ভর দুপুরের গনগনে সূর্যটা মাথায় করে থানছি-আলিকদম রোডের তের কিলোমিটার পয়েন্টে জীপ থেকে নামলাম সবাই। শীতের শেষভাগে একটু ঠান্ডা-গরম মেশানো আমেজের সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে সূর্য যেন তার সমস্ত রোষ ঢেলে দিচ্ছে এখানটায়। রোদের জন্য শান্তিতে একটু দাঁড়ানো তো দূরে থাক স্পষ্ট করে তাকানোও যাচ্ছেনা। কিন্তু পথের শুরুটা এখান থেকেই, আর তাই রোদের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে গাড়ির মেঝেতে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাকপ্যাকগুলো এক এক করে নামিয়ে আনলাম। এর মাঝে সানি আর তারিফের হাকডাক, “দাদা চা রেডী! চা তো চলবে তাই না”? রাস্তার পাশের ছোট্ট দোকানটার দরজায় দাঁড়ানো তারিফের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়েই একটা লম্বা চুমুক লাগালাম। চা-টা মোটেই সুবিধার নয় তারপরও আগামী অনেকগুলো দিন দুধ চায়ের কোন আশা নেই অতএব, জীবনের শেষ চা-য়ের মত অনুভূতি পাওয়ার একটা চেষ্টা চালালাম কিছুক্ষণ। এর মাঝে সবাই দেখলাম ব্যাকপ্যাক নিয়ে তৈরি। সবাইকে কিছু টুকটাক নির্দেশনা আর জিপিএস ম্যাপটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম সবাই।
পথটা শুধুই খাঁড়া পাহাড় বেয়ে নেমে যাওয়া তাই তেমন সমস্যা হচ্ছেনা কারোরই। যদিও গরম আর শুস্ক আবহাওয়ার কারণে সারা শরীর বেশ চিড়চিড় করছে। তারপরও এই পাহাড় থেকে নিচে নেমে গেলেই দৌছড়ি ঝিরিতে গিয়ে পড়বো এই আশ্বাস পেয়ে সবাই বেশ হড়হড়িয়েই নেমে যাচ্ছে। ঘামে ভেজা শরীর আর তুমুল গরমের পিন্ডি চটকাতে চটকাতে যখন ঝিরিতে এসে নামলাম তখন মনে হচ্ছিলো এর চেয়ে আরামের কিছু আর এই মুহুর্তে হতেই পারেনা। মুখে-চোখে পানি দিয়ে, অল্প কিছু সময় জিরিয়ে নিয়ে যখন সতের কেজি ওজনের ব্যাগটা আবার কাঁধে নিলাম তখনই নাদিয়া আর সাগরের যৌথ প্রশ্ন, ”দাদা পথ কি এখন ঝিরি ধইরা”? ওদের কথায় সবার দাঁত বের করা হাসির মাঝেই জিনিয়ার দুষ্টামি মাখা প্রশ্ন “ঝিরি না হইলে কি তোমরা ব্যাক করবা”? নতুন পাহাড়ে আসা সাগর অসহায়ের মত প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সানির দিকে তাকাতেই দীর্ঘদিনের প্রিয় বন্ধু সানির জবাব “তুই এক কাজ কর বন্ধু, যে পথ নাইমা আইলাম, ঐ পথ ধইরা চইলা যা”। এসব খুনসুটি থেকে ওদের দুজনকে মুক্তি দিতেই যেন পাভেল বলে উঠলো,”চল্ চল্, টেনশনের কিছু নাই এখন থেকে আগামী বেশ কদিন আমরা ঝিরি আর নদী ধরেই এগোবো। এবার ব্যাগ তোল্”।
ঝিরির ছায়া ছায়া পরিবেশ, হাজারো পাখির গান, ঝিরঝির করে বইতে থাকা জলধারাকে সাথে নিয়ে হেঁটে চলেছি সবাই। বনের হাজারো মিশ্র শব্দের মাঝে কেউ কেউ গেয়ে উঠছে, “উই শেল ওভার কাম” কিংবা ”ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা”। কখনো সারি বেঁধে, কখনও পাশাপাশি, কখনও কুম পেরিয়ে, কখনও ঘাসের পথ মাড়িয়ে হেঁটে যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলছে, ছবি তোলা আর সানির ভিডিওগ্রাফীর কায়দা কসরৎ। প্রায় শুকিয়ে আসা ঝুনঝুনি ঝর্ণার বাঁক ঘুরে, মেনকিউ পাড়া ছাড়িয়ে দৌছড়ি বাজার পৌঁছুতেই বিকেল গড়িয়ে গেছে অনেকটাই। গনগনে সূর্যটা পাশের উঁচু পাহাড়গুলোর আড়ালে হারিয়েছে বেশ আগেই।
শেষ বিকেলের আলোয় কিছুদিন আগে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দৌছড়ি বাজারকে একটা মৃত্যুপুরীর মত দেখাচ্ছে। দু-একজন বিচ্ছিন্ন মানুষ ছাড়া কেউ কোথাও নেই। বাজার থেকে টোয়াইন খালে নামার পুরোনো ঘাটটা যেন ভীষণ নিঃসঙ্গতায় তার অতীত জানান দিচ্ছে, একা! ঘাটে কিছুটা সময় চুপচাপ বসে থেকে আবারো পথে নামলাম। এখান থেকে আমাদের পথটা টোয়াইন খাল কিংবা এই পাহাড়ী নদী ধরেই। যেহেতু খুব দ্রুত অন্ধকার নেমে যাবে তাই বেশ তাড়াহুড়ো করেই এগোচ্ছি সবাই। আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছি আজ রাইতুমনি পাড়া কিংবা বড়ইতলি পাড়ায় কারো ঘরে রাতটা থেকে যাবো। তাই গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত বিরতিহীন হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। সন্ধ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে পড়িমড়ি করে এগোলেও শেষ রক্ষা হলনা। চারপাশে ঘোর আঁধার নেমে গেছে ঝুপ করেই। টর্চের আলোয় আর বারবার জিপিএস দেখেও রাস্তা ঠিক রাখা মুশকিল।
সন্ধ্যার প্রায় সাথে সাথেই খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে, নিদ্রা দেবীর সাথে সাক্ষাতের নিয়মিত অভ্যাস পাহাড়ের মানুষগুলোর। আর তাই একরাশ অন্ধকার গায়ে মেখে যখন আমরা বড়ইতলি পাড়ার যতীন্দ্র তঞ্চংগার বাড়ি পৌঁছেছি তখন পুরো গ্রামের মানুষ বোধহয় স্বপ্নের তেপান্তরে ঘোড়া ছুটোতে ব্যস্ত। ঘরের মানুষজন তো এই রাতে আমাদের দেখে রীতিমত অবাক। ঘরে থাকতে দেবে কি দেবেনা এসব আকাশ-পাতাল ভাবনা মাথায় এলেও এই ঘরে এর আগেও দুবার থাকার সুবাদে রাতে থাকার অনুমতি পেতে বিশেষ সমস্যা হলনা। ঠিক হল ঘরের সামনের টানা বারান্দাটায় আমাদের শোবার ব্যবস্থা করা হবে। সন্ধ্যা থেকেই বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা একটা আমেজ থাকলেও সবাই বেশ উৎসাহের সাথেই গোসল সেরে নিলাম টোয়াইনের হিম হিম পানিতে। সাথে করে নিয়ে আসা খাবার-দাবারের সদ্ব্যবহার করে, বেশ আড্ডা-শাড্ডা, তারার ছবি তোলা ইত্যাদির পর অজস্র তারায় ঝিলমিল করতে থাকা আকাশটাকে বিদায় জানিয়ে যখন ঘুমোতে গেলাম তখন বেশ রাত । ঠান্ডাটাও পড়ছে বেশ কনকনিয়ে। যতীন্দ্র দাদার ঘরের মোটা মোটা কাঁথা, নিজেদের সাথে থাকা স্লিপিং ব্যাগ, কম্বল ইত্যাদি জড়িয়ে নিয়েও যেন শীত কমছেনা। তারপরও প্রচন্ড ক্লান্তি যে কখন ঘুমে বিবর্তিত হল টের পাইনি।
পরদিন খুব ভোরে বেরুনোর পরিকল্পনা মাথায় থাকলেও ঘুম ভেঙ্গে উঠে, নাস্তা সেরে, ব্যাকপ্যাকগুলো গুছিয়ে নিয়ে আবারো যখন পথে নামলাম তখন বেশ রোদ উঠে গেছে। নদীর এদিকটার পরিবেশ একেবারে অন্যরকম। ছোট-বড় এমনকি অতিকায় পিচ্ছিল সব পাথরের ছড়াছড়ি, বেশ দীর্ঘ আর গভীর সব কুম, আবার সেসব কুমের পাড় ধরে যাওয়া রাস্তাটা কখনও কখনও এতটাই সরু যে নতুনদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো ভারী ব্যাগ নিয়ে ভারসাম্য রাখতে। তারপরও আগ্রহ, কৌতুহল, উন্মাদনা আর আরো নতুন কিছুর সামনে দাঁড়ানোর উত্তেজনায় সবারই স্নায়ু টানটান। কারো চেহারাতেই কষ্টের বা ক্লান্তির ছিটেফোটাও নেই। বড়ইতলি পাড়ার খুব কাছেই আছে দারুণ সুন্দর একটা ঝর্ণা, যার নাম থান-কোয়াইন। সেখানে পৌঁছে, ঝর্ণার নিচে বেশ খানিকটা সময় বিশ্রাম, ছবি তোলা, ভিডিও ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটানোর পর আবারো যাত্রা শুরু। চারপাশের অসাধারণ সব দৃশ্যকে পাশ কাটিয়ে পথ চলেছি। প্রকৃতি এখানে এতটাই উদার যে, কোনদিকে আসলে তাকানো উচিত সেটা ঠিক করতে করতেই আরেকটা সৌন্দর্যের সামনে এসে থমকে যেতে হয়। বাহারি সব রংয়ে রাঙানো বনভূমি, নীলচে সবুজ আঁকাবাঁকা পাথুরে নদী, উদাস বাউলের মত একটানা গাইতে থাকা পাখির গানের সাথে বয়ে যাওয়া স্রোতের কলকল শব্দ সব মিলেমিশে একাকার। মনে হচ্ছে, অচেনা, অজানা কোন রহস্যপুরীর মাঝ দিয়ে, আদি অকৃত্রিম বুনো গন্ধ গায়ে মেখে যেন পথ করে চলেছি আমরা কজন।
বিরামহীন উদ্যোমে একটানা হেঁটে দুপুরের বেশ কিছু সময় পর আমরা এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছুলাম যেখান থেকে মানুষ চলাচলের নিয়মিত পথটা আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। বাম পাশের পাহাড় বেয়ে চলে যাওয়া পথটা সাইংপ্রা ঝর্ণা যাওয়ার পথ আর ডানপাশে শুধুই নদী। আমাদের যেহেতু নদী নিয়েই পরিকল্পনা অতএব, নদীটাই আমাদের পথ। বড়সড় বোল্ডারের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বয়ে চলা নদীটায় নামার আগে একটু বিশ্রামের আশায় সাথে থাকা বিস্কুট-বাদাম ইত্যাদি সহযোগে একটা নাস্তা পর্বের আয়োজনে লেগে গেলাম আমরা কজন। জিনিয়া একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে ছবি তুলছে। সানি গোসল করবে ভেবে নদীতে নেমে হাঁটুজলে ডুব দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। এর মাঝে হঠাৎ করেই নদীর স্রোতে কেমন যেন একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম আমি। স্রোতটা মনে হল একটু বেড়ে গেছে তার সাথে যোগ হয়েছে একরাশ শুকনো পাতা আর ডালপালা। মুহুর্তেই বুঝে গেলাম হড়কা বান! কিন্তু কিছুতেই মাথায় আসছেনা, এই হড়কা বানের কারণ কি! আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই, বৃষ্টি তো দুরের কথা! ইতিমধ্যে সানি আর জিনিয়া নদী ছেড়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সবার অবাক চোখের সামনে দিয়ে ক্রমশ বাড়ছে স্রোত। নিমিষেই হাটুজলের শান্ত নদীটা পরিণত হয়েছে তীব্র খরস্রোতা গভীর নদীতে। জিনিয়ার হেলান দিয়ে দাঁড়ানো বিশাল পাথরটা ডুবে গিয়ে জল এখন তীরে দাঁড়ানো আমাদের পা ছুঁই ছুঁই। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলাম নদী পার হয়ে যেতে হবে আমাদের। ওপাড়ের পাথুরে দেয়ালটা তেমন সহজ না হলেও ওটা ধরে অন্তত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও হতে পারে কিন্তু এপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কতটুকু কি হবে বোঝা যাচ্ছেনা। অতএব, এখানে আটকে থাকার কোন মানে নেই।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
