প্রচন্ড শীত, ঘন কুয়াশা, রাত প্রায় ৪.৩০ বাজে, এমনি সময় বাস আমাদের নামিয়ে দিল বরইতলি মোড়ে। মোড়ের দোকানপাট সব তখন বন্ধ। শুনশান নীরবতা চারদিকে। গ্রাম্য অচেনা পরিবেশ। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিলো । ভয়টা কটলো কিছু CNG ও CNG চালক দেখে। তারাও আমাদের মতো ভোরের আলোর অপেক্ষায় রয়েছে।
যাচ্ছি কুতুবদিয়া দ্বীপে যা কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। যার চার দিকে সাগর। এর আয়তন ২১৫.৮০ বর্গ কিলোমিটার। রয়েছে ৬টি ইউনিয়ন। সমুদ্রের বুকে দ্বীপটি জেগে উঠে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ধারণা করা হয়, পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই দ্বীপে মানুষের পদচারণা শুরু হয়।
শীতের সকাল, সূর্যের লাল আভা তখনো অদৃশ্যমান, ভোরের হাল্কা আলোয় CNG ঠিক করে নিলাম উদ্দেশ্য মগনামাঘাট। এই ঘাট থেকেই ডেনিশ বোটে যেতে হবে কুতুবদিয়া। প্রতিদিন সকাল ৭ টা থেকে ১ ঘণ্টা পর পর একটি করে লোকাল বোট ছেড়ে যায় কুতুবদিয়ার দিকে। তাই আমাদের যেতে হবে একটু দ্রুত কারণ আমাদের সকালের প্রথম ঘাট ধরতে হবে।
৭ টা বাজতে এখনো কিছু সময় বাকী। ঠাণ্ডা বাতাস, কনকনে শীত, জেটির উপর দাঁড়িয়ে থাকাই কষ্টকর। সূর্যের লাল আভা ঘন কুয়াশা ভেদ করে রুপালী আলো ধারণ করে এসে পড়েছে সাগরের জলে। এখান থেকে কুতুবদিয়া খালি চোখে দেখা গেলেও ঘন কুয়াশার কারণে তা অদৃশ্য। উঠে বসলাম বড়ঘোপ বাজার ঘাটগামী ডেনিশ বোটে। কুতুবদিয়ায় দুইটা ঘাট, একটি বড়ঘোপ বাজার ঘাট, অন্যটি দরবার ঘাট। এই মগনামাঘাট থেকে প্রতি ঘন্টায় একটা বোট বড়ঘোপ বাজার ঘাটে এবং আরেকটা বোট দরবার ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। যারা ঘুরতে যাবেন তারা আমাদের মতো বড়ঘোপ বাজার ঘাটগামী বোটে চড়ে বসবেন কারণ এটিই উপজেলা বাজার, এখানেই পাবেন থাকার মতো হোটেল ও রেস্টুরেন্ট।
মূল ভূখণ্ড থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত স্থানটুকুকে বলা হয় কুতুবদিয়া চ্যানেল। বর্ষায় এই চ্যানেলটি খুব উত্তাল থাকে। কিন্তু এই শীতে ? সে আলোচনা যথা সময়েই করবো ইনশাল্লাহ।৩০ মিনিট সাগরের ঢেউ ভেঙ্গে বোট আমাদের নামিয়ে দিল বড়ঘোপ বাজার ঘাটে। ঘাট থেকে রিকশা নিয়ে সোজা চলে যাই বড়ঘোপ বাজারে “সমুদ্র বিলাস” হোটেলে চেকইন করতে। ভালোমানের একটি হোটেল। একেবারে বীচের সাথে। হোটেল থেকে সাগরের দারুণ একটি ভিউ পাওয়া যায়।
দাঁড়িয়ে আছি কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকতে, আকাশে সূর্য ঝলমল করছে কিন্তু প্রকৃতি এখনো কুয়াশার দখলে। সাগর থেকে বয়ে আসছে ঠাণ্ডা বাতাস। সমুদ্র সৈকত টি দ্বীপের পশ্চিম দিকে অবস্থিত যা উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। নির্জন একটি বীচ, আমরা ছাড়া বাইরের আর কোন পর্যটক চোখে পড়েনি। চোখে পড়লো গাংচিলের দিগ্বিদিক ছুটে চলা আর পুরো সৈকতটি যেন লাল কাঁকড়ার দখলে। সৈকতের উত্তর দিকে বীচ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। চোখে পড়লো জেলেদের কর্মব্যস্ততা। কেউ ট্রলার নিয়ে সাগরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে কেউবা ছিঁড়ে যাওয়া জাল মেরামতে ব্যস্ত, যাদের বেশিরভাগই বয়সে কিশোর। রয়েছে বীচের পাশে বেশ কয়েকটি শুটকি পল্লী। সৈকতের পাশে বেশ কিছু জায়গায় রয়েছে ঝাউ গাছের সারি। কিশোরেরা বীচের পানিতে ভেলা নিয়ে মেতে উঠেছে কৈশোরের দুরন্তপনায়। এমনি মন মাতানো অপরুপ সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে কখন যে হেঁটে চলে এসেছি ৩ কিলো টেরই পাইনি। আর কিছুদূর বীচ ধরে হেঁটে গেলেই কুতুবদিয়ার বিখ্যাত বাতিঘর। এবার বীচ থেকে গ্রামীণ পথ ধরে চলে আসি মূল সড়কে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কুতুব আউলিয়ার দরবার।
মূল সড়ক দিয়ে লোকাল জিপে দরবার মোড়, দরবার মোড় থেকে রিক্সায় ধুরং এলাকায় অবস্থিত কুতুব আউলিয়ার দরবারে আসি। ১৯১১ সালে তিনি এখানেই জন্মগ্রহণ করেন । ২০০০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে (৭ ফাল্গুন) এখানে হাজারও ভক্তের সমাগম ঘটে । আমাদের দেশে প্রতিটি মাজারে ইসলামের নামে ইসলাম বিরোধি যে সমস্ত কাজ সংঘটিত হয় এটিও তার বাহিরে নয়। কথিত আছে কুতুবদিয়ার নামকরণ হয়েছে কুতুব আউলিয়ার পূর্ব পুরুষদের নামানুসারেই।
রিক্সা চেপে আমদের এবারের গন্তব্য কুতুবদিয়ার বিখ্যাত বাতিঘর। সমুদ্রপথে চলাচলকারী জাহাজের নাবিকদের পথ দেখাতে তথা জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্নে করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮২২ সালে কুতুবদিয়ার বর্তমান দক্ষিণ ধুরং এলাকায় বাতিঘরটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হেয়ার-এর পরিচালনায় এবং ইঞ্জিনিয়ার জে এইচ টুগুড -এর নকশায় ১৮৪৬ সালে এটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। সমুদ্রের ভাঙ্গনের মুখে পুরানো সেই বাতিঘরটি বিলীন হয়েছে বহু বছর আগে। তবে পুরানো বাতিঘরের এলাকায় সমুদ্র সৈকত পাড়ে নতুন একটি বাতিঘর তৈরি করা হয়েছে।
কুতুবদিয়ায় আপনার দৃষ্টি সীমায় একটু ভিন্নতা আনবে লবণ ক্ষেত। শীতে কুতুবদিয়ার বিস্তীর্ণ জমি জুড়ে চাষ হয় লবণ। দ্বীপের যতটুকু ঘুরে বেড়িয়েছি সর্বত্রই চোখে পড়েছে কৃষকদের লবণ চাষের ব্যস্ততা। সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্তমান। শীতকাল তাই,তার বিদায় নেয়ার তাড়াটাও একটু বেশি। এসে দাঁড়ালাম বেড়িবাঁধের উপর পাশেই দেশের সবচেয়ে বড় বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র যা বড়ঘোপ বাজারের দক্ষিণে তাবলারচর গ্রামে সমুদ্র সৈকতের পাড়ে অবস্থিত। গোধূলি লগণ, নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, ধীরে ধীরে আগুন বর্নের সূর্য টা ডুবে যাচ্ছে সাগরের ঐ বিশাল বুকে। কুতুবদিয়া আসলে,অবশ্যই সূর্য অস্ত দেখবেন নয়তো বড় ধরণের মিস করে ফেলবেন।
জ্যোৎস্নাময়ী মধ্য রাত । ঠাণ্ডা বাতাস। বসে আছি বীচের পাশে। পুড়ো দ্বীপ ঘুমিয়ে আছে, শুধু জেগে আছে সৈকতে অবিরাম আছড়ে পড়া ঢেউ আর আমরা। দূরে সাগরে নোঙর করে রাখা জাহাজ আর মাছ ধরার ট্রলারের মিটি মিটি আলো যেন সৌন্দর্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে যে সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই । দু চোখে রাজ্যের ঘুম ভর করে আছে কিন্তু হোটেলে যেতে পারছি না কারণ উপরে জলজল করছে গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না। গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না বড়ই ভয়ানক জিনিস যার ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই।
সকাল ৯ টার ঘাট ধরতে হবে তাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা সেরে যথাসময় চলে আসি বড়ঘোপ বাজার ঘাটে। ঘাটে এসেতো চক্ষু চড়কগাছ। ছোট ডেনিশ বোটে ৬০ থেকে ৭০ জন যাত্রী। বোটে পা ফেলার যায়গা নেই। নেই কোন লাইফ জ্যাকেট। প্রচণ্ড বাতাস। আল্লাহর নাম নিয়ে উঠে বসলাম বোটে। সাগরে প্রচণ্ড ডেউ। পাশের যাত্রীকে জিঙ্গেস করলাম শুনেছি বর্ষায় এই চ্যানেলটি খুব উত্তাল থাকে কিন্তু শীতেও কি এমন থাকে। তিনি বললেন আজকে একটু বাতাস বেশি। আহারে বাতাস। বোটের সামনের অংশ যখন ঢেউয়ের উপর আছড়ে পড়ছে আমরা বোটের সামনে বসা যাত্রীরা পানির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছিলাম। আর বোট ঢেউয়ের তোড়ে যখন ডানে বামে কাত হচ্ছিলো মনে হচ্ছিল যেন এই বুঝি ডুবে যাবে। মাঝি ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বোটের স্পীড বাড়াচ্ছে আর কমাচ্ছে। আমরা ভয়ে ঝিম মেরে বসে আছি কিন্তু বোটে থাকা দ্বীপের অন্যান্য যাত্রীদের চেহারায় বিন্দুমাত্র ভয়ের চিহ্ন নেই। আমার কাছে এ যেন ৩০ মিনিটের এক ভয়ংকর যাত্রা।
লেখা ও ছবি: আরিফুল রাজিব, ঘুরাঘুরিই যার নেশা, বই পড়া শখ, ভালোবাসেন সাইক্লিং। স্কুল জীবন থেকেই যার ঘুরাঘুরি শুরু। কখনো সাগর, কখনো নদী, কখনো পাহাড়, কখনোবা ঐতিহ্যের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের ৬৪ জেলা। হেঁটেছেন পুরো সমুদ্র সৈকত— টেকনাফ থেকে কক্সবাজার। প্রতিনিয়তই দেখেন নতুন নতুন ভ্রমণ স্বপ্ন।।পড়াশোনা শেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হিসাব রক্ষকের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকার পরেও থেমে থাকেনি তার পথ চলা।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।