অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)। আগের দিনের ধকলের জন্য কিনা জানিনা এক ঘুমেই সকাল করে দিলাম। বাইরে বেরিয়ে মেজাজ পুরো ফুরফুরে হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারিনি, এখন ভোরের আধো আলো আধো আঁধারীতে দেখলাম, আমরা যে হোমস্টেটায় রয়েছি সেটা পাহাড়ের একদম দক্ষিণ খাদের মাথায়। আর আমরা কাল রাতে এই খাদ বরাবর পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসেছি। মনে মনেই নিজেকে শেরপাভূষণ সম্মানে ভূষিত করে নিলাম !
ছবি: ভোরের আলোয় মচ্ছপুছরে
মচ্ছপুছরের পেছনদিক থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে সূর্যের ছটা। পেছনদিক থেকে সূর্যোদয় হওয়ার জন্য একটা ধোঁয়াশা ভাব থাকা সত্তেও অবয়বটা স্পষ্ট। সামনে দিগন্তবিস্তৃত একের পর এক পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের বুকে ধাপচাষের নকশাগুলো যেন ক্যানভাসে কোনো চিত্রশিল্পীর তুলির টান। এই যে পাহাড়ের লেয়ারের ছবি এটা প্রায় সব ট্রেকেই একবার না একবার চোখে পড়ে, কিন্তু কোনোদিনই পুরনো হয় না। কারণ এর মধ্যে যে খুঁজে পাই জীবনের প্রতিচ্ছবি। একেকটা লেয়ার যেন জীবনের একেকটা হার্ডল। উঁচুনিচু ঢালের মতোন কোনো পরীক্ষা সহজ, তো কোনো পরীক্ষা কঠিন। অসাবধান হওয়া চলবে না। তাহলেই পড়তে হবে পাহাড়ের খাদে নয়তো জীবনের ফাঁদে !
ছবি: ধাপচাষের নকশা
আজ আমাদের গন্তব্য হিমালয়া (Himalaya)। উচ্চতা ২৮৭০ মি। । কত ভেবেচিন্তে হিমালয়ের মধ্যেই একটা জায়গার নাম রাখা হয়েছে হিমালয়া। নির্ঘাত কোনো ল্যাধখোর বাঙালির কাজ। তবে রাস্তা অনেকটা। প্রায় ৮ ঘন্টা লাগবে। আগের দিনের মত রাতে অভিসার করার ইচ্ছে কারো নেই। তাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সোয়া সাতটা নাগাদ বেরোবো ঠিক করলাম। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে লাগলো চমক। পুরীর সঙ্গে তরকারিটা এখানের লোকেদের ঝকমারি বলে মনে হয় বোধহয়। খালি ছিবড়ে পুরী কে খায় ! মেজাজটাই বিগড়ে গেল। শুধু পাতে ভুবনভোলানো স্বাদের প্যানকেকটা ছিল, সব কিছু ভুলে গেলাম, নাহলে একটা অনর্থ ঘটে যেতো আরেকটু হলে !
ছবি: ভার্ডিটার ফ্লাইক্যাচার
তল্পিতল্পা নিয়ে যখন রওনা হচ্ছি ঘড়ির কাঁটা আটের দোরগোড়ায়। হবেই তো, বাঙালি বলে কতা কিনা। একটু লেট না করলে পেট গরম হয়ে যাবে যে! আগেরদিনের পায়ের ব্যাথা এখনো মরেনি। সবে উঃ আঃ করতে করতে দু তিন পা এগিয়েছি, দিনের আলোতেও কিলোওয়াট বাতির ঔজ্জ্বল্য নিয়ে চোখের সামনে জ্বলে উঠলো অন্নপূর্ণা দক্ষিণ। দেখে মনে হলো যেন কোনো মমতাময়ী মা পরমস্নেহে তার সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে রয়েছে। দিনশেষে তাদের ঘুম পাড়িয়ে নিজে জেগে থাকে অতন্দ্র প্রহরীর মত, রাত শেষে আবার তাদের ঘুম ভাঙিয়ে বলে, দেখো দুনিয়ায় রঙ্গ কত।
ছবি: হিমালয়ান ভিউ হোটেল
ছোমরঙের আসল রং এবার আমাদের সামনে ফুটে উঠলো। চারিদিকে প্রচুর হোটেল, হোমস্টে, লজ । সব কটাতেই একটা করে ব্যালকনি রয়েছে যার মুখ উত্তর-পূর্ব দিকে আর প্রায় প্রত্যেকের নামের শেষে রয়েছে একটা করে ভিউ: হিমালয়ান ভিউ, অন্নপূর্ণা ভিউ, মাউন্টেন ভিউ এইরকমই আরকি। একটু আফসোসই হচ্ছিল। রাতে এখানটায় থাকলে মচ্ছপুছরের সাথে অন্নপূর্ণারও চাঁদপানা মুখটা ফাউ হিসেবে দেখতে পেতাম। যাকগে যাক যা গেছে তা যাক, ভেবে লাভ নেই। ছোমরং চেক পোস্টে সেই TIMS কার্ড দেখিয়ে সরকারকে আস্বস্ত করলাম যে আমরা এখনো বহাল তবিয়তেই আছি, ব্যস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু একি ! এখান থেকে তো পাথরের সিঁড়ি ধাঁই করে সোজা নীচে নেমে গেছে। স্বর্গ আরোহনের পর এখন আবার পাতাল প্রবেশ করতে হবে ? আর শুধু নামা বলে নামা নাকি, এখন নামছি মানে আবার ওপরে ওঠতে হবে। তার ওপর মাথার ওপর দিয়ে বিচ্ছিরি রকমের শব্দ করে ১০ মিনিট ছাড়া ছাড়া হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে। এগুলো পোখারা থেকে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প যাতায়াত করে দেড় ঘন্টায়। ভাড়া মাত্র ৫০০ ডলার ! কুবেরের নাতি সব। ওই টাকায় আমার দু তিনটে ট্রেক হয়ে যাবে!
ছবি: ছোমরং গ্রামের এদিক ওদিক
ছবি: ছোমরং গ্রামের এদিক ওদিক
ধুপধাপ করে নামা শুরু করলাম। যতো নীচে নামতে থাকলাম ওইসব রাজকীয় হোটেলগুলোর জায়গা নিতে থাকলো ছিমছাম গ্রাম্য লোকালদের বাড়ি। বাড়ি গুলোর সামনে ধাপচাষের জমি। ধান আর ভুট্টাটাই চোখে পড়ল বেশি। রাস্তায় লাইন দিয়ে ট্রেকার। কেউ ABC যাচ্ছে তো কেউ ABC থেকে ফিরছে। অধিকাংশই বিদেশি। কোরিয়া (অবশ্যই সাউথ), জাপান, ইংল্যান্ডের মানুষজনই বেশি। পথে আলাপ হলো আমাদেরই বয়সী এক মালয়েশিয়ান যুবকের সাথে। সোলো ট্রেকার। ছোকরা আগের বছরও নাকি ABC এসেছিল, কিন্তু তুষারঝড়ের জন্য ব্যাম্বুর পরে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর যেতে পারেনি। তাই আবার এসেছে, এনথুর লেভেল টা ভাবো একবার !
ছবি: সেই সাসপেনশন ব্রিজ
কথায় কথায় এসে পড়লাম এক নদীর তীরে। তীর বলছি বটে তবে এটা আসলে খাদের একটা সাইড। খাদের অনেক গভীরে বয়ে চলেছে ছোমরং খোলা। নদীখাত টা পেরোতে হবে একটা লোহার সাসপেনশন ব্রিজ ধরে। ব্রিজে একটুখানি এগিয়েছি, আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। ব্রিজটা হালকা দুলতে আরম্ভ করেছে। প্রায় তিনশ ফুট নীচে নদী গর্জন করছে এবার কালি তোমায় খাবো বলে। আমার হয়েছে সাপে ছুঁচো গেলার মত অবস্থা। নীচে তাকালে বেশ ভয় লাগছে, আবার না তাকিয়ে বেশিক্ষণ থাকতেও পারছিনা। রোমাঞ্চর আকর্ষণ যে বড় বিষম জ্বালা। বেশ শক্তপোক্ত ব্রিজ, জানি কিছু হবে না, কিন্তু অবাধ্য মন যে মানে না। এই বুড়ো বয়সে ভ্যাঁ করে কেঁদে দেওয়াটা শোভনীয় হবে না কিনা, তাই মুখে একটা কিছুই হয়নি গোছের ভাব করে রাখলাম। আর এমনি কপালদোষ, তাড়াতাড়ি যে ব্রিজটা পেরোবো তারও জো নেই। সামনে যে রয়েছে সাহসী বীরপুরুষ অর্ণব। বেটাচ্ছেলে শুধু ধীরগতিতেই এগোচ্ছে না, সাথে সাহিত্য করে করে ছবি, ভিডিও করতে করতে যাচ্ছে। তোর ছবির চক্করে আমি যে ছবি হয়ে যাবো ! দুরুদুরু বুকে শিব শিব বলতে বলতে যখন ব্রিজটা পেরিয়ে অন্য পারে পৌঁছলাম পাদুটো রীতিমত কাঁপছে। এ যাত্রা বেঁচে গেলাম যা হোক তাহলে! আর হ্যাঁ পাহাড়ে আমি রামনাম করিনা। শিবের বাগানবাড়িতে এসে তাঁর নাম না করলে প্রভু যদি আবার অফেন্ডেড হন !!!!!
চলবে……
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ১)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৩)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৫)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৬)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৭)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (শেষ পর্ব)
লেখকঃ অবকাশ অধিকারী।
পেশায় প্রকৌশলী, ঝাড়খণ্ডের মাইথনে নিবাস। নেশা ট্রেকিং করা। বছরে অন্তত দু/তিন বার বেরিয়ে পড়েন হিমালায়ের উদ্দেশ্যে।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।