চলেছি সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় । কারিখোলার হিলটপ গেস্টহাউসে রাত্রীযাপন।এই প্রসঙেগ বলা যায় নেপালের এই পথে ৫১০০মিটার উচ্চতার গোরকশেপেও সাধ্যের মধ্যেই রাতের আস্তানা পাওয়া সম্ভব। এই ট্রেকে নামচের আগের দুদিন থাকার জন্য দিতে হয়েছে জনপ্রতি মাত্র ৫০ নেপালি রুপি। নামচে থেকে গোকিও হয়ে লবুচের ক্ষেত্রে ১০০ নেপালি রুপি। গোরকশেপে একটু দরাদরি করে ১৫০ নেপালি রুপিতেই ভালো ঘর পাওয়া গিয়েছিলো। তবে এখানে থাকার শর্ত একটাই রাতের খাবার সংশ্লিষ্ট লজ বা গেস্টহাউস থেকেই খেতে হবে। সাধারণ ডালভাত, এগ কারী বা চিকেন কারী রাইস ইত্যাদির মূল্য ৩০০ থেকে ৮০০ নেপালি রুপির মধ্যেই ছিলো। তবে পকেটের মানিব্যাগটায় আপনার বেহিসাবি টাকা থাকলে এই রুটে আপনি চাইনিজ, ইটালিয়ান, মাঞ্চুরিয়ান যা ইচ্ছে খেতে পারেন। পুরো রুটেই আপনি অর্থ খরচ করে ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে বাইরের জগতের সাথে ইচ্ছেমত যোগাযোগও রাখতে পারেন। তবে আমার এনসেলের নেপালী সিমের নেটওয়ার্ক সর্বশেষ সুরখেতেই সাথে ছিলো। বাজেট স্বল্প থাকায় নামচে থেকে জোংলা অব্দি আমার বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ ছিলোনা। এছাড়াও আমরা ব্যাগ ভরে শুকনো খাবার নিয়েই ট্রেক শুরু করেছিলাম। নৈশাহার ছাড়া ওই সকালে ১০০-১৫০ নেপালি রুপি দিয়ে এক কাপ চা/দুধ এটাই শুধু ছিলো আমাদের কেনার লিস্টে।
কারিখোলায় রাতে খাওয়ার সময় দেখা হল দুজন ফান্সের যুবক যুবতীর সাথে। তারা স্থানীয় স্কুলে দুমাস শিক্ষকতার কাজ শেষ করে পরের দিন আমাদের ট্রেকিং পথেই লুকলা হয়ে দেশে ফিরে যাবেন। সকালে মনেস্ট্রির মন্ত্রের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। ফ্রেশ হয়েই ঘুরে বেড়ালাম মনেস্ট্রি চত্বরে। কিন্তু আজ অনেকটা হেঁটে তবেই মঞ্জো পৌঁছবো এই আশায় সাত সকালেই তৈরী হয়ে গেলাম। খাওয়া ও থাকার বিল ভারতীয় ১০০ টাকার নোটে দেওয়ায় মাত্র ৭০০ টাকাতেই হয়ে গেলো। গেস্টহাউসের দিদিও হাসিমুখেই ভারতীয় টাকা নিলেন সাথে এটাও বলে দিলেন যে চাইলে আমরা নামচেতেও টাকা একচেঞ্জ করে নিতে পারি। বিদায় জানালাম ফ্রান্সের দুজনকেও। তারা আজ একটু বেলাতে ট্রেক শুরু করে সুরখে অব্দি যাবে শুনে সাহস পেলাম এই ভেবে যে আমরা তাহলে নিশ্চই আজ মঞ্জো পৌঁছে যাবো।
প্রথমেই উৎরাই। নেপালে ট্রেকিং করার ক্ষেত্রে এটাই একটা বড় সমস্যা একেবারে নীচে নামিয়ে আবার অনেকটা চড়াই করতে হয়। নীচে একেবারে নদীর বুকে নামিয়ে তারপর শুরু বুপসার পথে দমফাটা চড়াই। কিছু বিদেশী ট্রেকাররাও চলছে এই পথে। অনেকে গাইড পোর্টার নিয়ে। অনেকে আবার আমাদের মত একেবারে নিজের ভরসায়। বুপসার পথেই একটি ট্রেকিং রুট চলে গিয়েছে সেই বিখ্যাত ও উচ্চতম ট্রেকিং পিক ” মীরা পিক ” এর বেসের দিকে। বুপসায় পৌঁছেই স্থানীয়দের কাছে জানতে পারা গেলো আমাদের অনুমান ভুল। কারিখোলা থেকে মঞ্জো প্রায় দুদিনের পথ। ব্যক্তিগতভাবে আমারও তাই জানা ছিলো। কিন্তু আমার সাথী দাদা “লোনলী প্লেনেটের” একটা ট্রেকিং বই পড়ে ওভার কনফিডেন্ট ছিলো পৌঁছানোর ব্যাপারে। কিন্তু পরে আমি রাতে সুরখেতে বইটা ভালোভাবে খুটিয়ে পড়ে বুঝতে পারি ওখানে দেওয়া সময়গুলো “ওইথআউট স্টপেজ টাইম ” দিয়ে লিখা। জানতে পেরে দাদাকে হাসতে হাসতে বলি বইয়ের লেখক ট্রেকারদের কি ঘোড়া ভেবেছেন!
বুপসার পর শুরু হল বরফ বৃষ্টি। ঠান্ডায় হাত প্রায় অবশ হওয়ার জোগাড়। একটা পাথরের নীচে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই হল। স্থানীয়রা সেই বৃষ্টিতেই রাস্তা নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের কাছেই শোনা গেলো অদূর ভবিষ্যৎকালে সুরখে অব্দি যানবাহন চালানোর পরিকল্পনা নিয়েছে নেপাল সরকার। পথে সাশপেনশান ব্রিজগুলোর ওপর দিয়ে হাঁটতে ভাবছিলাম কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগে এই ব্রিজগুলোর ক্ষতি হলে নেপালের কোন পরিকাঠামোই নেই স্থানীয়দের Evacuate করার, রসদও পৌঁছবে ওই পোর্টারদের কাঁধে চেপে, কারণ নিশ্চয়ই সেই সংখ্যক হেলিকাপ্টার নেপাল সরকারের নেই। কিন্তু মঞ্জো থেকে মাথার ওপর মিনিটে মিনিটে আকাশযান দেখে পরে নিজের এই মতবাদের ওপর নিজেরই সন্দেহ হয়েছিলো। পাহাড়ের মাথা থেকেই নদীর পাশের ভ্যালীতে সুরখে গ্রামটাকে দেখা যাচ্ছিলো, ব্রিজের ওপাশেই আবার বিশাল চড়াই। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল আজকের রাত সুরখেতেই রাত্রিবাস।
সকালেই দৃশ্যমান গিরিরাজের অসংখ্য শৃঙগ। ঠান্ডাও যথেষ্টই। এখানের টয়লেটাও দারুণ।সম্পূর্ন ইকোফ্রেন্ডলি। জলের অভাবে রেচন পদার্থ ঢাকতে শুকনো পাতার ব্যবহার প্রচলিত। কিন্তু মানুষ অভ্যাসের দাস হওয়ায় আমি চেয়ে চিন্তে বরফজলটাকেই ব্যবহার করতে হল। আমাদের সাথে একটা ছোট স্টোভ ও কিছু ফুয়েল ট্যাবলেট ছিলো, বয়ে নিয়ে আসা ৯টা ডিমের ৪টা ফেটে যাওয়ায়, সেই ডিমগুলোর সাথে দুপ্যাকেট ওয়াই ওয়াই মিশিয়ে নিজেরাই ব্রেকফাস্ট তৈরী করে বিল মিটিয়ে সকাল ৭টায় ট্রেকিং শুরু করা হল।
একে একে হেঁটে চেপলুং হয়ে চৌড়িখারকা পার হয়ে ফাকদিং এর পথে হাঁটা। শুধুই চড়াই। এখান থেকেই একটি রাস্তা চলে গিয়েছে লুকলার পথে। আমরা চলছি মঞ্জো হয়ে নামচে বাজার। কিছুক্ষণের মধ্যেই লুকলার-নামচে বাজার মেইন ট্রেইলটার রাস্তায় চলে আসায় ট্রেকার ও ইয়াকের সংখ্যা বাড়তেই লাগলো। সাশপেনশান ব্রিজগুলোয় রীতিমত মানুষের ট্রাফিকজ্যাম। পৌঁছে গেলাম মঞ্জো, সাগরমাথা ন্যাশনাল পার্কের এন্ট্রি পয়েন্ট।
এই প্রসঙেগ বলে রাখি অনেক বাঙালী বড় বড় ট্রেকার কিন্তু তাদের মন পাহাড়ের মত বিশাল কোনদিনই হতে পারেনি। একটু অচেনা রুটে ট্রেক করা এরকম কোন ট্রেকারের কাছে ওই রুট সমন্ধে জানতে চাইলে অনেকের ভাব এমন যেনো ওই রুটটা তার কেনা হয়ে গিয়েছে। কোন তথ্যই শেয়ার করতে অনিচ্ছুক তারা। এই রুটের ক্ষেত্রেও দুএকজনের কাছে জানতে চাইলে তারা পুরো ভুলভাল তথ্য আমাকে দিয়েছিলো। যেমন পারমিশান কাঠমান্ডু থেকে নিতেই হবে, টাইমস কার্ড লাগবেই, গাইড আবশ্যক না হলে ঢুকতেই দেবেনা ইত্যাদি। মঞ্জো পৌঁছে দেখলাম পারমিশান নেওয়া জাস্ট মিনিট দশের কাজ। নাম ঠিকানা লিখিয়ে, জনপ্রতি ভারতীয় ১১০০ টাকা দিয়েই পারমিশানের কাগজ পেয়ে গেলাম। আমি মোটামুটি নেপালী ভাষা বলতে পারায় যিনি পারমিশান দিলেন তিনি আমার সাথে রীতিমত নেপালের রাজনীতি নিয়ে গল্প জুড়ে দিলেন। সাথে এটাও বললেন ভারতের সাথে নেপালের বর্তমানের টালমাটাল অবস্থা যদি ঠিকঠাক হয়ে যায় তাহলে বন্ধু রাস্ট্র হিসেবে এই ফি আরও কমিয়ে দিতে পারে নেপাল সরকার। তবে যেই বিদেশীরা কাঠমান্ডু থেকে পারমিশান নিয়ে এসেছিলো তাদের এখানে আলাদা কোন পারমিশানের দরকার পড়েনি।
মঞ্জোর পরেই যেন গ্রাম্য চেহারা পরিবর্তন এই এলাকাগুলোর। বিশাল বিশাল লজ, গেস্টহাউস, রেস্তোরাঁ। চারিদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ট্রেকারের দল। এরা লুকলায় নেমে প্রথমদিন মঞ্জো বা জোরশেলেতেই রাত্রিবাস করে। কিন্তু আমরা এগিয়ে গেলাম। পথে দেখতে পেলাম একদল ইয়োলো মার্টেনের সাথে। এদিকে প্রায় বিকেল শেষের দিকে। অনেক ওপরে দুটো সাশপেনশান ব্রিজ। রাস্তায় স্থানীয় একজন ভুল তথ্য দিয়ে বলেছিলেন যে ওই ব্রিজ পার হয়েও নামচের আগে তোপদাড়াতে থাকার জন্য লজ আছে কিন্তু পরে জানতে পারি যে নামচে বাজার ছাড়া তোপদাড়াতে একটা টয়লেট ছাড়া মাঝে থাকার জায়গা নেই। এই পথেই দেখতে পেলাম একাকী একটা হিলালয়ান থারকে। ব্রিজেই দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি যখন এই ব্রিজগুলো ছিলোনা অর্থাৎ প্রথম সফল এভারেস্ট অভিযানে তেনজিং-হিলারির দল ঠিক কতটা পরিশ্রম করে তখনকার শেষ জনবসতি নামচে বাজারে পৌঁছেছিলেন!
তোপদাড়াতে পৌঁছালাম যখন প্রায় অন্ধকার। দেবরাজদার অবস্থা খারাপ। চড়াই ভাঙগার সামান্য শক্তিও শরীরে নেই যেনো তার। কিন্তু আমি তখনও ঠিকঠাক। শেষে স্থানীয় একজন পোর্টার যিনি নামচে যাচ্ছিলেন তিনি ভারতীয় ১০০ টাকার বিনিময়ে তার রুকস্যাক নামচে অব্দি নিয়ে যেতে রাজী হলে প্রায় রাত ৭টার দিকে আমরা নামচে বাজার পৌছে গেলাম। ক্লান্ত থাকায় সেখানে আর বেশী খোঁজাখুঁজি না করে একটা বড়সড় গেস্টহাউসে উঠলাম। চারিদিকে বিদেশী আর আমরা সস্তার ভারতীয়। তাই ব্যবহার একটু খারাপটাই জুটলো।
চলবে…
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (১ম পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৩য় পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৪র্থ পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৫ম পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৬ষ্ট পর্ব)
লিখেছেন তাপস কুমার রায়। স্বাস্থ্যদপ্তরে এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন। নেশা- ক্রিকেট, ট্রেকিং, ইতিহাস ও একটু আলাদা টাইপ অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ আর সাপ।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
