প্রথম বিদেশযাত্রা বলে কথা! না হয় পড়শী দেশ, না হয় সেখানে পাসপোর্ট দেখাতে হয়না, সেখানে মোদের ওই বাপুর স্বর্গীয় হাসিমার্কা বুলুপাত্তি নিশ্চিন্তে চালানো যায়, কিন্তু তাও সেখানের প্রধানমন্ত্রীর নাম আর নমো নয় তো ! অদেখাকে দেখবার, অজানাকে জানবার, অচেনাকে চেনবার, অখাবাকে খাবার মারাত্মক সব স্বপ্ন নিয়ে তৈরী আমরা সপ্তস্যাঙ্গাতের দল (আমি, অর্ণব, অরিত্র, রামিজ, শিলু, কুন্তল, সাবির)। কিন্তু গৌরী সেন তো আর আমাদের কোনো আত্মীয় নন। অগত্যা আকাশপথ ছেড়ে রেলগাড়িই ভরসা । ট্রেনের নাম মিথিলা এক্সপ্রেস – বদনাম তো সুনা হি হোগা ! তায় আবার RAC টিকিট। একটা বার্থে দুজনে জুতোর খাপের মতো শুয়ে বসে গুতোগুতি করে এক ভাগ ঘুম আর তিনভাগ ছটফটানি দিয়ে সারারাত কোনোমতে কাটলো। ট্রেন কিন্তু সকাল পর্যন্ত ঠিক সময়ে চলেছে। আমরা তো রীতিমত অবাক। এও কি সম্ভব ! অনন্যা অন্নপূর্ণা ট্রেক থেকে ফিরে মিথিলা এক্সপ্রেসকে একটা ফাইভ স্টার রিভিউ দেব মনস্থির করেছি, এমন সময় ট্রেন বাবাজী তাঁর কুনামের প্রতি সুবিচার করতে আরম্ভ করলেন। মিথিলার নাম শিথিলা হলেই ভালো হতো বোধ হয়। মাত্র ৫ ঘন্টা লেট করে দয়াদাক্ষিন্য করে তিনি যখন আমাদের রকসউল (Raxaul) এ নামিয়ে দিলেন, সূর্যমামা পশ্চিমে একটু হেলান দিয়েছেন আর কি !
যাই হোক আমাদের বিহারের রকসউল থেকে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে নেপালের বীরগঞ্জ যেতে হবে। সেখান থেকে পোখারা যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যাবে। এই সীমানাটা অতিক্রম করতে হবে ঘোড়ার টাঙা গাড়িতে। দরদাম করে মাথাপিছু ৩০০ টাকায় দুটো টাঙ্গা ভাড়া করা হলো। এই প্রথম ঘোড়াগাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা হবে। যেন টাইম ট্রাভেল করে অতীতে ফিরে গিয়েছি। যেন ঐতিহাসিক কোনো স্বপ্ন!
ছবি : সেই টাঙা
দশ মিনিট কেটেছে কি কাটেনি সব স্বপ্ন, মোহ, শরীরের হাড়গোড় সব ভেঙেচুরে একসা হয়ে গেলো। সে কি জায়গারে ভাই। প্রথম কথা হচ্ছে রাস্তা। বড় বড় নুড়ি পাথর, স্টোনচিপস আর ধুলো মিশিয়ে যদি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সে রাস্তায় আর যাই হোক শরীর আস্ত থাকবেনা। দ্বিতীয় হচ্ছে জ্যাম। ইয়া বড় বড় লরি, ঘোড়ার গাড়ি, বলদ গাড়ী, মোটরসাইকেল সবাই নিজের নিজের জায়গা ভাগ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারোর কোনো তাড়া নেই। সময় যেন দাঁড়িয়ে গিয়েছে। নচিকেতা বোধ হয় এখানে এসেই লিখেছিলেন “যখন সময় থমকে দাঁড়ায়, নিরাশার পাখি দু হাত বাড়ায় “!
আমাদের টাঙাওয়ালা আমাদেরকে অবগত করালেন যে এটা রোজকার ঘটনা, নতুন কিছু নয়, বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর বিচলিত, বিচালি চিবোতে চিবোতে টাঙ্গার পেছনে যে মূর্তিমান শিবের বাহনরা এসে দাঁড়াচ্ছে তাদের দেখে আমাদের প্রাণবায়ু গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। টাঙ্গায় তাও সামনে যারা বসে আছি অনেক নিরাপদ, পেছনে যারা বসে আছে তাদের পুরো এক বন্ধুর ভাষায় চেকমেট অবস্থা। কখনো ঘোড়া গুতোতে আসে তো কখনো ভীমকায় বলদ শিংবিদ্ধ করতে আসে। তারওপর আমাদের এই চোখের জলে নাকের জলে নাজেহাল অবস্থা দেখে অন্য সব টাঙাওয়ালা, বলদগাড়ির চালকদের সে কি গা পিত্তি জ্বালানো হাসি। যত আমরা ভয় পাচ্ছি তত ঘোড়া, বলদ গুলোকে টাঙ্গার পেছনে মিলিমিটার দূরত্বে এসে দাঁড় করাচ্ছে। যেন ভারী মজার খেলা। নিজেদেরকে পুরো দেশভাগের রিফিউজি মনে হচ্ছিল!
ছবি: নেপাল গেট
কিন্তু সব দুঃস্বপ্নেরই শেষ হয়। এটারও শেষ হলো। ২ কিমি রাস্তা ৩ ঘন্টায় পার করে বীরগঞ্জে পৌঁছলাম। এক বেসরকারি ট্যুরিজমের অফিস থেকে গাড়ি ভাড়া করে বিকেল ৪:৩০ নাগাদ পোখারার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সাথে কিছু ভারতীয় টাকাকে নেপালি টাকায় কনভার্ট করে নেওয়া হোল, কারণ শুনেছিলাম যদিও নেপালে ভারতীয় একশ টাকা চলে, ট্রেকের পারমিট করাতে গেলে নেপালি টাকাই লাগবে।
ছবি: জর্গা হোটেল
ক্লান্ত শরীরকে গাড়ির সিটে এলিয়ে দিলাম। পোখারা অন্ততপক্ষে ৮ ঘন্টার রাস্তা, জানিনা কখন পৌঁছাবো ! ত্রিভুবন হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চললো আমাদের গাড়ি। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। ফলে এক ঘন্টা পর গাড়ি দাঁড় করানো হলো এক হোটেলের সামনে। নাম জর্গা হোটেল। চিকেন নাস্তা অর্ডার দেওয়া হলো। ভেবেছিলাম ভাত বা রুটি থাকবে। সকলকে হতভম্ব করে দিয়ে চিকেনের সাথে এলো মুড়ি আর চিড়ে !!! খিদের আগুনে সেটাই পরম আনন্দে ভস্ম করে দিলাম।
ছবি : মুড়ি চিকেন
গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। ভালো করে আলাপ হলো ড্রাইভারের সঙ্গে। নাম সাকিল আনসারী। তারই বদান্যতায় পোখারাতে একটা হোটেলও বুক করা হয়ে গেলো। পথে মুগলিং (Mugling) এ ডিনার সেরে নিলাম। এরপর গাড়িতে কখন যে চোখে চোখ লেগে গেছে জানিনা। ঢুলুঢুলু চোখে যখন পোখারায় হোটেলে নামলাম গোটা শহর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে।
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৩)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৫)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৬)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৭)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (শেষ পর্ব)
লেখকঃ অবকাশ অধিকারী।
পেশায় প্রকৌশলী, ঝাড়খণ্ডের মাইথনে নিবাস। নেশা ট্রেকিং করা। বছরে অন্তত দু/তিন বার বেরিয়ে পড়েন হিমালায়ের উদ্দেশ্যে।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।