আশ্বিন মাস, ঘড়িতে সময় ৩ টা। ক্লান্ত দুপুর, মাথার উপর সুর্য ঝাঁ ঝাঁ করছে, এমন সময় আমরা পৌঁছলাম ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী চিলমারী বন্দরে। হ্যাঁ, ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের গাওয়া সেই বিখ্যাত “ওকি গাড়িয়াল ভাই… হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দর রে ” গানের সেই চিলমারী বন্দর। চিলমারী বন্দরের নাম শুনে এই গানটি মাথায় আসবে না এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া কঠিন।
চিলমারী বন্দরের অবস্থান কুড়িগ্রাম জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে চিলমারী উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। ব্রহ্মপুত্র হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপত্তি হয়ে তিব্বত ও আসামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
সামনে বিশাল ব্রহ্মপুত্র। ভরা মৌসুম, নদের পানি টইটম্বুর। বন্দরের জেটিতে এসে দাঁড়ালাম। আকাশে ঝলমলে রোদ। রোদ গায়ে লাগছে না কারণ নদের উপর থেকে ভেসে আসছিল হিম শীতল প্রাণ জুড়ানো বাতাস। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ব্রহ্মপুত্রের পানে। আমার মতো ময়মনসিংহ অঞ্চলের অর্ধমৃত ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বেড়ে ওঠা মানুষের জন্য প্রথম এই ব্রহ্মপুত্র দেখে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। দূরে নদের মাঝে যখন বিশাল চরগুলো দেখছি তখন দূরে বহু দূরে মেঘে ঢাকা মেঘালয়ের বিশাল পাহাড় গুলো দৃষ্টি কেড়ে নিল। বিশাল জলরাশির উপর ভাসমান ছোট তরী, মাঝে জেগে ওঠা ভুখন্ড তার ওপারে মেঘের ভিতর থেকে উঁকি মারছে মেঘালয়ের আকাশছোঁয়া পাহাড় এক ফ্রেমে, এ যেন জয়নুলের রঙ তুলির আঁচড়। দিনের আলোয় কি অসাধারণ এ দৃশ্য, না জানি গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নায় এ সৌন্দর্যের মাত্রা কতো ভয়ানক!
বন্দরের কাছে আসতেই চোখে পড়লো জেটি। যার পাশে কিছু মাঝারি আকৃতির ট্রলার, বোঝা যাচ্ছিল এগুলো দিয়ে বিভিন্ন চর অঞ্চলে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করা হয়। রয়েছে নদীর তীর রক্ষাকারী বাঁধ। নদীতে নামার জন্য বাঁধানো ঘাট আর পাশেই সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা “চিলমারী নদী বন্দর’। কোন রকম কর্ম ব্যস্ততা চোখে পড়লনা। স্থানীয় একজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম এখান থেকে রৌমারী, রাজিবপুর সহ বেশ কিছু চর অঞ্চলে ট্রলার চলাচল করে। এখানে নদীর প্রশস্ততা কতটুকু জানতে চাইলে বিষয়টা তিনি জানাতে না পারলেও বললেন ট্রলারে ওপারের রৌমারী পর্যন্ত যেতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের মতো। আমি গুগল ম্যাপ খুলে জানার চেষ্টা করলাম তাতে মনে হলো এখানে নদীর প্রশস্ততা যমুনা সেতুর চাইতে কয়েক গুণ বেশি কারণ যমুনা সেতুর নিচে বড় কোন চর চোখে না পড়লেও এখানকার ম্যাপে বিশালাকার কিছু চর দৃশ্যমান।
মেজর জেমস রেনেল একজন ব্রিটিশ ভূ-বিদ। বাণিজ্যিক নৌপরিচালনার সুবিধার্থে তিনি সর্বপ্রথম বাংলার নদী অববাহিকা নিয়ে মানচিত্র অঙ্কন করেন। ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্রে চিলমারী ও উলিপুরের নাম স্পষ্ট, যেখানে কুড়িগ্রামের নামই নেই। রেনেলের মানচিত্রে দেখা যায় ব্রহ্মপুত্র নদ তখন জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরববাজারের দক্ষিণে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছিল। তখন বর্তমান যমুনা ছিল না। ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্প ও বন্যায় ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদীর উৎপত্তি হয়ে মূল ধারাটি চলে যায় আর দেওয়ানগঞ্জ থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত এইটুকু হয়ে যায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র।
এক সময় আসামের সাথে বাংলার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিলো এই চিলমারী বন্দর। পাটের জন্য বিখ্যাত ছিলো চিলমারী বন্দর। বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার গরুর গাড়িতে করে পাট আনা হতো এই বন্দরে। এখান থেকে পাট জাহাজে করে পাঠানো হতো দেশের বিভিন্ন স্থানে। সে সময় আসামের সঙ্গে ফেরী সার্ভিস চালু ছিল। শত শত গরুর গাড়ির পদচারণা ও শ্রমিকের কর্ম ব্যস্ততায় মুখরিত ছিলো এই চিলমারী বন্দর।
দিনের আলো বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, চা হাতে বসে আছি জেটির উপর। দৃষ্টিতে জলরাশি। মুঠোফোনে বাজছে আব্বাসউদ্দিনের সেই “ওকি গাড়িয়াল ভাই… হাঁকাও গাড়ি তুই চিল মারির বন্দরে”। আহ কতই না দরদ দিয়ে গানে গানে তুলে ধরেছেন গাড়িয়াল ভাই… ও তাদের বউদের আকুতি। সেই গাড়িয়াল ভাইরা হয়তো এখন আর নেই কিন্তু তারা বেঁচে থাকবে যুগের পর যুগ আব্বাসউদ্দিনের সুরে। দিনের আলোর সাথে আমাকেও এবার যেতে হবে, হয়তো আবার আসবো কোন এক চৈত্রের ঝলমলে রোদে, শরতের মায়াবী জ্যোৎস্নায় নয়তো পৌষের হাঁড়কাপানো শীতে। ভালো থেকো চিলমারী।
লেখা ও ছবি: আরিফুল রাজিব।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

খুব সুন্দর লেখা। লেখকের নদীর প্রবাহপথ নিয়ে স্পস্ট ধারণা প্রসংশার দাবি রাখে।
অনেক ধন্যবাদ ভাই… এমন আরো তথ্যবহুল লেখা আপনাদের সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টা থাকবে সবসময়.. :)