অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে । ব্রিজ পেরোনোর উত্তেজনা ফ্রিজ না করতে করতেই সিঁড়ি চড়ার কীর্তন শুরু। ফেরার সময় পা দুটো মনে হচ্ছে কাঁধে করে নিয়েই ফিরতে হবে। ব্যাজার মুখে ট্রেকিং পোলে ভর দিয়ে উঠে এলাম লোয়ার সিনুয়াতে। একটা হোমস্টের উঠোনে পাতা চেয়ারে বসে জিরিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ চোখে পড়লো ওই হোমষ্টের একটা ঘরের জানালায় ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ও বার্সেলোনা ক্লাবের ফ্ল্যাগ ঝুলছে। অবাক হয়ে রুমটার ভেতরে ঢুকে অবাকতর হয়ে গেলাম। ভেতরে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, লিভারপুল, টটেনহাম হটস্পারেরও ফ্ল্যাগ ঝোলানো রয়েছে। কি ব্যাপার? হোমস্টের মালিককে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো ইংল্যান্ড, স্পেন থেকে তো অনেক মানুষ আসে, কেউ জাতীয় পতাকা আনে তো কেউ তাদের প্রিয় ফুটবল ক্লাবের পতাকা নিয়ে আসে। তারাই এগুলো ওখানে রেখে যায় স্মৃতির উদ্দেশ্যে ! আর আমি মনে হচ্ছে স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমার পা দুটো রেখে যাব এখানে !

ছবি: লোয়ার সিনুয়া থেকে ছোমরং

ছোমরং গ্রামটাকে এখন ঠিক উল্টোদিকের পাহাড়ের কোলে দেখা যাচ্ছে। গাছে ফুল ফোটার মতন পাহাড়ে যেন বাড়ি ফুটেছে। যেন রূপকথার কোনো হ্যামলেট ! বেলা ১১ টা। পৌঁছোলাম সিনুয়াতে (Sinuwa)। উচ্চতা ২৩৫০ মি। এখানে ঢোকার একটু আগে মচ্ছপুছরে মেঘের আড়াল থেকে টুকি বলে আবার লুকিয়ে পড়েছে। বড় লাজুক পাহাড়। কিছুতেই চোখের সামনে নিজেকে পুরো উন্মুক্ত করতে চায় না। সেই ভোর বেলার পর এই এখন একটু ক্ষণিকের দর্শন। এতে কি আর মন ভরে। একেই আমি এক সপ্তাহ ধরে মাছ না ছোঁয়া বাঙালি, তায় একটা পাহাড়ের নামে মাছের গন্ধ, পাহাড়টাকে দেখতেও মাছের লেজের মতন। ভালোবাসাটা যে একটু লাগামছাড়া হবে, তাতে আর সন্দেহ কি !

ছবি: ফুটবল পাগল মালিকের হোমস্টে

তিন চারটে লজ নিয়ে তৈরি ছোট্ট একটি লোকালয় সিনুয়া। লোকজন এখন সবাই ব্যস্ত, কেউ ঘর পরিষ্কার করছে, তো কেউ থালা বাটি ধুতে বসেছে, তো কেউ দোকানে নানা টুকিটাকি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে। একটু পরেই যে শুরু হবে ট্রেকারদের আনাগোনা যারা এখানে রাত কাটাবে। তার আগে তো পুরো জায়গাটা পরিপাটি ভাবে সাজিয়ে তুলতে হবে। যেন প্রকৃতির এক পাঠশালা। প্রতিদিন এক ব্যাচ শিক্ষার্থীরুপি ট্রেকার আসেন জীবনের পাঠ নিতে। পরেরদিনই এই জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন নতুন গন্তব্যে। অবিচল হয়ে থেকে যায় শুধু পাহাড়, তার কোলের এই বাড়ি আর কিছু মানুষ। ফেরার সময় এখানে একরাত্রি থাকবো ঠিক করলাম !

ছবি: সিনুয়া থেকে মচ্ছপুছরে

আবার শুরু পথ চলা। পথে শুরু হলো ঘন জঙ্গল। হঠাৎ একটা মোড় ঘুরে দেখি সামনে পবনপুত্র ও পুত্রীদের মেলা বসেছে। ভাবলাম আমাদের দেখে ওরা সরে যাবে। হলো ঠিক উল্টো, ওরা আরো দলভারি করে তামাশা আরম্ভ করলো। ওরা প্রায় দশজন, আর আমরা দুজন, আমি আর অরিত্র। একবার ইচ্ছে হলো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে একটু ভেংচি দিই, কিন্তু যদি লাফিয়ে এসে গালে ঠাটিয়ে চড় মারে তো গালের সাথে সম্মানটাও মায়ের ভোগে চলে যাবে। নিরস্ত হলাম, অপেক্ষা করতে লাগলাম আমাদেরও দল ভারী হওয়ার। এক মিনিট পরে উল্টোদিক থেকে দুটো বিদেশি আসতেই হনুমানগুলো লেজ গুটিয়ে যে যেদিকে পারলো পালালো। ও হরি! এই ভীতুর ডিম গুলোকে এতক্ষণ এতো সম্মান দিয়ে এসেছি। হনুমানের চড়ে না হোক, লজ্জায় গাল গুলো লাল হয়ে গেল!

ছবি: জঙ্গলের রাস্তা

আরো কিছুক্ষণ এগোনোর পর আবার এক পাতালভেদী সিঁড়ির আবির্ভাব। ব্যাপারটা এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। মেনে নিয়েছি ভাগ্যকে ! অনেকটা নীচে নেমে আসার পর শুরু হলো বাঁশ আর রডোডেনড্রোন গাছের ঘন জঙ্গল। সবুজের মাঝে লালের পলকা ডট দেখতে লাগছিলো বেশ। বাঁশগাছের আধিক্যের জন্যই বোধ হয় জায়গাটার নাম হয়েছে ব্যাম্বু (Bamboo)। রয়েছে দু তিনটে লজ। আমরা এখানেই লাঞ্চ সেরে নিলাম। প্রকৃতি কিন্তু যথারীতি তার রোজনামচা মেনে শুরু করে দিয়েছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। দুপুর গড়িয়ে আড়াইটা বেজে গেছে। আজও কি নৈশ অভিযান হবে নাকি !

ছবি: রডোডেনড্রোন

ছবি: ডোভান

সময় নষ্ট না করে পনচো, রেনকভারে সুসজ্জিত হয়ে পা চালালাম। অল্প কিছুটা যেতেই এসে গেল ডোভান (Dovan)। উচ্চতা ২৬০০ মি। একটুও না বসে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো হনহনিয়ে এগিয়ে চললাম। কিন্তু একটু পরেই হল পথ বিভ্রাট। রাস্তা একটা জায়গায় দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা পাথুরে সিঁড়ির রাস্তা ওপরে চলে গেছে আর একটা সরু মাটির রাস্তা হালকা নীচে নেমে গেছে। আমার সাথে তখন ছিলো অর্ণব। দুজনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘন জঙ্গল, তারপর অন্ধকার হব হব করছে। এখানে পথ হারালে নির্ঘাত লেপার্ডএর পেটে পৈতৃক প্রাণটা যাবে! কিছুক্ষণ পর দুজন বিদেশি এসে ম্যাপ ট্যাপ নিয়ে কিসব গবেষণা করে বললো সিঁড়ির রাস্তাটা ধরতে হবে। আমারও মন বলছিল সিঁড়ি এত সহজে পেছন ছাড়বে না। যা থাকে কপালে বলে ওতেই পা বাড়ালাম। একটু এগিয়েই দেখি রাস্তাটা নীচে নেমে সেই সরু রাস্তাটার সাথে মিশে গেছে। কোনো মানে হয়! অহেতুক টেনশন শুধু !

অবশেষে তখন বেলা ৪:২০। দেখা পেলাম হিমালয়ার। দুদিকে খাড়া পর্বতের দেওয়ালের মাঝে গিরিখাতটা ক্রমশঃ সরু হয়ে গেছে। সবুজের জায়গা নিয়েছে বাদামি। সেখানেই দু তিনটে হোমষ্টে। পাশ দিয়ে প্রবল গর্জনে বইছে মোদিখোলা। দেখে মনে হচ্ছে এটাই যেন অন্নপূর্ণা স্যাংকচুয়ারীতে ঢোকার প্রবেশপথ !

ছবি: হিমালয়া

রাতে ডালভাতের জায়গায় অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে হলো। অর্ণবের সাজেশান অনুযায়ী অর্ডার দিলাম পিজ্জা। বেটা একে রিয়েল মাদ্রিদের সাপোর্টার (আমি বার্সেলোনার), তারপর সকালে সাসপেনশন ব্রিজে হার্টফেল করাচ্ছিলো আরেকটু হলে, এবার যদি পিজ্জাটাও অখাদ্য হয় তো কাল সকালে ওকে খাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেব এমন একটা প্ল্যান করেছি, গরমা গরম পিজ্জা টেবিলে এসে গেলো। মুখে এক টুকরো দিলাম। কি বলব অর্ণবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখ ছলছল করে উঠলো। যে জিনিসটা খাচ্ছি সেটা ডোমিনোজ, পিজ্জা হাট কে বলে বলে দশ গোল দেবে !

ছবি: সেই পিজ্জা

চলবে……

• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ১)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৩)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৬)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৭)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (শেষ পর্ব)

লেখকঃ অবকাশ অধিকারী।
পেশায় প্রকৌশলী, ঝাড়খণ্ডের মাইথনে নিবাস। নেশা ট্রেকিং করা। বছরে অন্তত দু/তিন বার বেরিয়ে পড়েন হিমালায়ের উদ্দেশ্যে।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণেঅনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)
জল-পাহাড়ের দিনরাত্রিজল-পাহাড়ের দিনরাত্রি - প্রথমাংশ

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণেঅনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)
জল-পাহাড়ের দিনরাত্রিজল-পাহাড়ের দিনরাত্রি - প্রথমাংশ

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণেঅনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)
জল-পাহাড়ের দিনরাত্রিজল-পাহাড়ের দিনরাত্রি - প্রথমাংশ

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!