ফুল, পাখি আর প্রজাপতিদের পিছু লাগার দুরভিস্বন্ধি নিয়েই, খটখটে শুকনো ঝিরি আর মে মাসের তীব্র গরম উপেক্ষা করে হাঁটছি রামগড়ের জঙ্গলে। পানির বোতলটার অবস্থা তৃষ্ণায় কাঠ হয়ে যাওয়া আমার গলার চেয়েও খারাপ। শেষরাতে বয়ে যাওয়া সামান্য ঝড়ো-বৃষ্টির জল কোথাও জমে আছে কিনা খুঁজতেই ঝোপঝাড়ের আড়ালে থাকা ছোট ছোট ঝিরিগুলো তে উঁকিঝুকি মারছি বারবার। এমন সময় কানের পাশ ঘেষে অ্যাপাচী হেলিকপ্টারের মত সাঁই করে উড়ে যাওয়া এক ঝলক নীল রঙ দেখে আমার তো শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে যাওয়ার অবস্থা!
মাত্র কদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ান একটা ওয়েবসাইটে Blue-Banded Bee শীর্ষক একটা প্রতিবেদন দেখেছিলাম যেখানে এই বিশেষ মৌমাছি সম্পর্কে বেশ চমকপ্রদ কিছু তথ্য দেয়া ছিল। নীল আর কালো ডোরাকাটা এই অদ্ভুত সুন্দর মৌমাছিটা আমার এত কাছে ভাবতেই মাথার ভিতর জল খোঁজার চিন্তা বিবর্তিত হয়ে গেল Blue-Banded Bee তে। ওর উড়ে যাওয়া পথের দিকে লক্ষ্য রেখে ঝোপ-জঙ্গল সরিয়ে কিছুদুর এগোতেই আমার দ্বিতীয়বার অবাক হবার পালা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে না পারার অনুভুতি বুঝি এমনই হয়! চারপাশের ঘন সবুজ চাদরের মাঝে অহংকারী দেবদুতের মত মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বিলু্প্তপ্রায় বুনোফুল “কুলঞ্জন”। আর তারই চারপাশে কৃপাধন্য তীর্থযাত্রীর মত ঘুরে বেড়ানো নীল মৌমাছিটা দেখে এটা যে Blue-Banded Bee তা আর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোন প্রয়োজন পড়ছেনা। এ যেন কুলঞ্জনের বনে নীল স্বপ্ন বুনে চলা কোন গল্প! হাতে ধরা ক্যামেরাটা চোখে তুলে শাটারটা চেপে ধরতে যা দেরী, স্বপ্নপূরণে দেরী হলোনা।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনেকে ভেবে ফেলেছেন, কি এমন আহামরী বিষয় এই কুলঞ্জন আর নীল মৌমাছি যা কিনা একেবারে আমার স্বপ্ন বনে গেছে। এমন ভাবতে চাওয়া খুবই যৌক্তিক এবং আমারও খুব ইচ্ছে ব্যাপারটা সম্পর্কে যতটা আমি জানি তা আপনাদের জানাই।
Blue-Banded Bee নামের এই সুন্দর এক টুকরো নীল স্বপ্নের বৈজ্ঞানিক নাম Amegilla cingulata। দশ থেকে বারো মিলিমিটারের এই পুছকেগুলোর নামকরণ করা হয়েছে ল্যাটিন শব্দ cingulum থেকে। যার অর্থ বেল্ট। চকচকে কালোর মাঝে দারুন উজ্জ্বল নীল রঙের বেল্ট পড়ে ঘুরে বেড়ানো Amegilla cingulata-দের সাথে অন্যান্য সাধারণ মৌমাছিদের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। বেশ ভাবসাব, দ্রুত চলাফেরা এবং হুল ফুটানোর যথেষ্ট ক্ষমতা থাকলেও Blue-Banded Bee অন্য মৌমাছিদের মত তেমন আক্রমণাত্নক নয়। সাধারণ মৌমাছিদের মত কলোনী বানিয়ে বসবাস করতে ওরা অপারগ। অল্প কজন বন্ধু-বান্ধব কিংবা একা একা রাতটা গাছের ডালে বসেও তো পার করে দেয়া যায় তাই না! আর কাছাকাছি স্ত্রী মৌমাছির বাসা তো আছেই! তারপরও বাচ্চাদের লালন পালন, খাবার সংরক্ষণ ইত্যাদির জন্য ঘর যদি বানাতেই হয় তাহলে নরম বেলেপাথর, শুকনো নদীর তীর, মাটির দেয়াল, পাথরের খাঁজ কিংবা ইটের ফাঁক-ফোকড় এসব তো পড়েই আছে!
তবে যে বিষয়টা ওদেরকে সাধারণ মৌমাছিদের চেয়ে অনেক বেশী আলাদা করেছে তা হলো, ভ্রমর এবং অল্প কিছু সংখ্যক মৌমাছিদের মত Blue-Banded Bee-রা ফুল কিংবা পরাগদন্ড আকড়ে ধরে রেখে খুব দ্রুততার সাথে উড্ডয়নে সহায়ক পেশীগুলো নড়াচড়া করতে সক্ষম। এ থেকে সৃষ্ট কম্পনে প্রচুর পরাগরেণু ছিটকে পড়ে এবং পরাগায়নের সম্ভাবনাও বেড়ে যায় বহুগুন। বিজ্ঞানীরা যার নাম দিয়েছেন buzz pollination কিংবা কম্পনজনিত পরাগায়ন এবং ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বিজ্ঞানী কৃষিক্ষেত্রে বিশেষভাবে টমেটো, মরিচ, এগপ্লান্ট ইত্যাদি উৎপাদনে Blue-Banded Bee-দের এই বিশেষ ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমরা সবাই কমবেশী জানি যে, ফল বা ফসল উৎপাদন এবং অধিকাংশ উদ্ভিদের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে পরাগায়নের বিকল্প কিছুই নেই। আর সেক্ষেত্রে buzz pollination হতে পারে একটি সম্ভাবনাময় পদ্ধতি।
অস্ট্রেলীয়ার অধিবাসী হিসেবে খ্যাত হলেও Anthophoridae পরিবারের এই ছোট্ট নীল মৌয়ালকে পাপুয়া নিউগিনিয়া, ইন্দোনেশীয়া, মালয়েশিয়া, ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিন্যান্ট ছাড়াও আরো অল্প কিছু দেশের ট্রপিক্যাল এবং সাবট্রপিক্যাল অঞ্চল গুলোতে উড়োউড়ি, ঘুরোঘুরিতে দেখতে পাওয়া যায়। যদিও এরা নীল রঙয়ের ফুলেদের সন্ধানে বেশী ব্যাস্ত, তারপরও খাবারের জন্য ওরা মাঝে মাঝে অন্য কিছু ফুল বিশেষত সাদা রঙয়ের ফুলের দিকে নজর দিতেও তেমন আপত্তি করেনা। এমনকি টমেটো ফুলের মধুও ওদেরকে বেশ আনন্দ নিয়েই খেতে দেখা যায়।
কিন্তু দুঃখজনক সত্যিটা হলো, ক্রমাগত বন-জঙ্গল ধ্বংস, কীটনাশকের ব্যাবহার, নদী তীরের পরিবেশ পরিবর্তন কিংবা দুষনজনিত কারনে এই ছোট্ট নীল স্বপ্নটা প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির পথে। যার দায়ভার-টা শুধুই আমাদের আর তাই হারিয়ে যাওয়ার আগে ধরে রাখার দায়িত্বটাও আমাদেরই নেয়া উচিত।
এবার আসি কুলঞ্জনের কথায়। অনেক আদিতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া আর ফিলিপাইনের জঙ্গলে বসবাসকারী কুলঞ্জন কখন যে গুটি গুটি পায়ে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন পাহাড়ি অরণ্য, হিমালয়ের পাদদেশ এবং আশেপাশের নিচু ও মাঝারি উচ্চতার পাহাড়ি বনভুমি ঘুরে বাংলাদেশে এসে পৌছেছিল তা বেশ তর্ক সাপেক্ষ হলেও সতের শতকের রাজনিঘন্টুতে প্রচুর ঔষধি গুণে গুণান্বিত, দেখতে বেশ রাজকীয় এই ফুলের সরব উপস্থিতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বৈজ্ঞানিক নাম Alpinia malacansis ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে মধুনিক্কন, তীক্ষ্ণমূল, গন্ধমূল ইত্যাদি নানা নামে ভুষিত হওয়া কুলঞ্জন zingiberaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি উদ্ভিদ। এত এত নামের বাহার ছাড়াও, যুগে যুগে অনেক বিজ্ঞানী এবং ভেষজ পন্ডিতরা কুলঞ্জনকে প্রচুর ঔষধিগুণ সম্পন্ন একটি উদ্ভিদ হিসেবে চিণ্হিত করেছেন। অনেকটা আদার মত দেখতে কুলঞ্জনের মুল বা কন্দে রয়েছে গ্লাইকোসাইডস, গ্যালানজিন, ফাইটোস্টেরোল ও কর্পূর ছাড়াও আরও বেশ কিছু উপকারী রাসায়নিকের উপস্থিতি। নব্যের সমীক্ষায় কন্ঠনালীর বিভিন্ন সমস্যা এবং বাতজনিত অসুস্থতায় কুলঞ্জনের মুলের ব্যাবহার দেখা যায়। এমনকি ফুসফুস ও শ্বাসনালীর ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও কুলঞ্জনের মূলের ঔষধিগুণকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টায় আছেন জাপানের কিছু বিজ্ঞানী। কুলঞ্জনের শুকনো ডাঁটা থেকে বিশেষ এক ধরণের তেল তৈরী হয় যা অনেক প্রাচীনকাল থেকেই ভেষজ চিকিৎসায় ব্যাবহার হয়ে আসছে। বমি নাশক, আলসার ছাড়াও বিবিধ রোগের চিকিৎসায় কুলঞ্জনের ফল বা বীজ যথেষ্ট উপকারী হিসেবে চিণ্হিত।
কুলঞ্জনের বিষয়ে এতক্ষন যা বললাম, তা শুনে নিশ্চয়ই আপনাদের মনে হচ্ছে, এমন উপকারী একটা উদ্ভিদ সম্পর্কে আমরা এত কম জানি কেন? কম জানার কারণটাও খুবই সহজ। ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে না চাওয়া কুলঞ্জনেরা সাধারণত, জঙ্গলের অনেক গভীরে, ছোট ছোট গাছের জঙ্গল, ছায়াযুক্ত পাথুরে জমি, পাহাড়ি ঝিরির আশেপাশের উর্বর ছায়াযুক্ত আদ্র পরিবেশে বসবাস করতে পছন্দ করে। পুস্পদন্ডসহ প্রায় চার মিটারের কাছাকাছি উচ্চতার কুলঞ্জনেরা একসময় কিছু কিছু বাড়ির বাগানে শোভা পেলেও আজকাল তাদের বিশেষ একটা দেখা যায়না। তার উপর ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকা বন, ঝিরিতে পানির স্বল্পতা এবং সর্বোপরি আমাদের উদাসীনতার কারনে কুলঞ্জন আজ একটি বিপন্নপ্রায় উদ্ভিদ। রামগড়, মিরসরাই, সীতাকুন্ড ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের অল্প কিছু জঙ্গলে অনেক কষ্টে টিকে থাকা বাংলাদেশের বুনোফুল হিসেবে খ্যাত কুলঞ্জনেরা হয়ত একদিন চিরতরেই আমাদের ছেড়ে যাবে। আর সেদিন হা-হুতাশ করা ছাড়া আমাদের হয়ত আর কিছুই করার থাকবেনা। যদিও আজকাল একটুখানি আশার আলো দেখাচ্ছেন উত্তর-পূর্ব ইন্ডিয়া, জাভা আইল্যান্ড, দক্ষিন চীনের কিছু মানুষ যারা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য গবেষণার কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কুলঞ্জনের চাষ করার চেষ্টা করছেন। এভাবে যদি সবাই সংরক্ষণ এবং উৎপাদনের ব্যাপারে মনযোগী হয় তাহলে হয়ত টিকে যাবে বাংলাদেশ তথা এশিয়ার এই সত্যিকারের দেবদুত।
এই রে..!! অনেক বেলা হয়ে গেলো তো..!! গল্প করতে করতে তৃষ্ণার কথাও বেমালুম ভুলে গেছি। তাছাড়া অনেক পথ বাকী এখনও! এখন যেতেই হবে! পরে আবার কোন একদিন আপনাদের সামনে গল্পের ঝাপি খুলে বসবো, কথা দিলাম।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।