অংশটুকু।
প্রথমেই আসি কিভাবে যাবো প্রসঙ্গে। সাকা হাফং বা মদক তং যাওয়ার সবচেয়ে পরিচিত এবং সুন্দর রুটগুলোর একটি হচ্ছে থানছি থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তিন্দু, বড় পাথর হয়ে রেমাক্রি বাজার। রেমাক্রি পৌঁছে নৌকাটা ছেড়ে দেয়ার পর থেকেই শুরু মূল অভিযানের। রেমাক্রি থেকে নাফাকুম, জিনা পাড়া, আমিয়াকুম, সাতভাই কুম, হাজরাই পাড়া, নেফিউ পাড়া হয়ে সাকা হাফং-এর চূড়ায় পৌঁছান যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হলেও দম বন্ধ করা সুন্দরের ছড়াছড়ির জন্য এই পথটাই আমার কাছে সাকা-হাফং অভিযানের জন্য সবচেয়ে আদর্শ বলেই মনে হয়। যদিও যে কেউ চাইলে নাফাকুম থেকে দুলাপাড়া হয়ে সাজাই পাড়ার পথ ধরে নেফিউ পাড়া থেকেও সামিট করে আসতে পারেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া। আবার যাদের কাছে মনে হবে রেমাক্রি যাওয়ার নৌকা ভাড়াটা তো বেশী রকমের বেশী বেশী!!! তাদের চিন্তার কোন কারণ নেই, কারণ তাদের জন্যেও পথের দিশা খুলে রেখেছে বান্দরবানের নীলচে সবুজ পাহাড়েরা। থানছি থেকে পাহাড়ি পথে বোর্ডিং পাড়া ঘুরে কাইতন পাড়া ঝিরির পথ ধরে সিম্পত্লাম্পি পাড়া ছাড়িয়ে হাজরাই পাড়া এরপর নেফিউ পাড়া হয়েও সামিট করে আসতে পারেন যে কেউ। এই একই রুটে বোর্ডিং পাড়া থেকে শেরকর পাড়া হয়ে তাজিন ডং টাও সামিট করে আসা যায় অনায়াসে তারপর তাজিন ডং থেকে নেমে সিম্পত্লাম্পি পাড়ার পথ ধরে আবারো এগিয়ে যেতে পারেন স্বপ্নচূড়ার পথে।
থানছি ছাড়া রুমা বাজার থেকেও মদক তং সামিটের জন্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রুট। রুমা বাজার থেকে বগালেক, কেওক্রাডং, পাসিং পাড়া, থাইখ্যিয়াং পাড়া, দুলাচরণ পাড়া, হাজরাই পাড়া হয়ে নেফিউ পাড়া থেকে যেমন সাকা হাফং জয় করা যায় তেমনি আবার বগালেক, কেওক্রাডং, বাক্তলাই পাড়া হয়ে সিম্পত্লাম্পি পাড়া থেকেও সামিট রুট ধরা যায় খুব সহজেই। আবার বগালেক, কেওক্রাডং, পাসিং পাড়া, থাইখ্যিয়াং পাড়া, তাম্ল পাড়া হয়ে হাজরাই পাড়া হয়ে সামিট রুট ধরলেও কোন ক্ষতি নেই।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিন্দুটা ছুঁয়ে আসা বেশ কষ্টসাধ্য অভিযানের হলেও অসংখ্য পাহাড়ি পথের যেকোন একটা ধরে নেফিউ পাড়া বা সাকা হাফং -এর বেস ক্যাম্পে পৌঁছানটা খুবই সম্ভব আর নেফিউ পাড়া থেকে স্বপ্নচূড়া তো শ্রেফ সময়ের অপেক্ষা । তবে যে পথ ধরেই যান না কেন সাকা হাফং অভিযানে কমবেশী পাঁচ-ছয় দিনের মত সময় প্রয়োজন। আর তাই প্রস্তুতিটা অবশ্যই ভাল হওয়া উচিত।
আসুন ঝটপট জেনে নেই ব্যাগে করে আমরা কি কি নিবো। পাহাড়ে যাওয়ার সময় অবশ্যই স্থানীয় ম্যাপের একটা কপি এবং একটা ভাল কম্পাস বা দিক-দর্শন যন্ত্র নিয়ে যাওয়া উচিত আর যাদের জি,পি,এস ডিভাইস রয়েছে তাদের তো কথাই নেই। এছাড়াও যেকোন ট্রেকিংয়ে একটা ভাল ব্যাকপ্যাকের বিকল্প কিছুই নেই। তাই একটা ভালো ব্যাকপ্যাক, খুব ভাল গ্রীপ করে এমন একজোড়া জুতো, গামছা বা টাওয়েল, পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যাটারিসহ একটা ভাল টর্চ-লাইট, শুকনো খাবার, পানির বোতল বা ফ্লাক্স, টুথপেস্ট- টুথব্রাশ, হালকা এবং তাড়াতাড়ি ঘাম শুকিয়ে যায় এমন অল্প কিছু জামা-কাপড়, শীতের দিন হলে শীতের কাপড়, নিজেদের ব্যাক্তিগত ঔষধ এবং ফার্স্ট এইড বক্স, প্রচুর খাবার স্যালাইন, টয়লেট পেপার, সত্তর ফুট দৈর্ঘ্যের একটা ভাল দড়ি এবং পানি থেকে ব্যাগের সবকিছু বাঁচিয়ে রাখার জন্য পর্যাপ্ত পলিথিন ব্যাগ, প্লেট, গ্লাস, চামচ, ছোট একটা ছুড়ি, আগুন জ্বালানোর সরঞ্জাম, আর শখের ক্যামেরাটা গুছিয়ে নেয়ার পর আরো তিনবার যাচাই করে নিন। এছাড়াও যারা পাহাড়ি গ্রামগুলোতে না থেকে ক্যাম্প করে রাত্রিযাপনের ব্যাপারে বেশী আগ্রহী তারা অবশ্যই খাবার দাবার, তাবু এবং রাতে ঘুমানোর জন্য স্লীপিং ব্যাগ নিতে ভুলবেন না।
খাওয়া দাওয়া আর রাতে থাকার ব্যাপারে খুব বেশী কিছু বলার নেই। যেহেতু বান্দরবানের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে কোন হোটেল বা রিসোর্ট আশা করা বোকামী তাই যেকোন পাহাড়ি গ্রামে রাত্রি যাপন খুব সাধারণ একটা বিষয়। সাথে থাকা গাইডের সহযোগিতা কিংবা গ্রাম প্রধানকে অনুরোধ করে যেকোন গ্রামে খুব স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারেন একটা রাত। খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থাটাও গ্রাম থেকে করে নিতে পারেন খুব সহজেই।
এবার শেষের কথায় আসি । সর্বোচ্চ চূড়া বা দৃষ্টিনন্দন ঝর্না যেখানেই যান না কেন পাহাড়ি পথ প্রচন্ড কষ্টের আর তাই যথেষ্ট কষ্টসহিষ্ণু না হলে কিংবা অল্প-স্বল্প ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা না থাকলে এবং শারীরিকভাবে প্রস্তুত না হলে কোন বড় অভিযানে যাওয়া উচিত নয়। তাই এমন কোন পথে যাত্রা শুরুর আগে নিজেকে পুরোপুরি তৈরী করে নিয়ে পথে নামুন।
আর সেই সাথে সবার প্রতি অনুরোধ থাকল, পাহাড়ে কিংবা প্রাকৃতিক পরিবেশে যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলবেন না। অপচনশীল সমস্ত আবর্জনা নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। কারন পৃথিবীটা আমাদের আর তাই এটাকে সুস্থ রাখার দায়িত্বটাও আমাদের ঘাড়েই। ওহ্ আরেকটা কথা, আসুন সবাই এমন একটা দিনের স্বপ্ন দেখি যেদিন বই-খাতা, পত্র-পত্রিকা, সমস্ত রকম নথি-পত্রে তাজিন ডং নয় মদকতং বা সাকা-হাফং-কে বলা হবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিন্দু।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
ভাই সবই বুঝলাম। কিন্তু ওইখানে যাওয়ার পারমিশন কিভাবে নেয়া যেতে পারে? বা আদও পারমিশন দেয় কিনা…….. সে সম্পর্কে যদি একটু বলতে………
বর্তমানে সাকা হাফং যাওয়ার কোন পারমিশন দেয়া হয়না… যদি বিশেষ কোন সহযোগীতা বা উপায়ে যেতে পারেন তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
ভাই, কি জিনিস লিখলেন… এখন তো সাকা হাফং এর স্বপ্নে দিন রাত যাবে :/ শান্তি আর পাইলাম না :(
স্বপ্নগুলো সত্যি করে নেয়া উচিত.. :)
ভাই পারমিশন কি ভাবে নেবো?
বর্তমানে সাকা হাফংয়ের জন্য কোন পারমিশন ইস্যু হচ্ছেনা.. তবে বিশেষ কোন অনুরোধ বা সুপারিশের মাধ্যমে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।