‘যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে
অপরাজিতার মতো নীল হয়ে- আরো নীল- আরো নীল হয়ে
আমি যে দেখিতে চাই’
অন্ধকারের নিজস্ব এক মোহ আছে। টলোমলো আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখতে রাত তিনটায় উঠে ২০০৮ এ যখন রওনা হয়েছিলাম তখনও আকাশ ছিল অন্ধকার। সে সূচীভেদ্য অন্ধকারে পথ হেঁটেছিলাম অন্ধের মতো। খাড়া পাহাড়, খানা-খন্দ কিছুই টের পাচ্ছিলামনা। এবারও সেই একই ঘটনা, বাড়তি পাওনা, এবার ওই অত রাতেও কি এক তীব্র হাওয়া চলছে চরাচর জুড়ে। চলেছি আমরা সারিবদ্ধ কিছু মানুষ, অশরীরীর মতো, হাতের বা মাথার আলো টিমটিম করে জ্বলছে। অত দুর্ভেদ্য অন্ধকার কিছুতেই ভেদ করতে পারছেনা। ধীরে ধীরে চড়ছি পাহাড়ের মাথায় কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখবার আশায়।
খুব ভয়ে ভয়ে আছি। ২০০৮ এ এরকম সময়েই শুরু হয়েছিল ঝিরঝির করে তুষার পাত। সমিতি লেকে নেমে তারপর ওঠা শুরু করতে করতেই বুঝতে পারছিলাম আমরা পৌঁছতে পারবনা। সেই সময়ে আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নেই যে যেভাবে হাঁটছি, যতটা বরফ পড়ে আছে রাস্তায় আর সামনে যেমন রিজ আছে বলে শুনেছি, তাতে আমরা না পারব পৌঁছতে, আর না পারব কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখতে। এইসব সাতপাঁচ ভেবে আমরা ফিরে এসেছিলাম প্রায় দৌড়ে দৌড়ে লামুনেতে। ভাগ্যিস ফিরেছিলাম। দাওয়া, মানে আমাদের লিডার গেছিলো। ও এসে বলেছিল যে সামনে যা বরফ পড়েছিল তাতে ক্রাম্পন ছাড়া আমরা যেতে পারতামনা। ফিরে ঠিক করেছিলাম কিনা তা অবশ্য লামুনে থেকে তোলা সূর্যোদয়ের সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলেই বুঝতে পারবেন আশা করি। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি যে যতটুকু দেখছি সেটাই আমার অনেক। আমি জীবনেও ভাবিনি এসব দৃশ্য আমি কোনোদিন দেখতে পাব। তাই সেবার যেতে না পারার কোনো দুঃখই আমার নেই বরং যা দেখেছিলাম তাতেই আমার জীবন ধন্য হয়ে গিয়েছিল।
আলো এলো গোচা পিকে
সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরে গেলে খুব সহজেই ওই রাস্তাটা যাওয়া যায়। সেই একই রাস্তা এপ্রিলে ভীষণ কঠিন হয়ে যায়। তাও আমরা এপ্রিলেই বারবার গেছি কারণ আমার যে ওই ট্রেইলের বাকি সৌন্দর্যও বারবার দেখা দরকার। ওই বিশাল জায়গা জুড়ে রডোডেনড্রন আর ম্যাগনোলিয়ার লীলা-খেলা, জোঙ্গরির পরের ওই উপত্যকা জোড়া সীমাহীন বরফ, যা কখনই অক্টোবরে পাওয়া যাবেনা।
যাকগে,কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখতে এবার তো এগিয়ে চলেছি, দেখা যাক কি হয়। এবারও যদি না যেতে পারি, যাবনা। শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, আকাশটা যেন কেমন নীলাভ হয়ে আছে। ক্রমে কাছের, দূরের পাহাড়গুলো কালচে নীল অবয়বে ধরা দিচ্ছে। চোখ সয়ে গেছে অন্ধকারে। বেশ খানিকটা দেখতেও পাচ্ছি। সমিতির রিজে পৌঁছে গেছি। নিচে লেক, একপাশে কালচে নীল আর অন্যপাশ নীলাভ-সাদা, মানে বরফ জমে আছে। আস্তে আস্তে লেকের পাশে পৌঁছলাম। ভীষণ, ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। কেমন অশরীরী উপস্থিতি টের পাচ্ছি যেন লেকের চারপাশে। প্রেয়ার ফ্ল্যাগ পতপত করে উড়ছে। কেমন স্বপ্নাবিষ্টের মতো বাঁদিক দিয়ে লেককে প্রদক্ষিণ করে এগোচ্ছি নির্ধারিত ট্রেইলের দিকে। আস্তে আস্তে মায়াময় সমিতিকে ছেড়ে এগিয়ে চলেছি। চড়াই ভাঙছি এতদিনের অভ্যস্ত অভ্যাসে। খুব চড়াই নয় রাস্তা, তবে মোরাইন জোনের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। ক্রমশঃ দেখছি চারিদিকে বরফ জমে আছে, তখন বেশ শক্ত বরফ। হাঁটা খুব ধীরগতির হয়ে গেছে। খুব সাবধানে হাঁটছি। ক্রমশঃ আলো ফুটতে শুরু করেছে।
ফ্যাকাসে আলোয় পান্ডিম
আকাশ ফ্যাকাসে রং নিয়ে অপেক্ষা করছে সূর্যের। কখন সে আসবে আর সব বেরঙিনকে রঙিন করে দেবে মুহূর্তে। ভিউ পয়েন্ট ওয়ান এর কাছাকাছি চলে এসেছি। সূর্যও তার সাতরঙা ঘোড়া চড়ে টগবগিয়ে এগিয়ে আসছে সমস্ত পৃথিবীকে রঙে, আলোয় ভরিয়ে দেবে বলে। সে এক মাহেন্দ্রক্ষণ! বাঁদিকে গোচা পিককেই বড় লাগছে দেখতে, তার পেছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আরো এগোতে পারা আমাদের মতো সাধারণ ট্রেকারদের পক্ষে মুশকিল। বেশ সরু রিজ, সেটা আবার বরফ পড়ে সাংঘাতিক আকার নিয়েছে। আমরা ওখানেই হাঁটার ইতি দিলাম আর হাঁ করে গিলতে শুরু করলাম কমলা কুসুম কুসুম রঙা আলোর খেলা সমস্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা আর অন্যান্য পাহাড় জুড়ে। নরম আলোয় চারিদিক ভরে উঠলো। স্বর্গ কোথাও আছে কিনা জানিনা, তবে এটুকু জানি আমার পৃথিবী সৌন্দর্যে, শৌর্যে সবার সেরা। আর বর্ণনা দিচ্ছিনা, আমার মনে হয় ছবিই বাকি কথা বলে দেবে। অনেকক্ষণ ওই বরফের রাজ্যে বসে সামনে ওই কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় উপভোগ করলাম।
এবার আস্তে আস্তে ফিরতে শুরু করলাম সে এক অনির্বচনীয় ফিরে চলা। পেছনে ক্রমশঃ আরো ঝকঝকে হয়ে উঠছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, সমিতি লেকে নীল জল, সাদা বরফ আর অল্প অল্প বিভিন্ন পর্বতের ঝকঝকে প্রতিবিম্ব। সমিতি ছাড়িয়ে আমরা আবার নামতে শুরু করলাম লামুনের দিকে। সকালের আলোয় লাল ঘাস, কালচে পথ উজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্যিই গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’। লামুনে থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা অসাধারণ, সে তো ২০০৮ এই টের পেয়েছিলাম। ফিরে যখন তাঁবুর গোছগাছ শুরু করেছি, তখন পান্ডিম আর কাঞ্চনজঙ্ঘা ভীষণ ভীষণ উজ্জ্বল, ঝলসে দিচ্ছে আমাদের চোখ। সময় প্রায় দশটা, এবার ফিরব ফিরতি পথে। আজ থাকব এই ট্রেক রুটের নন্দনকাননে, কোকচুরাঙ এ। সেই তপোবন এবার টানছে আমাদের। ব্যাগপত্তর নিয়ে হাঁটা লাগালাম কোকচুরাঙ এর পথে।
আজ এই পর্যন্তই। লেখা নয়, এই পর্বে নায়ক হলো ছবি, উপভোগ করুন। কিছু কথা রয়ে গেলো বাকি, আসছি পরের পর্বে।
অন্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে
গোচা লা ট্রেকঃ পিনাকেতে লাগে টঙ্কার (পর্ব ১)
গোচা লা ট্রেকঃ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে (পর্ব ২)
গোচা লা ট্রেকঃ নেড়া আবার বেলতলায় (পর্ব ৩)
গোচা লা ট্রেকঃ সন্ধ্যে যেখানে রাত্রির সন্ধানে (পর্ব ৪)
গোচা লা ট্রেকঃ জোঙ্গরির রাত-ভোর (পর্ব ৫)
গোচা লা ট্রেকঃ কোকচুরাঙ ছুঁয়ে থানসিং (পর্ব ৬)
গোচা লা ট্রেকঃ ধূসর রূপের পান্ডিম (পর্ব ৭)
গোচা লা ট্রেকঃ ফিরে চলা ঘুম ঘুম রূপকথা ছেড়ে (শেষ পর্ব)
লিখেছেনঃ শুভময় পাল। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স শুভময়ের প্রিয় জায়গা। অজানা, অচেনা জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘোরা নেশা শুভময়ের।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
