‘ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে বৈশাখ মেঘ-শাদা-শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড়
নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে- কোনো এক শঙ্খবালিকার
ধূসর রূপের কথা মনে হবে….. ‘

থানসিংয়ে ভোর হলো। খোকাবাবুরা উঠে মুখ ধুয়ে পড়তে না বসে রেডি হলো নতুন হাঁটার জন্য। থানসিংয়ে সকাল আমার খুব প্রিয়। উঠে বাইরে চাতালটায় চলে এলাম। চা হাতে আড্ডা শুরু হলো। মনে পড়ে গেল আবার সেই ২০০৮ এর থানসিং।  ওই ভাঙাচোরা ট্রেকার্স হাট থেকে ভোরবেলা বাইরে বেরিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। সেবার আমরা ছাড়া একটি ফ্যামিলি ছিল রাতে থানসিংয়ে, বাবা মা আর মেয়ে, প্রত্যেকেই সুন্দর হাঁটছিল আগের দিন। সন্ধেবেলা আমরা একটু করে ব্র্যান্ডি খাচ্ছি দেখে চিরাচরিত ধাক্কা খেয়ে তারা একটু আলাদা হয়ে গেছিলেন। সকালবেলা দেখি তারা আশীষদার কাছে গল্প শুনছে বিভিন্ন ট্রেকের আর আশীষদা নির্লিপ্তভাবে গল্প বলতে বলতে সিগারেটের তামাক ফেলে মন দিয়ে প্রসাদ বানাচ্ছে। তারা ভাবতেও পারছেনা যে এই লোকটা কি বানাচ্ছে।

যাত্রা শুরু- থানসিঙ

যাই হোক, আবার বর্তমানে ফিরি। আজ হাঁটা খুব কম, ওই ঘন্টা দুই মতো। সবাই জানেন এখন সমিতি লেকে টেন্ট পিচ করা নিষেধ। তার জন্যও আমরাই দায়ী। এতো নোংরা করি সব জায়গা যে বাধ্য হয়ে এসব বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয়।  ২০০৮ এও আমরা থাকতে পারিনি, লামুনেতে সবাই থাকে, আমরাও। সেই লামুনে পৌঁছতে ঘন্টা দুই লাগে।

শুরু হলো পথ চলা। একেবারে সহজ সুন্দর রাস্তা। থানসিং এর উচ্চতা ১২,৯৪৬ ফুট আর লামুনে ১৩,৭৪৩ ফুট, বোঝাই যাচ্ছে হাঁটাটা কত সোজা। জুনিপারের ঝোপঝাড় চারিদিকে, আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ল একটা ওয়াচটাওয়ার। বাব্বা, এখানে আবার এটা কে বানালো?

এই বিস্ময় অবশ্য ২০০৮ এ হয়েছিল। কাছে যেতেই দেখেছিলাম সেটা পরিত্যক্ত। আস্তে আস্তে সামনের দিগন্ত প্রসারিত হচ্ছে। মাউন্ট পান্ডিম ক্রমশ দৈত্যাকৃতি চেহারা নিয়ে আকাশ ঢাকার উপক্রম করছে কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা এখনো চোখের আড়ালে।  হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটা ছোট্ট খোলা পড়ল। হলুদ তার সব পাথর, আর জল ও হলদেবর্ণ। সালফারের পরিমাণ খুব বেশি এখানে। বেশ রূপকথার রাজ্যে চলেছি মনে হয়। আশপাশের লাল ঘাস আর লালচে জুনিপার, নীল আকাশ, ধপধপে সাদা পান্ডিম, কখনো কখনো মেঘের ফাঁক দিয়ে মাউন্ট নরসিংহ!! এ কোথায় এলাম?

লামুনের রাস্তায়

চলেছি আনমনে, সুবিশাল হিমালয়ের কোল ঘেঁষে। আপন করে নিয়েছে আমায় বড়। এই মাঠ, এই লালচে ঝোপ, ওই পাহাড়, এই আকাশ আমার একান্ত নিজের। অদ্ভুত এক অনুভূতি। চলতে চলতে যথারীতি আমি পেছনে। এক অদ্ভুত নিজস্ব উত্তেজনা তৈরী হচ্ছে মনে মনে, কারণ আমি জানি, ওই বাঁদিকে একটু বাঁক নিলে, বাঁদিকের যে কালো পাথুরে টিলা সেটা আরো একটু বাঁদিকে সরে গেলেই এক ফ্রেমে আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পান্ডিম কে পাবো। চলে এসেছি প্রায় সেই জায়গায়।  ২০০৮ সালে যখন আমি প্রথম যাচ্ছি, সেই দিনের অনুভূতিটা ভুলতে পারিনা। পান্ডিম দেখে চোখ ক্লান্ত, একটু বোধহয় অন্যমনস্ক ছিলাম, হঠাৎ এই দৃশ্য,  ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে’ গেল।

এলেম নতুন দেশে, যে দেশ প্রকৃতির নিজস্ব। আমরা হাঁটছি, আমাদের কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পান্ডিম দেখছে; লক্ষ্য রাখছে সব, আরো এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা ব্ল্যাক কবরু, নরসিংহ এরাও নিশ্চই আশেপাশেই আছে। ওহ, আরেকটা কথা, আমরা দার্জিলিং থেকে যে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখি, হঠাৎ দেখলে এখানে তাকে চিনতে পারবেননা। আসলে ওর বাড়িতে চলে এসেছি তো, দূর থেকে সাজুগুজু করা কাঞ্চন এখানে আরো খোলামেলা, আরো আপন, আরো অন্যরকম। আসলে দার্জিলিং থেকে যে দিকটা দেখি, এখানে আমরা আরেকটু বাঁদিক থেকে দেখছি ওকে, তাই একটু আলাদা লাগে, এই আর কি, নাহলে তো এ সেই আমাদের চিরচেনা কাঞ্চনই!

প্রেকচু, লামুনে

আরো একটা নিজস্ব অনুভূতি আছে আমার এই রাস্তায়। আপনাদের সাথে শেয়ার করি সেটাও। ২০০৮ এ যখন প্রথম হাঁটি এ রাস্তায়, পান্ডিম যত কাছে আসছিল, তত চোখে পড়ছিল পান্ডিমের গা বেয়ে যেন দুটো মানুষ উঠছে। হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে এগিয়ে ছিলাম, কিন্তু তারা আর এগোয়না। ভাবলাম এতো দূর থেকে তো, তাই হয়তো তাদের নড়াচড়া বোঝা যাচ্ছেনা। ও বাবা, পরদিনও তারা সেখানেই!! এই ২০১৪ তেও তারা ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে! হয়তো দুটো পাথর, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার সেটা বিশ্বাস করতে একদম ইচ্ছে হয়নি।

লামুনে থেকে

হাঁটতে হাঁটতে, পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পৌঁছলাম লামুনে। ও বাবা, লামুনেও ভোল বদলেছে এই ছ’বছরে। ২০০৮ এ কিছুই ছিলোনা, পেছনে খানিক পাথরের দেওয়াল আর সামনে আদিগন্ত লালচে ধূসর মাঠ। বাঁদিক দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিক থেকে বয়ে আসা প্রেকচু খোলা (নদী); আর সেই নদী বরাবর তাকালে ধীরে ধীরে মোরেন, পাথর, গ্লেসিয়ার ছাপিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা, আর ডানদিকে যথারীতি আমাদের মাথার ওপর ঝুঁকে থাকা পান্ডিম। এবার দেখলাম ওই পাথরের আবডালে একটা কিচেন হাট, আর বেশ কিছু টেন্ট আগে থেকেই পিচ করা আছে।

যাক সেসব কথা। আমাদের টেন্ট পিচ করা হলো, তখন ২ টো মতো বাজে। আমরা জোর আড্ডায় বসলাম। প্রেকচুর উল্টোদিকের কালো পাথুরে পাহাড়ে হঠাৎ দেখি বেশ কিছু ভারাল (ব্লু শিপ) ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ অঞ্চলে ভালোই পাওয়া যায় এই ভারাল। এবার আর লামুনে থেকে সমিতি ঘুরতে গেলামনা। আগেরবার এসে জিনিসপত্র রেখে টেন্ট পিচ করে বেরিয়ে গেছিলাম সমিতির উদ্দেশ্যে। সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। লামুনে থেকে ক্রমশ পাথুরে পথ বেয়ে উঠছি। মোটামুটি ৪৫-৫০ মিনিট ওঠার পরে একদম ওপরের রিজে পৌঁছলাম, নিচে নীলচে সাদা সমিতি। আহা সে কি দৃশ্য! পান্ডিম একদম সমিতির গা থেকে উঠে গেছে। তরতর করে সমিতির পাশে নেমে এলাম। প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল আজও মনে পড়ে। প্রথমে অবাক হয়ে খানিকক্ষণ দেখেই গেলাম। লম্বাটে নীলচে সাদা সেই লেক। কিছুটা জমে বরফ হয়ে আছে, আর বাকিটা ঘন নীল। আমরা যেদিক দিয়ে লেকে নেমেছিলাম, তার উল্টোদিকে একটু বাঁদিক ঘেঁষে ট্রেইল উঠে গেছে জেমাথাঙের দিকে। গাইড বলেছিলো পরদিন ভোর-রাতে ওই ট্রেইল দিয়ে যেতে হবে। পান্ডিম দেখা যাচ্ছিলনা এতো কাছে, তার কোলের কাছে আমরা পৌঁছে গেছিলাম। শুয়ে পড়েছিলাম সটান। অদ্ভুত দেখেছিলাম পান্ডিমকে। ঝুঁকে পড়ে আমায় দেখছে। আর কিছু লেখা সম্ভব নয়, ছবিতে বাকিটা দেখে নিন।

সমিতি লেক।

এবার তো আর সমিতি যাইনি, বসে বসে আগের বারের বিভিন্ন গল্প করছিলাম। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, আশীষদার বিভিন্ন স্মৃতি এই সব। এর মধ্যে দাওয়া, মানে আমাদের লিডার বলল, ধুররর চুপচাপ বসে আছি, যাই উল্টোদিকের পাহাড়ে একটু উঠে আসি। ও এরকমই। তো আমরা কিছু বোঝার আগেই ও হাঁটতে হাঁটতে প্রেকচু টপকে চলে গেলো এবং উঠতে শুরু করল। এসব যখন ঘটছে তখনও আকাশে রোদ্দুর। আমরা হাঁ করে দেখলাম দাওয়া টিকটিকির মতো ওই পাথর বেয়ে বেয়ে উঠছে।  খানিক পরে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো। আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এলো তখনি, আর ঠিক তক্ষুনি দাওয়া যে পাথরের আড়ালে শেষ দেখা গেছিল সেখান থেকে হুড়মুড় করে পাথর গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো!

আমরা ভীত, সন্ত্রস্ত্র, কিছুই করার নেই, কেউই ওভাবে উঠতে পারবনা। কাটুক, মানে আমাদের গাইডকে ডাকা হলো, ও খুব নির্লিপ্ত গলায় বললো যে ও খুব ভালো মত এ কদিন দাওয়াকে দেখে নিয়েছে, ওনার এসবে কিচ্ছু হবেনা। খানিক পরে ওপরে যেন দাওয়াকে দেখা গেলো, ঠিক ওখান থেকেই উড়ে এলো এক হিমালয়ান ঈগল। তারপর আর কিছু নেই, দাওয়া খুব ভালোভাবেই নেমে এলো, এসে বললো যে একটু ভয় পাওয়ানোর জন্য ওই পাথর গড়িয়েছিল। হাসি, গানে, গল্পে কাটল আরো কিছুক্ষণ। এবার শোয়ার পালা, কাল রাত তিনটায় উঠে যাত্রা শুরু।

চলবে …

অন্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে

গোচা লা ট্রেকঃ পিনাকেতে লাগে টঙ্কার (পর্ব ১)
গোচা লা ট্রেকঃ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে (পর্ব ২)
গোচা লা ট্রেকঃ নেড়া আবার বেলতলায় (পর্ব ৩)
গোচা লা ট্রেকঃ সন্ধ্যে যেখানে রাত্রির সন্ধানে (পর্ব ৪)
গোচা লা ট্রেকঃ জোঙ্গরির রাত-ভোর (পর্ব ৫)
গোচা লা ট্রেকঃ কোকচুরাঙ ছুঁয়ে থানসিং (পর্ব ৬)
গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)
গোচা লা ট্রেকঃ ফিরে চলা ঘুম ঘুম রূপকথা ছেড়ে (শেষ পর্ব)

লিখেছেনঃ শুভময় পাল। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স শুভময়ের প্রিয় জায়গা। অজানা, অচেনা জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘোরা নেশা শুভময়ের।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

কোকচুরাঙগোচা লা ট্রেকঃ কোকচুরাঙ ছুঁয়ে থানসিং (পর্ব ৬)
কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

কোকচুরাঙগোচা লা ট্রেকঃ কোকচুরাঙ ছুঁয়ে থানসিং (পর্ব ৬)
কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

কোকচুরাঙগোচা লা ট্রেকঃ কোকচুরাঙ ছুঁয়ে থানসিং (পর্ব ৬)
কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!