গন্তব্য মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায়। রাত পৌনে দুইটা। ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে ট্যুর কোম্পানীর পাঠানো গাড়িতে করে বেড়িয়ে পড়লাম। ট্যুর কোম্পানীর অফিসে পৌঁছে কলা রুটি আর চা দিয়ে নাস্তা সেরে আবারো যাত্রা শুরু। গন্তব্য মাউন্ট বাটুরের বেস। ভোর চারটা নাগাদ বেসে পৌঁছে দেখলাম আগে থেকেই আমাদের পৌঁছানোর অপেক্ষায় বসে রয়েছে দুজন গাইড।
যেহেতু সানরাইজ ট্রেক কিংবা সূর্যোদয় এই পথের একটা বিশেষ আকর্ষণ তাই আর দেরী না করেই হাঁটা শুরু করলাম সবাই। ঘোর অন্ধকারে হেডল্যাম্প আর টর্চ জ্বালিয়ে শুরু হল আমাদের পথচলা।আমাদের দলে ছিল তিন জন স্প্যানিশ মেয়ে। ওরা গান গাইতে গাইতে এগোচ্ছিলো।
অন্ধকার পথ, হেডল্যাম্পের আলো আর ওদের গান সব মিলিয়ে বেশ একটা উৎসবের আমেজ নিয়ে পথ চলেছি সবাই। আর এভাবে চলতে চলতে ভোর ছয়টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম ১৫০০ মিটার উচ্চতায়। একবারে যথার্থ একটা সময় ছিল তখন কারণ ওই সময়টাতে সূর্যের প্রথম আলোর লালচে আভায় মাখামাখি হয়ে ছিল পূবের আকাশ। প্রায় এক ঘন্টার মত উপভোগ করলাম সূর্যোদয় আর আকাশের লাল-কমলা আলো গায়ে মেখে ভেসে চলা সাদা মেঘের হুড়োহুড়ি। খুব কাছেই দেখা যাচ্ছিল মাউন্ট আগুং আর তার নিচের স্বচ্ছ নীল জলের নয়নাভিরাম বাটুর লেক। মেঘ, পর্বত, লেক, সূর্যের ছড়িয়ে পড়া বর্নীল আলো সব মিলিয়ে এ যেন অপার্থিবতায় নিমগ্ন কোন রহস্যপুরী। এতো এতো সৌন্দর্যের ভীড়ে ক্লান্তিগুলো কখন যে মেঘেদের ভেলায় চড়ে কোথায় কোন সুদূরে হারিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।
মাউণ্ট বাটুরের সানরাইজ পয়েন্ট থেকে দেখা সূর্যোদয়।
সূর্যোদয়ের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েই হোক কিংবা পথচলার ক্লান্তিতেই হোক দলের অন্যদের মধ্যে সামিটে যাবার তেমন কোন তাগিদ নেই। সামিট থেকে মাত্র ২১৭ মিটার নীচে আমি। অতএব, মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায় পা না রাখার বা সামিট পর্যন্ত না যাওয়ার কোন কারণ নেই। সামিটের ব্যাপারে কারো নড়াচড়া না দেখে গাইডকে জানালাম আমি সামিটে যেতে চাই। দলের কেউ যেহেতু সামিটের ব্যাপারে নয় তাই ঠিক হল একজন গাইড তাদের নিয়ে নীচে নেমে যাবে আর আরেকজন গাইড আমাকে নিয়ে যাবে সামিট পর্যন্ত।
আমার সাথে যে গাইডকে দেয়া হল তার নাম ভিদিয়া। দারুণ আন্তরিক আর প্রাণচঞ্চলতায় ভরপুর অল্প বয়সী এক ইন্দোনেশিয়ান মেয়ে ভিদিয়া। পেশাদার গাইডদের মত তাড়াহুড়ো করা কিংবা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কোন প্রবণতাতো তার মাঝে নেই-ই উপরন্তু আমার উচ্ছাস যেন তাকেও সমান ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। ১৫০০ মিটার থেকে ১৭১৭ মিটারের সামিটে যাবার ট্রেইলের পুরোটাই ছিল নুড়ি আর বালুতে ভর্তি। বলা চলে খাঁড়া একটা বালুর ট্রেইল। বড় বড় মোটা দানার কালো বালু তাও আবার ভেজা, স্যাতস্যাতে।পা রাখার পর যথাস্থানে পা রাখাটাই যেন একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।
বারবার পিছলে যাওয়া পা নিয়ে, দুই পা আগাই এক পা পিছাই এমন করতে করতে অবশেষে পৌঁছে গেলাম মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায় । আরোহণের ক্লান্তি আর সৌন্দর্যের মুগ্ধতার একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে মন ভরে দেখে দেখে নিচ্ছি চারিদিক। মেঘেদের উড়োউড়ি, বাতাসের একটানা শব্দ, দূরের পর্বতমালা, নান্দনিক নৈসর্গ সব কিছু যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিল। টুকরো টুকরো মেঘ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল কিছুক্ষণ পর পরই। মাউন্ট বাটুরের চূড়ার একেবারে সামনেই মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা ৩০৩১ মিটার উচ্চতার মাউন্ট আগুংকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকা রূপকথার কোন অতিকায় দানব। মাঝে মাঝেই মেঘ এসে সব দৃশ্য আড়াল করছিল। আবার মেঘ সরে গেলেই দেখতে পাচ্ছিলাম অকৃপণ অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এ যেন মেঘের চাদর জড়িয়ে পৃথিবীর লুকোচুরি।
মাউন্ট বাটুরের ক্যাম্প গ্রাউন্ডে।
দেশে বিদেশে অনেক পাহাড়ে গেলেও বৈচিত্রময়তায় মাউন্ট বাটুর আমার কাছে সেরাদের অন্যতম। বাটুরের সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল এটা একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। এর আগে আমি জাপানের মাউন্ট ফুজি, মাউন্ট যাও এবং হাওয়াই এর ডায়মন্ড ক্রেটারে গিয়েছি যার সবগুলোই ছিল মূলত মৃত আগ্নেয়গিরি। আর তাই জীবন্ত আগ্নেয় পর্বত বাটুর আমার কাছে একদম নতুন একটা অভিজ্ঞতা। চূড়ার কাছাকাছি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য জ্বালামুখ কিংবা সুড়ঙ্গ, যার সবগুলো থেকেই প্রতিনিয়ত গলগল করে বেরিয়ে আসছে গরম ধোঁয়া আর বাস্প। পায়ের নিচের মাটির উষ্ণতা বারবার জানিয়ে দিচ্ছে এই পর্বতের অভ্যন্তরে কত কত লাভা টগবগ করে ফুটছে সারাক্ষণ।
মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায় একটুকরো বাংলাদেশ।
এর মাঝে ভিদিয়া পরামর্শ দিলো আমরা যে পথ ধরে উপরে উঠে এসেছি সে পথে না নেমে পুরো ক্রেটারটা ঘুরে নীচে নামলে অনেক বেশী ভাল লাগবে। ভিদিয়াকে অনেক ধন্যবাদ কারণ এই দারুণ পরামর্শটার জন্যই আমি মুলত মাউন্ট বাটুরের রূপ, সৌন্দর্য পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে পেরেছিলাম। এবং সেই সাথে এও উপলব্ধি করেছিলাম যে শুধুমাত্র সূর্যোদয়ই নয়, মাউন্ট বাটুরের সামিট সহ পুরো ক্রেটার ঘুরে নেমে না আসলে পুরো ভ্রমণের অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যাবে।
মাউন্ট আগুং-কে সামনে রেখে দুদন্ড জিরিয়ে নেয়া।
বেশ কিছুটা সময় মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায় কাটিয়ে অতঃপর ক্রেটার ঘুরে নামতে শুরু করলাম। ক্রেটারের চারপাশের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল চেনা জানা পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন এক অচেনা অজানা গ্রহের মাটিতে এসে উপস্থিত হয়েছি আমি। ট্রেইলের একপাশে ছিল মাউন্ট আগুং আর বাটুর লেক আর অন্যপাশে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে নির্গত কালো পাথরের একটা স্তর। উবুড শহরটাকেও বেশ দেখা যায় এখান থেকে। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গর্তগুলো থেকে অবিরত গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। আনুমানিক ১৬০০ মিটার উচ্চতায় একটা অংশ ছিল দুইপাশে গভীর খাদ আর তার মাঝে দেড় ফুট মত প্রশস্ত চলাচলের রাস্তা। বেশ একটু ভয় ভয় লাগলেও রাস্তাটা পার হয়ে গেলাম খুব সহজেই। ক্রেটার ঘুরে আসা এদিকটায় ১৫০০ মিটার পর্যন্ত নামার রাস্তাটাও ছিল বেশ কঠিন কিন্তু চারপাশের সৌন্দর্য মনকে এতটাই বিমোহিত করে রেখেছিল যে কোন কস্ট কিংবা ভয় কাজ করেনি সেসময়। এতটাই মুগ্ধ ছিলাম আমি যে, বারবার আমার গাইডকে বলছিলাম আমি ফিরে যাবনা, আমি এখানেই এই পাহাড়ের বুকেই রয়ে যেতে চাই।
মাউন্ট বাটুরের খাঁজে খাঁজে মেঘেদের চলাচল।
১৫০০ মিটারে ভোরবেলার সূর্যোদয় দেখা জায়গাটায় পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মাউন্ট আগুংকে বিদায় জানিয়ে নীচে নামতে শুরু করলাম আবারো। নামার সময় অবাক বিস্ময়ে ভাবছিলাম রাতের অন্ধকারে এই ট্রেইল বেয়ে আমি কি করে উপরে উঠেছিলাম! নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, দিনের আলোতে এই ট্রেইল পরিস্কারভাবে দেখতে পেলে আমি কি উপরে উঠতে পারতাম আদৌ! ভয় পেয়ে কবেই পিছু হটতাম হয়তো। যাই হোক, উপরে ওঠা বাধ্যতামূলক ছিল না কিন্তু উঠেছি যখন নীচেতো নামতেই হবে। প্রখর রোদ মাথায় নিয়ে নামছি তো নামছিই। মাঝে মাঝে শুধু দুই পা-ই নয় দুই হাতেরও যথেষ্ট সদ্ব্যবহার করতে হচ্ছিল এখানে ওখানে। গোড়ালীতে অনেক চাপ পড়লেও সহ্য করা ছাড়া আপাতত কোন উপায় নেই।
নামছি আমি নামছে মেঘেরাও।
খানিক বিশ্রাম আর খানিক অবরোহণ মিলিয়ে কোন রকম সমস্যা ছাড়াই নেমে এলাম মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ার ১০০০ মিটার উচ্চতায়।এরপর প্রথমে বাটুরের বেস অতঃপর সেখান থেকে গাড়ীতে করে ফিরে চললাম হোটেলের দিকে আর সাথে করে নিয়ে চললাম অসাধারণ এক অভিজ্ঞতার স্মৃতি।
ক্রেটার ঘুরে নেমে যাওয়া পথ।
পথ এখন শুধুই অবরোহণের।
মাউন্ট বাটুরের আগ্নেয় চূড়ায় দেখতে পারেন ভিডিওতে।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
Awesome apu
thanks