শাপলার লাল গালিচা জুড়ে নৌকো নিয়ে ছুটে বেড়াব এদিক সেদিক, শাপলার ছড়ানো পাতা আর তার সাথে সাথে উঁকি দিয়ে ঝলমল করতে থাকা অসংখ্য ফুটন্ত শাপলা আমার দিকে চেয়ে হাসবে এমনই একটা স্বপ্ন বয়ে বেড়াচ্ছিলাম কিছুদিন ধরে। সে স্বপ্ন পূরণ করতেই সাতলার অপূর্ব শাপলা বিল দেখতে রওনা হলাম একদিন।
বরিশালের উজিরপুরের সাতলা বিল ইতোমধ্যেই বেশ বিখ্যাত। বড় বড় লাল শাপলায় ছেয়ে থাকা সাতলার অপূর্ব শাপলা র সৌন্দর্যে মোহিত হতে অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে পাড়ি জমাচ্ছে এই গ্রামে। বর্ষার পানিতে পূর্ণ হয়ে যায় বিলগুলো আর বর্ষার আগমনের সাথে জুটি বেঁধে বিলগুলোতে শাপলা ফুটতে শুরু করে। বর্ষা শেষে পুরো বিল জুড়ে শাপলা ফুটে লাল গালিচা তৈরি করে।
ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারা বাগান দেখে বরিশাল শহরে ফিরতে প্রায় বিকেলই হয়ে গেল। সারাদিন শুধু ঘুরেছিই, দুপুরে পেটে দানা পানি পড়েনি, তাই বরিশাল ফিরে আগে উদরপূর্তি করলাম সবাই। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে সাতলার জন্য যখন রওনা হই তখন সন্ধ্যে প্রায়। লোকাল বাসে যেতে বেশ সময় লাগবে তাই একটা সিএনজি রিজার্ভ করে নিয়ে করে ছুটে চললাম আমরা ৫ জনের একটা দল। এদিকটা আগে আসিনি। অন্ধকারে অচেনা, অদেখা রাস্তা ভেদ করে ছুটে চলছিল আমাদের সিএনজি। রাস্তা একেবারে ফাঁকা, কোন জন মানবের দেখা নেই প্রায় পুরোটা রাস্তা জুড়েই। মাঝে মাঝে দুই একটা বাজার দেখা দিচ্ছিল, সেগুলো আবার ভোজ বাজির মত মুহূর্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল। একটু দুশ্চিন্তা কাজ করছিল এই রকম অচেনা জায়গায় রাত হয়ে যাওয়াতে। সেই দুশ্চিন্তা আরও প্রকট হয়ে দাঁড়ালো যখন রাতে থাকার জন্য কোন ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। নিজস্ব পরিচিতি দিয়ে যে সব জায়গায় রাতে থাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছিল সেগুলো আবার সাতলা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আমাদের সাতলাতেই থাকতে হবে কারণ শাপলা ফোটে ভোর বেলায়। রোদের তেজ বাড়ার সাথে সাথে শাপলা তার হাসিমুখ বন্ধ করে দেয়। তাই কাছাকাছি না থাকতে পারলে সাতলার বিলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রোদ উঠে যাবে।
সাতলা বাজার পৌঁছানোর আগে আগে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলাম সাংবাদিক আরিফুর রহমানের বদান্যতায়। তিনি আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দিলেন স্থানীয় রাজিব হাওলাদারের সাথে। সাতলা বাজারে যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় ৯টা। জানতে পেলাম রাতে খেতে চাইলে এই বাজারের ভাঙ্গাচোরা হোটেলেই খেতে হবে। খেয়ে নিলাম, অনেক ভালো ছিল খাবার। সেই সাথে হোটেল মালিকের আন্তরিকতাও ভোলার নয়। সাতলা বাজারের ঘাট থেকে নৌকা দিয়ে পার হয়ে যেতে হলো সাতলা গ্রামে। রাজিব হাওলাদার ঘাটে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। খুবই অতিথিপরায়ণ তিনি। তার বাড়িতেই সেই রাতটা থাকলাম আমরা।
ফুটন্ত শাপলার হাসিমুখ দেখার স্বপ্নে সারাটা রাত কাটলো দারুণ এক উত্তেজনায়। রাত যেন শেষই হতে চাইছিলনা। ভোর ৪টায় উঠেই সবাই প্রস্তুত হতে শুরু করলাম বিলে যাওয়ার জন্য। সূর্যের স্নিগ্ধ আলোয় ভোরবেলাতেই তো হাসে শাপলা। যত রোদ বাড়ে, সূর্যের তেজ বাড়ে শাপলারা ততই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এত দূরে এতো কষ্টকর পথ পেরিয়ে এসে শাপলাদের ঝলমলে ফুটন্ত রূপটা দেখতে সবাই ছুটলাম সেই ভোরবেলাতেই। একটা অটো রিকশায় চড়ে ভাঙ্গাচোরা পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বেশ বড় একটা বিলের কাছে।
বিলের ধারেই ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা ভেড়ানো। নৌকাগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন। নৌকাগুলো কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ছিলনা তাই অনুরোধ করে নৌকাতে চড়ার অনুমতি নিলাম। নৌকাগুলোতে দু/তিন জনের বেশি ওঠা যায় না। তাই ছোট দলে ভাগ হয়েই ঘুরে দেখলাম সাতলার অপূর্ব শাপলা বিল । স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম মনের আনন্দে। যে শাড়িটা পরেছিলাম সেটাও শাপলার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে ছিল। মনে হচ্ছিলো যেন মিশে গেছি আমি প্রকৃতির সাথে। নিজেকে মনে হচ্ছিল প্রকৃতির একটা অংশ। এই বিলে ঝাঁক ঝাঁক লাল শাপলার ভিড়ে আরও দেখলাম নীল আর সাদা শাপলা।
কিন্তু খুব বেশিক্ষণ এই স্বপ্ন রাজ্যে ভ্রমণ করতে পারলাম না। শুরু হল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি যেন অন্য এক মাত্রা যোগ করল আমার স্বপ্নের রাজ্যে। টুপটাপ বৃষ্টিতে আমি চলেছি শাপলার লাল গালিচা বেছানো পথে। ছুঁয়ে দেখছি শাপলা, অনুভব করছি, লোভ সামলাতে না পেরে একটা শাপলা মাথায় গুঁজেই ফেললাম। বৃষ্টি খুব তেড়ে আসার আগেই পৌঁছাতে হল নিরাপদ স্থানে।
বিলের ধারেই এক বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিলাম বৃষ্টি থামার আশায়। সেখানেই শুরু হল আড্ডা। বাড়ির লোক জন অতিথি পরায়ণ আর মিশুক। বেশ গল্প জমে উঠল তাদের সাথে। শুধু গল্পই নয় চলে আসার আগে প্রতিজ্ঞা করে আসতে হল যে আবার এলে এই বাড়িতেই রাতে থাকতে হবে, তাহলে আমরা ঘুম ভেঙ্গেই জানালা দিয়ে দেখতে পাব শাপলা বিলের স্বর্গীয় সৌন্দর্য। বৃষ্টি থামলে বেলা বেশ গড়িয়ে এলো, বৃষ্টির কান্নায় শাপলারা বন্ধ করে দিল হাসিমুখ তাই সেদিনের মত ফিরে আসতে হল আমাদের কিনতে সাথে নিয়ে এলাম স্বপ্নপূরণের দারুণ কিছু মুহূর্তের স্মৃতি নিয়ে।
কিছু রঙিন স্মৃতি জমাতে আপনিও যেতে পারেন শাপলা বিল ভ্রমণে। তবে যেকোন সময়ে গেলে কিন্তু হবে না। শাপলা ফোটার নির্দিষ্ট সময় আছে সেই সময়েই যেতে হবে আপনি যদি দিগন্ত বিস্তৃত বিলে শাপলার হাসিমুখ দেখতে চান। ভরা বর্ষায় যখন বিলগুলো পানিতে পূর্ণ হয় তখন শাপলা গাছ গুলো বাড়তে শুরু করে আর অল্প কিছু শাপলা ফোটে। বর্ষা শাপলার ঋতু নয় তাই বর্ষায় শাপলার দেখা পেতে পারেন তবে শাপলার লাল গালিচা পাবেন না।
সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর অগণিত শাপলার হাসিমুখ দেখতে পাবেন আপনি বিলগুলোতে। তাই প্রিয়জনকে নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর ফুলেল একটি ভোর কাটাতে ঠিক সময়ে ঘুরে আসুন সাতলার অপূর্ব শাপলা বিল । তবে আপনি যখনই যান না কেন, বিলে পৌঁছাতে হবে ভোরে। বরিশাল নদীবন্দর থেকে সাঁতলা পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘন্টা তাই ভোর ৪ টায় রওনা দিলে ৬টার মধ্যে বিলে পৌঁছে উপভোগ করতে পারবেন লাল শাপলার আকর্ষণীয় সৌন্দর্য। রোদ উঠে গেলেই ঘুমোতে শুরু করে শাপলারা। শাপলা বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করেন যারা, তারাও ভোরে শাপলা তুলতে শুরু করেন, বাজারে নেবেন বলে। তাই বিলে যেতে হবে সূর্য উঁকি দেবার সাথে সাথেই।
দেরী করছেন কেন? আপনি পরিকল্পনা করে ফেলুন কবে যাবেন সাতলার অপূর্ব শাপলা বিল দেখতে। ভাবছেন কিভাবে যাবেন? জানিয়ে দিচ্ছি কিছু সহজ রাস্তা, দেখুন কোনটা সহজ হয় আপনার জন্য।
প্রথম রুট-বরিশাল লঞ্চ ঘাট থেকে একটা অটো রিকশা নিয়ে চলে যান নথুল্লাহবাদ বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে সাতলা বাস ছাড়ে। সময় লাগবে ২ ঘন্টা। ভাড়া জনপ্রতি ৯০ টাকা। এছাড়া আপনারা যদি ৫ জনের দল হন রিজার্ভ করতে পারেন একটা সিএনজি। ইচলাদি-উজিরপুর-ডাবেরকুল-ওটরা-সাতলা এই নতুন আর সুন্দর রুটটা ধরে ৫০ মিনিটের মতো সময়ে পৌঁছে যাবেন সাতলা। আমরা সিএনজি ভাড়া দিয়েছিলাম ৭০০ টাকা। আপনি দামাদামি করতে পারলে এর কমে হয়ত পাবেন আবার অবস্থাভেদে বেশিও নিতে পারে।
২য় রুট- ঢাকা থেকে বরিশালের লঞ্চে না উঠে আপনি উঠুন পয়সারহাট বা আগৈলঝরার লঞ্চে। বরিশালের ১০ উপজেলার একটি আগৈলঝরা। এখান থেকে ভ্যানে চলে আসুন সোজা সাতলা।
৩য় রুট-আপনি সাতলা যেতে পারেন গোপালগঞ্জ হয়েও। ঢাকা থেকে ৩০০/৩৫০ টাকা লাগবে গোপালগঞ্জের বাস ভাড়া বাবদ। সেখান থেকে অটোতে করে সোজা সাতলা গ্রামে পৌঁছে যাবেন। আমরা ফেরার সময় এই পথে ফিরেছিলাম। অটো ভাড়া দিয়েছিলাম ৩০০ টাকা।
মনোরম এই এলাকাটিকে সর্বপ্রথম প্রচারের আলোয় নিয়ে আসেন সাংবাদিক আরিফ রহমান। তাঁর তোলা ছবি এবং খবরের কারণেই সাতলা এখন এক জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এখন এখানে সুবিধাজনক বড় আকারের নৌকাও পাবেন যাতে এক নৌকায় ৫/৬ জন ওঠা যায়। নৌকা ভাড়া নিতে পারে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।