সময়টা ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস। বাংলাদেশে বাতাসে শীতের আনাগোনা। অসহ্য গনগনে গরমের দিনগুলো পেরিয়ে প্রকৃতি একটু ঠান্ডা হচ্ছে প্রতিদিন। এমন একটা সন্ধ্যায় মুহূর্তের সিদ্ধান্তে রাতের বাসে উঠে বসলাম। উদ্দেশ্য নির্জন কোন বালুকাবেলায় সুপারমুন উপভোগ।পরদিন ভোরে গন্তব্যে পৌঁছে একটু বিশ্রাম করে হ্যামকটা সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি একটা ঝাউবনে। দুটো ঝাউগাছে হ্যামকটা বেঁধে আয়েশ করে যখন শরীরটা এলিয়ে দিলাম, পায়ের কাছাকাছি তখন আছড়ে পড়ছে সুবিশাল ঢেউ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ঢেউ, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের ঢেউ।
কক্সবাজার বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য। বছর জুড়েই সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এখানে ভীড় জমায় সুবিশাল সমুদ্রে অবগাহন করতে। এখানকার দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র, অনন্ত নীল আকাশ, আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘের অবিরাম ছুটোছুটি, দীর্ঘতম সমুদ্রতট, সোনালী সূর্যের আলোকছটা, ছন্দময় ঢেউ এর নাচানাচি, অস্তগামী অরুণের রক্তিম কিরণাভায় সজ্জিত গোধূলীবেলা সবই যেন মোহিত করে রাখে সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষদের। এই অবারিত সমুদ্রতটে বসে অগণিত ঢেউ গুনে পার করে দেওয়া যায় সারা বেলা। পায়ের কাছে ফিরে ফিরে আসা ঢেউয়ের খেলা ভুলিয়ে দেবে আপনাকে নাগরিক জীবনের সব ক্লান্তি। সমুদ্র মহার্ঘ। এ যেন ধরা দেবার নয়, একে ধারণ করতে হলে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে এর বুকের মাঝে। বিশাল বিপুল জলরাশির সামনে দাঁড়িয়ে টের পাই নিজের অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতা। নিজেকে বিলিয়ে দিতে গিয়ে নিজেও যেন হয়ে যাই সমুদ্রের একটা অংশ। সমুদ্রের সেই বিশালতাকে নিজের ভেতরে ধারণের প্রচন্ড চেস্টার টানাপোড়েন চলতেই থাকে সারাক্ষণ।
সারাটা রাত বীচেই কাটাবো ভেবে দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। পুরো রাত জোছনা বিলাসের সকল প্রস্তুতি নিয়ে বিকেলের মাঝেই চলে গেলাম বীচে কারণ কক্সবাজারের বিখ্যাত সূর্যাস্ত কি আর মিস করা যায়! শাড়ীতে যথার্থ বাঙালী রমণী হয়ে সূর্যকে সাক্ষী রেখে পার হলো কিছু ছবি তোলার মুহূর্ত। এরপর অপেক্ষাকৃত নির্জন একটা বালুকা বেলায় বসে চেয়ে রইলাম অস্তগামী সূর্যের পানে। কিছু অসাধারণ মুহূর্ত কাটলো সাদা মেঘ আর লাল সূর্যের লুকোচুরির মাঝে। লজ্জা রাঙা সূর্য ক্ষণে ক্ষণে মুখ লুকাতে চাইছে মেঘের আড়ালে আর দুস্টু মেঘ পরক্ষণেই সরে গিয়ে সমস্ত আড়াল কেড়ে নিতে চাইছে লাজুক সূর্যটার। সূর্যাস্তের সময়টুকু এতটাই ছোট যেন নিমিষেই শেষ হয়ে যায় আর সেই শেষ মুহূর্তগুলোয় আমার মাথায় বাজতে থাকে আমার প্রিয় সুর “গোধূলী গগণে মেঘে ঢেকেছিল তারা, আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল হারা….. আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে, জনমের মত হায় হয়ে গেল হারা..” সত্যিইতো আর কি কখনো কবে এমন সন্ধ্যা হবে!!! অস্ত যাওয়া সূর্যের রক্তিম আভায় অবগাহন করতে করতে হাহাকার বেজে ওঠে বুকে… জনমের মত হায় হয়ে গেল হারা। এই হাহাকার নিশ্চুপ নিস্তব্ধ করে দেয়। বাকহারা আমি বোকার মত চেয়ে রই কালচে হয়ে যাওয়া আকাশের গায়ে একটু খানি লালচে আভার আশায়।
গোধূলীর আলো আধারিতে অভিমান মাখা মুখটা ফিরিয়ে যখন পিছন ফিরে তাকিয়েই দেখি আমার অভিমান ভাঙাতেই যেন ঝাউবনের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে বিশাল এক চাঁদ। হঠাৎ করেই যেন সংবিৎ ফিরে পেলাম। মনে পড়লো আজতো সুপারমুন! এই বিশাল চাঁদটা দেখতেইতো একছুটে এখানে চলে আসা! ঝাউবনের মাথা ছাড়িয়ে সুপারমুন তার চেহারা দেখবে সমুদ্রের জলে সেই প্রতিক্ষায় বসে রইলাম সমুদ্রের ধারে। সারারাত এই সুপারমুন উপভোগ করার জন্য বীচে একটা আরামদায়ক, নিরাপদ জায়গা খুঁজছিলাম। সেই ব্যবস্থাও হয়ে গেল সফরসঙ্গী ছোটভাই ইমনের বন্ধুর কল্যাণে। ইমনের বন্ধু তন্ময় চাকুরি করেন বিখ্যাত হোটেল সি-গালে। তারই সহযোগিতায় সি-গালের নিজস্ব বীচে তিনটা কট দখল নিয়ে নিলাম আমরা তিনজন পুরো রাতের জন্য। পর্যাপ্ত পরিমাণ হাবিজাবি স্ন্যাকস আর পানীয় সাথে নিয়ে শুরু হল আড্ডা। সেই আড্ডায় গল্পের যেন কোন আগামাথা নেই। কথার ফুলঝুড়ি কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে কোন খেয়াল রাখা যাচ্ছেনা। যেন সুপারমুনের আলোয় আমরা মাতাল কজন ছুটিয়ে চলেছি কথার রেলগাড়ী….
বরাবরের মতই এই রকম জনারণ্যে, এই রকম তুমুল আড্ডায় আমার খুব একা লাগতে থাকে। চাঁদের আলোয় উচ্ছসিত মুখগুলোর দিকে আমি এক এক করে তাকাই অথচ তাদের কলকাকলী কিছুই আমি শুনতে পাইনা, সেখানে বসে থেকেও আমার মন চলে যায় অন্য কোথাও। মাথার ভিতরে যেন দিগন্তজোড়া মাঠ যেখানে রাখালিয়া সুরের মায়া। চিন্তার স্রোত যেন ভাসতে থাকে দূরে কোথায়, দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে…… আমি চুপচাপ সরে আসি আড্ডা থেকে। মোহগ্রস্তের মত ছিন্ন ভিন্ন একটা মন নিয়ে বসে থাকি যেন অনন্তকাল। সুপারমুনের তীব্র আলোর সাথে সাথে আমি এক অদ্ভুত বিষন্নতায় ভাসতে থাকি। বুকের ভেতরটা জুড়ে বাজতে থাকতে এক তীব্র হাহাকার মেশানো কান্না। প্রকৃতির এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্য বরাবরই এক তুচ্ছতার বোধ এনে দেয় আমাকে।
সুপারমুনের মাতাল করা আলোতে হতবাক আমি আধশোয়া হয়ে বসে রইলাম আমার নিজের কটে। কানে আবছামত ভেসে আসছিল সঙ্গীসাথীদের আনন্দিত কন্ঠের উচ্ছাস কিন্তু সেসব ছাপিয়েও আমার মাথায় বাজছিল অন্য কোন সুর। অনেক চেনা তাও যেন অচেনার অনুরননে ছোঁয়া নতুন কোন সুর। যে সুরে ভুলে যাই নিজের অস্তিত্ব, যে সুর ভুলিয়ে দেয় সময়ের হিসাব, যে সুর প্রকৃতির মাঝে ক্ষুদ্র বিষন্ন এই আমার হারিয়ে যাওয়া তীব্র আহবান।
বিশাল বড় চাঁদটা যখন মাথার উপরে চলে এলো সেটার তীব্র আলোয় মনে হল সাথে প্রিয় একটা বই থাকলে মন্দ হতোনা। চারিদিকে মাতাল হাওয়া, সমুদ্রের গর্জন, মাথার ভেতরে অচেনা বিষন্ন সুর সাথে একটা প্রিয় বই… এরচেয়ে বেশী কিছু চাইবার আর কি থাকতে পারে এমন জোছনাপ্লাবিত প্রান্তরে।
একটা সময় চাঁদ নেমে এলো সমুদ্রের উপরে, একেবারে আমাদের মুখোমুখি। সমুদ্রের জলে প্রতিফলিত আলো যেন সহস্রগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে চাঁদের আলোর তীব্রতা। সেই তীব্র আলোয় ভেসে যেতে লাগল বিশ্ব চরাচর। মনে হল নিঃস্ব পায়ে নেমে যাই কট থেকে, সোজা হেঁটে চলে যাই সমুদ্রের বুকে যেখানে চাঁদের আলো আর বাঁধ ভাঙা ঢেউ মিলেমিশে তৈরী করেছে এক অদ্ভুত মায়া। মনে হল নিজেকে প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দেবার জন্য এরচেয়ে ভালো মুহূর্ত আর হয়না।
কট থেকে নেমে গেলাম মোহগ্রস্তের মত। সোজা হেঁটে চললাম সমুদ্রের দিকে। ঢেউয়ের গর্জন যেন হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালার সুর, কারো ক্ষমতা নেই একে উপেক্ষা করার। নিজেকে উৎসর্গ করতেই যেন নতজানু হয়ে বসে পড়লাম এই বিপুলা জলধির সামনে। মাতাল বাতাসে উড়ছিল চূর্ণ চুল। ঢেউগুলো যেন কাছে আসতে গিয়েও বারবার ফিরে ফিরে যাচ্ছিল দ্বিধাগ্রস্থ কোন দেবশিশুর মত। হঠাৎ মনে হল, নাহ এতটুকুতে শান্ত হবে না মন… এলোমেলো চুল উড়িয়ে হালকা পায়ে এগিয়ে চললাম ঢেউগুলো যেখানে কুল ভাঙছে সেখানটায়। সুপারমুনের তীব্রতায় তরলিত আলোয় উচ্ছল ঢেউয়ের সাথে মিলেমিশে একাকার হতে পারলেই হয়ত শান্তি। জলে নামতেই এক লহমায় যেন আমার ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে সমুদ্র। সারা অস্তিত্ব জুড়ে যেন বয়ে চলছে উত্তাল সাগর। এ যেন সমুদ্র নয়! এ যেন আলোর প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী। মধ্যরাতের সেই চরাচরে এ যেন নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার নেশায় অবগাহনরত আমি একা এক মানবী।
ঘোরলাগা অবস্থাতেই ফিরে এলাম নিজের কটে। সঙ্গীরা যে যার মত আড্ডা বা নিজের সাথে ব্যস্ত। আমি শুধু গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম জোছনার তীব্র আলো। এক সময় আমারই মতন বাধনহারা চাঁদটা নেমে এল পশ্চিমাকাশে তারপর পুরো পৃথিবীটাকে চন্দ্রাহত করে রেখে ধীরে ধীরে মিলিয়েও গেল দিগন্তে। শুধু যেন আমিই তার ব্যতিক্রম। অস্তাচলে হারিয়ে যাওয়া চাঁদ নিজেকে বিলিন করে যেন আমায় পূর্ণ করে রেখে গেল অসীম আনন্দ আর উচ্ছাসে। আমার যত বিষন্নতা, দুঃখবোধ আর হাহাকারকে নতুন আলোয় আলোকিত করে বাকীটা জীবন আরো তীব্রভাবে বাঁচতে শেখার প্রয়াশ যোগাতেই যেন তার এই আসা যাওয়া। প্রকৃতির সামনে অতি ক্ষুদ্র, অতি তুচ্ছ আমি তুচ্ছতা পরিহার করে জীবনটাকে আরো আরো বেশী অর্থবহ করার কঠিন প্রতিজ্ঞা করে ফিরে এলাম কংক্রিটের জঙ্গলে।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

1st time apnar likha porlam. Ato sundor liken apni… Valo laglo apnar likha.Thanks ☺️
অনেক ধন্যবাদ এভাবে উৎসাহিত করার জন্য।