পর্যটকের মৃত্যু শব্দগুলো আজকাল খবরের শিরোনামে যেন ধীরে ধীরে নিতান্তই সাধারণ হয়ে উঠছে। বাকী সব সাধারণ মৃত্যুর মতই ধীরে ধীরে এই মৃত্যুটাও আমরা মেনে নিচ্ছি কিংবা মেনে নিতে শিখছি। ১৫ আগস্ট উপজেলার বড়কমলদহ রূপসী ঝর্নায়, ২ এপ্রিল খইয়াছড়া ঝর্ণায়, ১৭ জুলাই মহামায়া লেকের পানিতে, ১৫ আগস্ট নয়দুয়ারিয়ার নাপিত্তাছড়া ঝর্ণায় বছর জুড়ে এমন অসংখ্য পর্যটকের মৃত্যু -র খবরেও আমাদের যেন কিছুই যায় আসছেনা। প্রতিটা খবরের পরপরই কদিন অনেকের শেয়ার, প্রতিবাদ, আক্ষেপ, কাদা ছোড়াছুড়ির পর আবার সবাই ভুলে যাই সবকিছুই। কেউ কেউ সরকার, স্থানীয় প্রশাসনকে দোষ দিচ্ছে তো আবার কেউ কেউ মৃত মানুষটার কি কি ভুল ছিলো তাই নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করছে। ফলাফল, আসল প্রসঙ্গ থেকে আমরা সরে দাঁড়াচ্ছি আর সেই সাথে বাড়িয়ে চলেছি এই ক্রমশ মৃত্যুর মিছিল।
মৃত মানুষটার কিছু ভুল হয়ত থাকতেই পারে কিন্তু সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন থেকে কিছু আশা করা নিতান্তই বোকামী। বোকামী এজন্যই বলছি কারণ, আমাদের দেশের সহজ সমাধানের নিয়মে মাথা ব্যাথার একমাত্র ঔষধ মাথা কেটে ফেলা। আর তা আজ দেশের বিভিন্ন ট্রেকিং রুট বন্ধ হয়ে যাওয়া দেখে ভালোই জেনে যাওয়ার কথা। আপনাদের এসব শেয়ার আর প্রতিবাদ থেকে হয়ত খুব পরিচিত লোকেশনে কিছু পরিবর্তন কিংবা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হলেও হতে পারে তবে একইসাথে দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেইলগুলো বন্ধ হয়ে যাবার বা বন্ধ করে দেয়ার সম্ভাবনাটাও একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা। পাহাড় পর্বতের পথে ঝুঁকি, চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা থাকবেই অতএব, পর্যটকের মৃত্যু, স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলা ইত্যাদি প্রসঙ্গে মত, অভিমত, প্রতিবাদ ইত্যাদি আপাতত একপাশে সরিয়ে রেখে আসুন জেনে নিই এমন কিছু ছোটখাটো বিষয়, যা মেনে চললে পাহাড়ের পথে আপনার কিংবা আপনার ভ্রমণপাগল বন্ধুর জীবনটা ঝুঁকিমুক্ত করে নেয়া যায় অনায়াসে।
পাহাড়ে পথে বেরিয়ে পড়ার আগে এবং পরে করণীয় বিষয়সমুহঃ
১. যে জায়গায় যাচ্ছেন সেখানকার ভূ-প্রকৃতি, স্থানীয় সুবিধা অসুবিধা, পথের ঝুঁকি, মানচিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব জেনে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
২. ছুটি আছে বলেই পাহাড়ে চলে যাবেন তা নয়। পাহাড় প্রকৃতির নিয়মে চলে অতএব, পাহাড়ে যাওয়ার আগে আপনার পরিকল্পনার পুরো সময় জুড়ে ঝড়-ঝঞ্জা, বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে কি না তথা আবহাওয়ার নিরবিচ্ছিন্ন পূর্বাভাস জেনে যাওয়ার চেষ্টা করুন অথবা আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী আপনার পরিকল্পনা ছক তৈরি করে নিন। আজকাল অসংখ্য ওয়েবসাইট রয়েছে যা থেকে পুরো পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলের আবহাওয়া সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য এবং পূর্বাভাস বেশ সহজেই জেনে নেয়া যায়।
৩. পাহাড়ি ঢল, আকস্মিক বন্যা বা ফ্ল্যাশ ফ্লাডের সময় যেকোন ঝর্ণা, ঝিরি কিংবা পাহাড়ি নদীতে না যাওয়ার চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ পাহাড়ি ঢলের সময় জলের তীব্র স্রোতে ভেসে বা ডুবে যাওয়া ছাড়াও জলে ভেসে আসা পাথর, গাছের গুড়ি এমনকি সাপের কামড়েও প্রাণনাশের সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে তীরে উঠে জল কমে যাওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এরপরও যদি উপায় না থাকে তাহলে দড়ি, বাঁশ ইত্যাদির সাহায্যে আপনার ভেসে না যাওয়া নিশ্চিত করে তবেই জলে নামুন। উল্লেখ্য যে, দড়ি ব্যবহার করে জলে নামার এই পদ্ধতি শুধুমাত্র ঝিরি বা নদী পাড় হবার জন্য।
৪. আপনি সাঁতার জানুন আর নাই জানুন, পাহাড়ের পথে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝর্ণা, ঝিরি, নদী যদি আপনার পথ বা গন্তব্য হয়, কিংবা বৃষ্টিপাত বা অন্য কোন কারণে যদি জল বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে অবশ্যই অবশ্যই নিজের সাথে ভালো মানের এবং আপনার শরীরে ভালো ফিট হয় এমন লাইফ জ্যাকেট রাখুন।
৫. পাহাড়ে পথে তা নিতান্ত সাধারণ কোন ডে-ট্যুর কিংবা কয়েকদিনের ট্রেকিং অভিযান যাই হোক না কেন অবশ্যই দলের সবার সাথে জনপ্রতি অন্তত ১৫ ফুট করে দড়ি রাখুন অথবা দলগতভাবে একটা ১৫০ ফুট (দশ জনের দলের জন্য) লম্বা দড়ি রাখুন। উল্লেখ্য যে, দড়ি ব্যবহার করার আগে তার ব্যবহারের খুটিনাটিগুলো জানুন।
৬. টাকা বাঁচানোর লক্ষ্যে সস্তা প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পরিহার করুন। মনে রাখবেন, স্যান্ডেলের দামের চেয়ে আপনার জীবন অনেক বেশী দামী। ভালো গ্রীপ করে এমন জুতো বা স্যান্ডেল পরিধাণ করুন। এক্ষেত্রে ডিক্যাথলন, অ্যাপেক্স কিংবা অন্যান্য স্পোর্টস ব্র্যান্ডের স্যান্ডেল বা জুতোগুলো হতে পারে সেরা পছন্দ।
৭. পাহাড়ের পথে ব্যাগে সবসময় এক জোড়া আপনার সাইজের এবং আরেক জোড়া বেশ বড় সাইজের ফুটবল খেলোয়ারদের মোজা সাথে রাখুন। অ্যাংকলেট পরে অথবা খালি পায়ে কিংবা শুধু জুতো পরে শ্যাওলা জমা পিচ্ছিল পাথরের উপর হাঁটা নিরাপদ নয়। মোজা অনেক বেশী গ্রীপ করতে সক্ষম তাই পিচ্ছিল পাথরের উপর দিয়ে হাঁটার সময় জুতো খুলে পায়ে মোজা পরে অথবা বড় সাইজের মোজা জুতোর উপর পরে তারপর পথ চলুন আর পেয়ে যান স্পাইডারম্যান গ্রীপ।
৮. পাহাড়ের পথে নিজেকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য সবসময় সাথে ট্রেকিং পোল অথবা বাঁশ রাখুন। এটি আপনাকে ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি জরুরী অবস্থায় শেল্টার বানাতেও সাহায্য করবে।
৯. আপনার অন্দরমহলের চুল কতটা পাকনা তা প্রমাণ করার জন্য অহেতুক পাহাড়ি ঢলে উন্মাদ কোন ঝর্ণার মাথায় বসে ছবি তোলা, কোন কিছু না জেনে বা বুঝেই উঁচু রকক্লিফ বা ঝর্ণার মাথা থেকে লাফিয়ে পড়া, ঝর্ণা বা খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে কতটা উঁচুতে আছেন তা বোঝানোর জন্য সেলফি তোলা ইত্যাদি থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। মনে রাখবেন এই হিরোইজমের চেয়ে বাড়িতে আপনার অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলো বেশী জরুরী।
১০. অ্যাডভেঞ্চার অ্যাকটিভিটিতে নিজের সাথে ক্যামেরা, মোবাইল, জিপিএস ইত্যাদি নানান ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থাকবেই। সমস্ত ডিভাইস এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র শুকনো রাখতে ড্রাইপ্যাক কিংবা পলিব্যাগ এবং নিজেকে শুকনো রাখতে রেইনকোট সাথে রাখুন। অনেক সময় সাথে থাকা জিনিসপত্র ভিজে যাওয়ার আশঙ্কায় অন্যমনস্ক মন আপনাকে ভয়ংকর কোন দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
১১. অভিযানের পথে আগুন সাথে রাখুন। বিপদজনক কোন পরিস্থিতিতে আগুনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
প্রতি বছর প্রকৃতির টানে, পাহাড়-ঝর্ণার প্রতি ভালোবাসার অমোঘ আকর্ষণ, অজানাকে জানতে চাওয়া কিংবা নিতান্তই সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু অনিন্দ্য সুন্দর ছবি আপলোডের নেশায় সারা দেশ থেকে দলে দলে অগনিত সংখ্যক ছেলে মেয়েরা ছুটে যাচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলের নানান গন্তব্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাহাড়, ঝিরি ঝর্ণাগুলোতে। অধিকাংশ সময় এইসব আনন্দ ভ্রমণ কিংবা অভিযান নিরাপদ এবং নির্ঝঞ্জাটভাবে শেষ করে ফেরা গেলেও কারো কারো জীবনে তা ভয়ংকর কোন বিপদে রুপ নিতে পারে নিমিষেই।
অতএব, পাহাড়ের পথে বেরুনোর আগে নিজের এবং দলের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তবেই পথে নামুন। মনে রাখবেন, অভিযান তখনই সফল যখন আপনি সুস্থভাবে বাড়ি ফিরতে পারবেন।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
অসাধারণ
ধন্যবাদ… :)