অপেক্ষাকৃত কম গভীর একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে, আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা শুকনো বাঁশ আর কাঠের সাহায্যে স্রোতের উপর একটা ব্রীজের মত তৈরি করে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই পাড় হয়ে গেলাম সবাই। নদী পেরুনোর পর শুরু হল নতুন বিপদ। ওপাড় থেকে যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে দশগুণ ভয়ংকর পাথুরে দেয়ালটা। কোথাও পা রাখার জায়গাটুকুও নেই। খুব সাবধানে একটু একটু করে এগোচ্ছি। একবার পা হড়কে গেলে সোজা বিশ-পঁচিশ ফুট নিচের পাথরে আছড়ে পড়ার পর কি হবে ভাবতেই বুকটা হিম হয়ে যাচ্ছে। ভারী ব্যাগগুলো পিঠে নিয়ে, কোনরকম নিরাপত্তা ছাড়াই, ইঞ্চি ইঞ্চি করে পুরো দেয়ালটা কিভাবে পার হয়ে আবারো নদীর কাছাকাছি নেমে এসেছি জানা নেই। কিন্তু সব মিলিয়ে আধা কিলোমিটারের কাছাকাছি ভয়ংকর এই দেয়ালটা পার হতে হতেই দেখা গেল সূর্যদেব বাড়ির পথ ধরেছে।
এর ভিতর লক্ষ্য করলাম নদীর গভীরতাও কমছে। হঠাৎ নেমে আসা প্লাবনের তীব্রতাও কমেছে একইসাথে। স্রোতের পাশের মাথা তুলে থাকা পাথরগুলোর উপর পা ফেলে ফেলে বেশ ভালোই হাঁটা যাচ্ছে। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর যা দেখলাম তার যেন কোন তুলনাই চলেনা। কোনদিকে হেঁটে যাওয়ার মত পথের চিহ্নমাত্র না রেখে, পথরোধ করে বসে থাকা অতলস্পর্শি কুমটা দেখে মনে হল, হাপ ছেড়ে বেঁচে যাওয়া আমাদের সাথে নিতান্ত সস্তা রসিকতায় মগ্ন পুরো প্রকৃতি! আশেপাশে পাহাড়ের উপর একটা গ্রাম থাকার কথা থাকলেও সেটায় যাবার কোন পথ আপাতত চোখে পড়ছেনা। অথচ এই জল পাহাড়ের খাঁজে আটকে পড়া আমাদের চারপাশের আলো মুছে গিয়ে ক্রমশ নেমে আসছে অন্ধকার!
যেহেতু এই অভিযানে সবগুলো রাত পাহাড়ি গ্রামে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছি তাই সাথে করে কোন তাবু বা সেল্টার নিয়ে আসার প্রয়োজন বোধ করিনি কেউ। নিজেদের খুব নির্বোধ মনে হলেও এই মুহুর্তে এসব ভাবার সময় নেই। রাতটা এখানেই কাটাতে হবে তাই তাড়াতাড়ি লেগে পড়লাম একটা সেল্টার বানানোর যোগাড় যন্ত্রে। এদিক সেদিক ঘুরে একটা ক্যাম্পসাইট খুঁজে নিয়ে, কলাপাতা আর বাঁশ সংগ্রহ করে সেল্টার বানানো শুরু করতেই দেখলাম পাশের পাহাড়ের জঙ্গল থেকে হুড়োহুড়ি করে নেমে আসছে কিছু আদিবাসী মানুষ। কথা বলে জানা গেল নদী বেয়ে কাঠ নামানোর কাজে ওরা এখানে আছে। এও জানা গেল ভারী কাঠ ভাসিয়ে নেয়ার জন্যই ওরা পানিতে বাঁধ দিয়েছিলো, যা ছেড়ে দেয়ার ফলে ঐ আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি। তাদেরকে আমাদের দুরবস্থার কথা জানাতেই আশ্বাস দিল যে, “আমরাও আজ এখানে থাকবো অতএব, তোমাদের চিন্তার কিছু নেই এমনকি তোমরা চাইলে আমাদের সাথে খাওয়া দাওয়াও করতে পার”। নিমিষেই বদলে গেল গোটা পরিস্থিতি। আমাদের আলাদা সেল্টার বানাতে না দিয়ে সবার জন্য একটা বিশাল সেল্টার তৈরি হয়ে গেল খুব দ্রুততার সাথেই। ধোঁয়া উঠা গরম ভাতের সাথে সবজি আর নদীর মাছ মিলিয়ে দারুণ একটা রাতের খাবার, ক্যাম্পফায়ারের চারধারে বসে বেশ রাত পর্যন্ত জমজমাট আড্ডা সব মিলেমিশে যেন একাকার।
ভোরে উঠে তৈরি হয়ে নিলাম সবাই। যেহেতু সাঁতার এবং পাহাড়ের উপর দিয়ে যাওয়া ছাড়া গভীর কুমটা পেরুনোর আর কোন উপায় নেই তাই ঠিক হল ওদের কয়েকজন আমাদের সাথে পাহাড়ের উপরের গ্রামটা পর্যন্ত যাবে। বেশ জংলা আর খাঁড়াই একটা পথ বেয়ে পাহাড়ের মাথায় পরীখোলা পাড়ায় যখন পৌঁছেছি তখন দেখলাম সবার মাঝেই গতদিনের কষ্ট আর ক্লান্তি ভর করে আছে। সবার একটাই চাওয়া আমরা এখানে একটু বিশ্রাম নেই আজ। পথ যেহেতু অনেক বাকী তাই ভাবলাম ওদের একটু ছাড় দেয়া উচিত। তবে শর্ত একটাই, এ পাড়ায় আমরা থাকবনা তার চেয়ে বরং নিচে নেমে গিয়ে নদীর ধারে জিপিএস-এ মার্ক করা কয়েকটা বাড়ি আছে সেখানে গিয়ে থাকবো। শর্তে রাজী হয়ে বেশ খুশী মনেই এই বিশ্রামের সময়টুকু পুরোদমে উপভোগ করতে লেগে গেল পুরো টীম।সারাটা দুপুর গ্রামে কাটিয়ে, খেয়ে দেয়ে বিকেল নাগাদ ঐ বাড়িগুলোতে গিয়ে পৌঁছুতেই বুঝতে পারলাম ভাগ্যদেবী কোনভাবে হয়ত আমাদের উপর বেশ নাখোশ হয়ে আছে।
পাশাপাশি দুটো ঘরের কোনটাতেই আমাদের থাকার জায়গা হলনা। পাহাড়ের মানুষগুলো সাধারণত বেশ আন্তরিক হয় কিন্তু খুব অবাক কারণে এই মানুষগুলোকে বেশ অন্যরকম মনে হল। কোনভাবেই যখন ওদের রাজী করাতে পারলাম না তখন ভাবলাম গতরাতের বুদ্ধিটাই কাজে লাগাই। আবারো নদীতে নেমে এসে একটা দারুণ ক্যাম্পসাইট খুঁজে বের করলাম। বিশাল একটা অগভীর কুম আর তার পরেই একটা ছোট্ট অথচ বেশ চওড়া জলপ্রপাত, পরবর্তিতে আমরা যেটার নাম রেখেছিলাম মিনি ক্যাসকেইড। একপাশে স্রোতের টানে জমে আসা একটা ছোট্ট বালির চর। ঠিক হল এখানেই সেল্টারটা বানাবো। যা ভাবা সেই কাজ। কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে গিয়ে, একে একে কলাপাতা, বাঁশ, আগুন জ্বালানোর মত লাকড়ি ইত্যাদি সংগ্রহ করে আমরা সাতজন মিলে তৈরী করে ফেললাম দারুণ আরামদায়ক একটা সেল্টার। নিজেদের কাজ দেখে বলা চলে নিজেরাই মুগ্ধ। গ্রাম থেকে নিয়ে আসা আর সাথে থাকা খাবার মিলিয়ে খাওয়া দাওয়াটাও হল বেশ চমৎকার।
খাওয়া-দাওয়ার পর গল্প-গুজবের একফাঁকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল, এত দারুণ একটা জায়গা আর এত যত্ন করে বানানো সেল্টারে মাত্র একরাত থাকা কোনভাবেই যৌক্তিক কিছু হতে পারেনা। এটা একেবারেই অন্যায় এবং কিছুটা অপচয়ও বটে! আমাদের আরো অন্তত একটা দিন এখানে থাকা উচিত। যুক্তি, পাল্টা যুক্তি ইত্যাদির পর সিদ্ধান্ত নেয়া হল যেহেতু আমাদের তেমন কোন তাড়াহুড়ো নেই অতএব, এখানে আরো একদিন না হয় থেকেই যাই! কারো কোন দ্বিমত থাকার প্রশ্নই আসছেনা আর তাই প্রচন্ড ভালোলাগা আর ভালোবাসার তীব্র সম্মোহন, আদিম জীবন-যাপনের দুনির্বার আকর্ষণ, যান্ত্রিক নাগরিকতা থেকে অনেক অনেক দূরের এই ঘোরলাগা প্রকৃতি সব মিলিয়ে হাসি, গান, আড্ডায় কাটিয়ে দিলাম দু-দুটো দিন। এই পুরোটা সময় যেন হড়কা বানের স্রোতের মতই নিমিষে ভেসে গেল কালের গর্ভে। ছেড়ে যাওয়ার প্রচন্ড অনিচ্ছা স্বত্তেও, তৃতীয় দিন ভোরবেলা আবারো সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে শুরু হল আমাদের পথচলা।
সবুজের কোমলতায় মাখামাখি, ছায়া সুনিবিড় রুপকথার গল্পের মত অসাধারণ সুন্দর এই দেশ। যেখানে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে উড়ে চলা জোনাকির ডানায় ভর করে নেমে আসে এক একটি রাত। লজ্জাবতীর বনে শুয়ে থাকা শিশির কণায় সূর্যের প্রতিফলিত আলোয় যেখানে জন্ম নেয় প্রতিটি নতুন নতুন দিন। হারানো পথের বাঁকে আরো একবার হারিয়ে যাওয়ার অবিরত আহ্বানে যেথা রোদ্দুরের দল হাতছানি দিয়ে ডাকে সারাটা দুপুর। যেখানে সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে অবাধ্য কিশোরীর মত ছুটে চলা চঞ্চল স্রোত প্রতিনিয়ত বিবর্তিত হয় উদ্দাম, উন্মাদ, তরলিত প্রপাতে। এসব বিচ্ছিন্ন ভাবনায় বিভোর মন, পিঠে প্রচন্ড ভারী ব্যাকপ্যাক, চোখে আরো নতুন নতুন কিছুর সামনে দাঁড়ানোর অদম্য কৌতুহল নিয়ে পথ চলেছি আমরা সবাই। এবারের গন্তব্য টোয়াইনের অনেক উজানের এক অজানা অচেনা গ্রাম, রালাই পাড়ার অভিমুখে….
প্রথমাংশ পড়ার জন্য ক্লিক করুন
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
