অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে । রাত ২ টো। যথারীতি ইনসোমনিয়ার শিকার। ধ্যাৎতেরিকা বলে ক্যামেরা আর ট্রাইপড নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রুমের বাইরে বেরিয়ে আসার পর কিন্তু একটু ভয় লাগলো। কেউই প্রায় জেগে নেই, এই নিঝুম রাতে যদি কুকুরগুলো তাড়া করে পালাবো কোথায়! আর তাছাড়া বিকেলে অন্নপূর্ণা আরোহনকালে মৃত মানুষদের একটা স্মৃতিসৌধ দেখে এসেছি। এখানে দু একটা ভূত থাকা অস্বাভাবিক নয় আর আমার ঘাড়টাও যেকোনো সময় মটকে যেতে পারে!

ছবি: প্রথম সূর্যের আলো

ছবি: আলোকিত অন্নপূর্ণা দক্ষিণ

ছবি: মেঘের রাজ্যে অন্নপূর্ণা

ছবি: মেঘের রাজ্যে অন্নপূর্ণা

অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে এসে রুমে এত তাড়াতাড়ি ফিরে গেলে তো হাজারটা জবাবদিহি করতে হবে। ডরপোক বলে বলে কানের পোকা নাড়িয়ে দেবে সব! সুতরাং ফেরা চলবে না, কপাল ঠুকে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। আর বেরিয়েই পুরো হুব্বা। এমন দৃশ্য সামনে থাকলে ভূতেরও ঘাড় মটকানোর মত দুষ্ট বুদ্ধি মাথায় আসবে না। পশ্চিম আকাশে চাঁদ তখন অন্নপূর্ণার আড়ালে সবে মুখ লুকিয়েছে আর অন্নপূর্ণার ছায়া ধীরে ধীরে গ্রাস করছে মচ্ছপুছরে ও তার সঙ্গী গন্ধর্বচুলিকে! পাহাড় যেন গলায় মুক্তোর মালা ঝুলিয়েছে! গোটা বেস ক্যাম্প ঘুমে বিভোর, চারিদিক নিশ্চুপ, মাঝে দাঁড়িয়ে শুধু আমি আর আমার ট্রাইপডে ক্যামেরা !

ছবি: প্রতিফলন

ভোর হতেই দোর খুলে সটান বাইরে। সানরাইজ দেখতে হবে যে। উত্তেজনার এত বহর, পায়ে জুতোটাও পরার জন্য সময় নষ্ট করিনি, চপ্পল পায়েই বেরিয়ে গেছি। বাজে তখন ৫:৩০। আকাশ তো দেখছি নির্ঝঞ্ঝাট। কিন্তু মচ্ছপুছরে পূর্ব দিক থেকে কিছু মেঘকে আমাদের দিকে লেলিয়ে দিয়েছে। মনে হয় তেনার গোঁসা হয়েছে। কারণ সূর্য উঠবে পূর্বদিকে মচ্ছপুছরের পেছনদিক দিক থেকে আর সেই আলো এসে পড়বে পশ্চিমে অন্নপূর্ণার ওপর। আমাদের সবার মুখ তাই অন্নপূর্ণার দিকে ঘোরানো। তাকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না এই ভেবে মচ্ছপুছরে আমাদের সকালটা ভণ্ডুল করার এই কারসাজি করেছে!

ছবি: সূর্যের আলোয় বেস ক্যাম্প

এক রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ চলছে। কে জিতবে কে হারবে। দাঁতে নখ কাটতে কাটতে পুরো আঙ্গুলটা মুখে পুরবো পুরবো করছি ম্যাচ টাই হয়ে গেল। যেই মুহূর্তে বদখত মেঘ গুলো অসুরের মত অন্নপূর্ণার মুখ ঢাকতে গেল, রাজপুত্রের মত সূর্যের ছোঁয়ায় অন্নপূর্ণার মুখ লাল হয়ে গেল। পরক্ষণেই যদিও দেবী মুখ ঢাকলেন, কিন্তু ওই ক্ষণিকের দৃশ্যে যা পেলাম তা যথেষ্ট। অন্নপূর্ণা দক্ষিণে কিন্তু তখনও চলছে রংবদলের খেলা। লাল-গেরুয়া-হলুদ-সাদা। অবাক বিস্ময়ে শুধু তাকিয়েই রয়েছি। আশ আর মেটে না।

ছবি: ফিরে আসার পথে

একটুক্ষণ পরে অন্নপূর্নাও মেঘের রাজ্যে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হলেন। কি তাঁর উদ্ধত রূপ। এক দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না, চোখ ঝলসে যায় ! পার্বতীর অন্য এক রূপ অন্নপূর্ণা দেবী। অন্ন কথার অর্থ ধান, আর পূর্ণা-র অর্থ হল পূর্ণ। অর্থাত্‍ যিনি অন্নদাত্রী। দুই হাত পেতে ধান দিয়ে পূর্ন করলে যেরকম আকার হয়, এই পর্বতের আকারও ঠিক সেইরকম। শুধু নাম বা আকারই নয় এই পর্বতের জন্যই এই অংশের সমস্ত মানুষের পেটে অন্ন জোটে। বরফগলা জলে পুষ্ট নদী, ঘন জঙ্গল, পশুপাখি, চাষাবাদের জমি সবই তো তাঁরই দান। সত্যি দেবী অন্নপূর্ণা সর্বগুনে সম্পূর্ণা। সৌভাগ্য আমাদের তাঁর আশ্রয়ে কটাদিন কাটাতে পেরেছি। বুঝেছি তাঁর মহিমা (সত্যি কি বুঝেছি ? কি জানি!) গুনগান গাইব এত ক্ষমতা আমার নেই কিন্তু দেবীবন্দনা হিসেবে অর্ণবের (Arnab Acharya) লেখা এই কবিতাটা না বললেই নয় :
অরুন-প্রভাতী ,বিজয় তিলক মুখরিত দিন-রাত্রি
অনন্ত এই লীলার মাঝে ক্ষনিকের সহযাত্রী,
বিরাটের এই আনন্দ-যজ্ঞে অনাহুতই এলাম
“তোমার পায়ের পাতা , সবখানে পাতা কোনখানে রাখিব প্রণাম”

ছবি: শেষ দেখা

এরপর আর কি। সকাল আটটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে……………..না থাক, আর বকবক করতে ইচ্ছে করছে না। মন খারাপের কথাগুলো আর নাই বা বললাম। এবার তো ফেরার পালা। যে রাস্তা ধরে এসেছি, সেই রাস্তা ধরেই নেমে গেছি। উঠেছিলাম তিন দিনে, নেমেছি দুই দিনে। সেই একই আহা কি দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না মার্কা উপমা গুলো আর আমায় পাচ্ছে না। আসলে সত্যি বলতে কি এই অবর্ণনীয়কে বর্ণনা করতে গিয়ে আমার লেখার ভাষা ও শক্তি দুইই প্রায় নিঃশেষ। গল্পতো অনেক বললাম, এবার নাহয় একটু বাকিদের গল্প শুনি। এই ভালোলাগাটুকুর আবেশ নিয়ে চলতে থাকুক আমার জাবরকাটা। দৈনন্দিন জীবনের থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়ে যখন আবার বোর হয়ে যাবো, তখন নাহয় আবার বেরিয়ে পড়ব এমনি কোনো অন্নপূর্ণার কোলে অভিজ্ঞতার ঝাঁপি পূরণ করার আশায়। চাঁদনী রাতে অন্য কোনো তুষারশুভ্র হিমমুকুটকে দেখে বলে উঠব —–
” ভুলবো কি করে পাহাড়ের এই উপহার
এর টানেই তো ফিরবো আমি বারবার !!! “

(সমাপ্ত)

• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ১)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৩)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৫)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৬)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৭)

লেখকঃ অবকাশ অধিকারী। পেশায় প্রকৌশলী, ঝাড়খণ্ডের মাইথনে নিবাস। নেশা ট্রেকিং করা। বছরে অন্তত দু/তিন বার বেরিয়ে পড়েন হিমালায়ের উদ্দেশ্যে।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণেঅনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৭)
মেঘের দেশ সাজেকমেঘের দেশ সাজেক

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণেঅনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৭)
মেঘের দেশ সাজেকমেঘের দেশ সাজেক

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণেঅনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৭)
মেঘের দেশ সাজেকমেঘের দেশ সাজেক

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!