ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি, কালিম্পং হয়ে যখন লাভা বাজারে পৌঁছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কিন্তু সারাদিন ধরে ঝরে পড়া বৃষ্টি, মেঘে-মেঘে ঢেকে থাকা আকাশ আর পুরো ন্যাওরাভ্যালী অরণ্যে জেঁকে বসা কুয়াশা দেখে মনে হল যেন সন্ধ্যা হয়ে গেছে! হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেম যে না সন্ধ্যা না এখন বিকেল মাত্র, কারণ তখন ঘড়িতে চারটা বাজে মাত্র!

জীপ থেকে নেমেই কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট ইট-পাথরের বাড়িগুলোতে ঢুঁ মারতে থাকলাম সেদিন রাতের ঠিকানা খুঁজে পেতে, তাও যতটা সম্ভব কম খরচে। কিন্তু অনেক অনেক এমন লজ থাকা সত্ত্বেও কোথাও থাকার তেমন যায়গা খুঁজে পেলামনা টুরিস্ট মৌসুম না হবার কারণে। এই সময় এই অঞ্চলে সাধারণত কেউ বেড়াতে আসেনা। তাই সবাই তাদের টুরিস্টদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরগুলো অন্য কাজে লাগিয়ে রেখেছে তাই খালি বা টুরিস্টদের দেবার মত কোন পরিচ্ছন্ন বা উপযোগী ঘর কেউ দিতে পারলোনা। আর খাবার হোটেল তো নেই-ই!

অপার্থিবতা যেন নেমে এসেছিল এই পার্থিবতায়। ছবিঃ সংগৃহীত

তাহলে এখন কি হবে? থাকবো কোথায় আর খাব কি? সেই চিন্তায় বেশ খানিকটা হতাশ হয়ে ভেজা রাস্তার এক পাশেই বসে পড়লাম। সব সময়ের জন্য ব্যাগে রাখা নিরাপত্তা সরঞ্জাম থেকে বের করলাম কেক আর কোক। এই দিয়েই আপাতত পেট ঠাণ্ডা করি তারপর কোন না কোন উপায় খুঁজে বের করবোই ইনশাল্লাহ। বেশ সময় নিয়ে আর আয়েশ করে কেক আর কোক দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ শেষ করে আবার থাকার যায়গা খুঁজে বের করতে হাঁটতে শুরু করলাম।

এবার লাভা বাজার থেকে একটু নিচে নেমে যেতে শুরু করলাম। একটু সামনে এগিয়ে কয়েকটি যায়গায় খুঁজতেই একজন নিজে এসে রুম চাই কিনা জানতে চাইলেন! বাহ বেশ তো, তাকে বলাতে সে কাঠের দোতালায় একটি রুম দেখালো। সাথে বেশ বড় বাথরুম, গরম পানি, টিভি (অচল ছিল), জানালা দিয়ে পাহাড়ের সারি দেখা যায় এমন একটি রুম দেখালেন। আমি তো মনে মনে মহা খুশি যাক থাকার যায়গা পাওয়া যাবে বা গেছে। আর একটু শঙ্কিতও এই ভেবে যে ভাড়া না যেন কত নেয় কে জানে?

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ৬০০ টাকা ভাড়া চাইলো। আমি তো মনে মনে খুশি। তবুও বাঙালির স্বভাবগত দরদাম তো একটু করতেই হয়, নইলে মান থাকেনা দেখে ৪০০ তে রফা করলাম আর কেয়ারটেকারকে ৫০ দিয়ে মোট ৪৫০ টাকায় বেশ ভালো একটু রুম নিয়ে নিলাম। এরপর উষ্ণ পানিতে একটা আরামদায়ক গোসল আর হালকা বিশ্রাম নিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে বাইরে বের হলাম। টিপটিপ বৃষ্টিটা তখনো পড়ছে। কিন্তু এমন মোহময় পাহাড়ি বিকেল, ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আমাকে রুমে আটকে রাখবে সেই সাধ্য কার আছে? তাই বেরিয়ে পরলাম ওই বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই।

লাভার আঁকা বাকা পথ ধরে হেঁটে বেড়ানো। ছবিঃ সংগৃহীত

দুই পাশের পাহাড়ি ঘরবাড়ি গুলোকে পাশ কাটিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছি। একটু নেমে যেতেই চোখে পড়ল লাভার বর্ণিল মনেসট্রি। গেট খোলাই ছিল তাই কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়লাম। গেটেই পেয়ে গেলাম স্থানীয় একটি ছেলেকে যে শিলিগুড়িতে পড়াশুনা করে, কলেজ বন্ধ থাকায় বেড়াতে এসেছে। ওর সাথে ঘুরে ঘুরে দেখলাম লাভার দৃষ্টি নন্দন মনেসট্রি, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অপূর্ব কারুকাজের স্থাপনা, ছাত্রদের থাকা, পড়া, খাওয়ার আলাদা, আলাদা জায়গা।

লাভা মনেসট্রি। ছবিঃ সংগৃহীত

এরপর সেই বৃষ্টির মাঝেই হেঁটে হেঁটে রওনা হলাম লাভার মনেসট্রির চূড়ায় উঠতে পিচ ঢালা আর পিচ্ছিল রাস্তা ধরে। অপূর্ব একটি রাস্তা পাহাড়ের পিঠ কেটে বানানো হয়েছে। দূরে পাহাড়ের সিঁড়ি দাড়িয়ে আছে স্তরে স্তরে। ছেলেটি জানালো আকাশ মেঘলা না থাকলে ওখান থেকেই দেখা যায় দূরের বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা! সেখান থেকে দূরে দেখা যাচ্ছিল, আমাদের জন্য ভীষণ কাঙ্ক্ষিত আর দুর্লভ সিকিমের পাহাড়, গ্রাম, রাস্তা, ছোট ছোট গাড়ির ছুটে চলা, ছোট-মাঝারি আর বড় বড় সব পাহাড়ের সারি দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়ের সাথে বন্ধু হয়ে। হেঁটে যাচ্ছিলাম, আর দূর থেকে সেইসব পাহাড় শ্রেণী দেখে মনের আক্ষেপে পুড়ছিলাম। কেন যে যেতে দেয়না আমাদের সেই বেদনায়। সেই অপূর্ণতাকে নিমিষেই পূর্ণতা দিয়েছিল, লাভা মনেসট্রির পাহাড় চূড়া, ঝুম বৃষ্টি, কফি আর অনেক দিনের লালিত একটা ছোট্ট কিন্তু দুর্লভ স্বপ্ন। কিভাবে?

প্রায় ১০/১৫ মিনিট হেটে পৌঁছে গেলাম মনেসট্রির চূড়ায়। যেখানে আমাকে অভিভূত করেছিল একটি কফিশপ! ভাবতেই পারিনি এখানে, লাভার এই প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামের এই পাহাড় চূড়ায়, দেখা মিলবে কোন কফিশপের, আর সেখানে পাওয়া যাবে ধোঁয়া ওঠা, চনমনে উষ্ণ কফি! আহ, আমাকে আর পায় কে? কতদিনের মনে মনে লালিত খুদ্র কিন্তু ভীষণ দুর্লভ একটা স্বপ্ন এভাবে হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিয়েছে বলে।

স্বপ্নটা এমন ছিল… একদিন কোন এক পাহাড়ের কোন চূড়ায় বসে, ঝুমঝুম বৃষ্টি দেখবো, বৃষ্টির পানিতে হাত ছোঁয়াবো, একটি ছাতা মাথায় নিয়ে সেই পাহাড়ের চূড়ায় বসে ঝুম বৃষ্টির সাথে, হাতে নেব ধোঁয়া ওঠা গরম কফির উষ্ণ মগ, আর ঠোঁটে ছোঁয়াবো গরম কফির মাদকতাময় স্বাদ! ঠিক সেই অপার্থিবতা যেন নেমে এসেছিল এই পার্থিবতায়, যখন হাতে নিয়েছিলাম একমগ ধোঁয়া ওঠা উষ্ণ কফি, মাথায় রেখেছিলাম ছাতা আর লাভার পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটে বেড়িয়েছিলাম ঝুমঝুম বৃষ্টিতে! আহ সেই মুহূর্তটুকু যেন আমার কাছে এক টুকরো স্বর্গ ছিল এই বাস্তবতার পৃথিবীতে! আর মনে মনে কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম বিধাতার কাছে, এই জন্মের কাছে, পৃথিবী, পাহাড়, বৃষ্টি আর এমন বর্ণিল আর নান্দনিক একটা জীবনের কাছে। জীবনটা সত্যি সুন্দর, ভীষণ উপভোগের আর দারুণ আশীর্বাদের যদি চাওয়া-পাওয়া হয় অল্প আর আনন্দ খুঁজে নিতে পারি যে কিছুতেই।

লাভা। ছবিঃ সংগৃহীত

লাভাঃ দার্জিলিং জেলার একটি প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম বা ছোট্ট শহর। যেতে হয় ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি হয়ে প্রথমে কালিম্পং তারপর সেখান থেকে লাভা। শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি রিজার্ভ জীপে করেও যাওয়া যায়, যদি দলটা একটু ভারী হয়, মানে ৪/৬/৮ জনের গ্রুপ হলে খরচটা কমে যাবে।

লিখেছেনঃ সজল জাহিদ। বেঁচে থাকার জন্য চাকুরী, জীবনকে উপভোগের জন্য ভ্রমণ, ভালবাসেন লিখতে— এই সব কিছু মিলেই সজল জাহিদ।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায়মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায়
সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (পর্ব ২)

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায়মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায়
সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (পর্ব ২)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায়মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায়
সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (পর্ব ২)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!