বিষয়টা নিয়ে অনেক বছর আগে থেকেই আমি টুকটাক ভাবনাচিন্তা করতাম। পরবর্তীতে সেই অলীক(!) ভাবনাটাকে উষ্কে দেন প্রবাদপ্রতিম নির্মাতা এবং চিন্তাবিদ জেমস ফ্রান্সিস ক্যামেরন। আমার পুরোনো ভাবনা এবং বিশ্বাস একটা ভিত্তি পায় অবশেষে। বেশ বেশ! ক্যামেরন সাহেবের অঋজু সমর্থন পেয়ে মনে মনে গর্বিত হই। ব্রীড়াহীন চিত্তে কয়েকজনকে বিষয়টা জানাই। সেটা ছয়/ সাত বছর আগের কথা। আসলেই এমন কিছু এক্সিস্ট করে হয়ত তা না হলে ক্যামেরন এভাবে বিষয়টা সিম্যুলেট করে দেখাতেন না। তার অনেকদিন পর, এক অলস দুপুরে, কোন এক উপায়ে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার প্রফেসর সুজান সিমার্ডের নাম জানতে পারি। ফরেস্ট ইকোলজিস্ট সুজান সিমার্ড। রিমেম্বার দ্যা নেইম! যারা উনার সম্পর্কে জানেন, তারা বোধকরি এটুকুতেই চট করে ধরে ফেলেছেন, আমি কী বিষয়ে কথা বলছি।
আপনি কি কখনো কোন প্রাকৃতিক বনে, পৃথিবীর সমান বয়সী আর অতিকায় সব বৃক্ষরাজির মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন? করে থাকলে, সেসব সুউচ্চ বৃক্ষের পত্রপল্লবের ফাঁক গলে, আকস্মিক ঠিকরে বের হওয়া উচ্ছ্বসিত সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হবার সময় কখনো কি ভেবে দেখেছেন, সেই সমগ্র ফরেস্ট সিস্টেম কিভাবে কাজ করে? শুকনো পাতায় মড়মড় শব্দ তুলে, বিস্ময় মাখা দৃষ্টি নিয়ে যখন, বনের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে এগিয়েছেন, তখন একবারও কি বৃক্ষ গুলোকে ছুঁয়ে দেখেছেন? অনুভব করেছেন তাদের? তারা যে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং কিভাবে তা হয়, এসব কখনো আপনার ভাবনায় এসেছে কি?
সিমার্ড যা করেছেন তা হল, বন এবং বৃক্ষরাজি নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছেন। একটা বন আসলে কী? কতগুলো গাছ, ঝোপ-জংগল আর বন্যপ্রাণির আবাস? না! একটা বন তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আত্ন-আরোগ্য লাভের অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন একটা জটিল তন্ত্র। একটা গাছ আরেকটা গাছের সাথে, একটা প্রজাতি আরেকটা প্রজাতির সাথে যে কমিউনিকেট করে, তথ্যের আদান প্রদান হয় এই ফ্লো এবং একে অন্যের সাথে কার্বন ভাগাভাগির বিষয়টা পরিমাপ করার জন্যে সিমার্ড রেডিও এক্টিভ কার্বন ব্যবহার করেছেন। যেটা ছিল একটা গ্রাউন্ডব্রেকিং রিসার্চ।
একটা গাছ যখন পাতা হারাতে থাকে কিংবা ছায়াযুক্ত স্থানে পড়ে যায়, তখন অন্য একটা গাছ একে অতিরিক্ত কার্বন সরবরাহ করে। সিমার্ড ছাড়াও আরো অনেক ফরেস্ট ইকোলজিস্ট আছেন, যারা এসব নিয়ে রিসার্চ করেছেন, এখনো করছেন। কিন্তু সিমার্ড তার রিসার্চে এমন কিছু পেয়েছেন, যা আসলে আমাদের সামনে নতুন একটা চিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আরো একজনের কথা অবশ্যই বলা লাগে; উনি হচ্ছেন জার্মান ফরেস্টার পিটার ওহলেবেন। সিমার্ডের রিসার্চ আসলে ওহলেবেনের অনেক অনুসিদ্ধান্ত এবং পর্যবেক্ষনকেই সমর্থন দেয়। যেসব ওহলেবেন তার লেখা বইতে উল্লেখ করেছেন।
এখন আসি আসল কথায়। কমিউনিকেশনের যে প্রসেসটার কথা একটু আগে বলা হল, সেটা শুধুমাত্র ভূপৃষ্ঠতল ও তার উপরি ভাগেই ঘটে, এমন না। মাটির অত্যধিক গভীরে তৈরি আছে অভূতপূর্ব এক নেটওয়ার্ক। মাইকোরাইজাল নেটওয়ার্ক। যার মাধ্যমে সংঘটিত হয় নানা ধরণের রাসায়নিক সংকেত আদানপ্রদান। সে আরেক পৃথিবী! ইনফাইনাইট বায়োলজিক্যাল পাথওয়েজ, বিস্ময়কর এক জগত! যা বৃক্ষরাজিকে একে অপরের সাথে যুক্ত রেখে কমিউনিকেশন টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। সবাই সেখানে কানেক্টেড, কোন না কোন উপায়ে। ব্যাপারটা একটু ভিজ্যুয়ালাইজ করুন, দেখুন কী অসাধারণ! আর, কমিউনিকেশন বলতে- এরা নিজেদের মধ্যে কার্বন, পানি, নাইট্রোজেন, ফসফরাস এমনকি বিপদ সংকেতও আদানপ্রদান করে থাকে। এই আর কী! আরো হয়তো অনেক কিছু রয়ে গেছে, আবিষ্কারের অপেক্ষায়। হাউ কুল ইজ দ্যাট?
ভূ-অভ্যন্তরে এই যে বিশাল নেটওয়ার্ক, এখানে বনের সবচেয়ে পুরোনো আর বড় গাছ গুলো চক্রকেন্দ্র বা ‘হাব’ হিসেবে কাজ করে। হ্যাঁ, এরাই ‘ মা গাছ ‘! এরা নিজের বংশধর, স্বজনদের আলাদা করে চিনতে পারে। স্বভাবতই পরিবার পরিজনের বেড়ে ওঠার রসদ একটু বেশি বেশি সরবরাহ হয় মা গাছ থেকেই। একেকটা মা গাছ যোগাযোগ রক্ষা করে বনের আরো শতশত গাছের সাথে। এ যেন এক সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন! এখন যদি একটা মা গাছ কেটে ফেলা হয়, তাহলে কী হবে? এই আন্তঃযোগাযোগের পুরো সিস্টেমটাই কলাপ্স করবে সাথে সাথে। করাটাই স্বাভাবিক, তাই না? ভাবুন একটু। এবার মিলিয়ে নিন নিজের পরিবারের সাথে। তার মানে, মা গাছ নিছক একটা গাছ নয়, তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু। এসব মনগড়া কথাবার্তা নয়। সায়েন্টিফিক রিসার্চ থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে, তবেই এসব সিদ্ধান্তে আসা গেছে।
আমরা একটা মা গাছ কেটে ফেলে আশপাশের কিংবা সমগোত্রীয় আরো একশ গাছকে বিপদে ফেলে দিচ্ছি। কারণ সেন্ট্রাল হাবটাকে উপড়ে ফেলে আমরা পুরো সিস্টেমটাকেই বিনষ্ট করে ফেলছি। একই সাথে ধ্বংস করছি একটি চমকপ্রদ পারিবারিক বন্ধনকে। ঠিক না! এসব ঠিক না! আমাদের জানা দরকার, বোঝা দরকার। পালটানো দরকার দৃষ্টিকোণ। হাজার কোটি টাকা দিয়েও একটা প্রাকৃতিক বন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। প্রকৃতিকে ভোগের উপকরণ হিসেবে ভাবলে হবে না। প্রকৃতির অংশ হয়ে যেয়ে জীবনধারণ করতে হবে। সমৃদ্ধি কেবল এভাবেই সম্ভব।
প্রকৃতি যে কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ, অনুনাদশীল, স্থিতিস্থাপক এবং পুনরুৎপাদী- সেটা আমরা বুঝতে পারি একটা ফরেস্ট সিস্টেমকে কাছ থেকে দেখে, উপলব্ধি করে এবং সেখানে বিরাজমান আন্তঃযোগাযোগ গুলো আবিষ্কার করে। শতসহস্র প্রজাতি কিভাবে নির্দিষ্ট একটা এলাকা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে! অথচ কোন ময়লা, আবর্জনা কিচ্ছু নেই। এই সিস্টেমের প্রত্যেকটা এলিমেন্ট কিভাবে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে, প্রকৃতির অংশ হয়ে, একে অপরের সাথে মিথষ্ক্রিয়া বজায় রাখছে, এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর আমরা মনুষ্যজাতি এলিয়েনের মত উড়ে এসে জুড়ে বসে কী করছি? আসলেই আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। বিশ্বাস করুন, ভালভাবে বাঁচতে এবং গ্রহটাকে বাসযোগ্য রাখতে, কিভাবে কী করা লাগবে, তার ব্লুপ্রিন্ট ওখানেই আছে- গহীন বনে!
লিখেছেনঃ কামরুল হাসান সজীব। পেশায় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। সারাদিন রাত কাজ করেন, শুধুমাত্র মনমত কিছু সময় যেন পাহাড়ে কাটাতে পারেন। বাসা ও কাজের বাইরে সমস্ত জগত জুড়ে শুধুই পাহাড়। পাহাড়ে পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছাড়াও শখের মধ্যে হচ্ছে ছবি তোলা ও গিটার বাজানো।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
