সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটায় গিয়েছিলাম এক পূজার ছুটিতে। দূর্গাপূজার ছুটিতে শুক্র শনি মিলিয়ে চার দিন অফিস বন্ধ আমার। ভেবেছিলাম আরো দুদিন অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে ভারতের সান্দাকফু ঘুরে আসব। সেই সময় ই-টোকেনের প্যাঁচে পড়ে ভিসার জন্য আবেদনই করতে পারলাম না। ছুটি পাবার পরও সেই ছুটি বাতিল করতে হলো আমাকে। কিন্তু ছুটির এই চারদিন কি ঘরে বসে কাটাবো? দূর্গা পূজা উপলক্ষে সব ভ্রমণ গন্তব্যেই হবে উপচে পড়া ভীড় তাই কোথায় যাওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই মনে হল সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটাকে এক নজর দেখে আসি। রাশ উৎসবের জন্য বিখ্যাত কুয়াকাটা। রাশ পূর্ণিমায় হাজার হাজার মানুষ এখানে ভীড় করেন সমুদ্রে পূন্যস্নান করার জন্য। বেশ কবার রাশমেলার সময় কুয়াকাটা ভ্রমণের পরিকল্পনা করলেও সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি। তাই কুয়াকাটাতেই এবারের মত জিপিএস সেট করলাম। আর কুয়াকাটার এক অনন্য বৈশিস্ট হলো এই সমুদ্রে সূর্যোদয় এবং সুর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। এই অভাবনীয় প্রাকৃতিক ঘটনা দেখবার জন্যও মন ছুটে যেতে চাইছিল কুয়াকাটাতে।
সে সময় কুয়াকাটা যাবার জন্য সরাসরি কোন বাস ছিলনা। রাস্তায় বেশ কটা নদী পার হতে হত যার সব গুলিতে তখনো ব্রীজ তৈরী শেষ হয়নি। তাই লঞ্চে করেই রওনা হলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিকল্পনা করা তাই লঞ্চে ওঠার পর দেখা গেল আমরা দলে আছি ৮ জন। এই ৮ জনে শুরু হল নানান রকম হৈ হুল্লোড়। অনেক দিন পর যাচ্ছি লঞ্চে করে, অনেকে প্রথম উঠেছে লঞ্চে তাই সবার উচ্ছাসের মাত্রাটাই অন্যরকম। লঞ্চের ছাদে স্লিপিং ব্যাগ বিছিয়ে চলল আড্ডা। রাত গভীর হতেই কখন ঘুমে ঢলে পড়েছি জানিনা হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি মাথার ওপর কালো আকাশ, লম্বা দু-তিনটে পোলের মাথা থেকে লাল আলো বের হয়ে এসেছে। শুয়ে থাকা অবস্থায় আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমি কোথায়। আকাশটাকে মনে হচ্ছিল কোন সিনেমার শুটিং এর সেট। আচম্বিতে টের পেলাম আরে আমিতো লঞ্চের ছাদে। সেখান থেকে দেখলাম চাঁদের অস্ত যাওয়া। চন্দ্রাস্ত সূর্যাস্তের মতই দারুণ সুন্দর। অস্তগামী চাঁদের রুপালী আলোয় চিকচিক করতে থাকে নদীর পানি সেই পানি দেখে চোখের কোণেও জমতে থাকে রুপালি পানি।
ভোর চারটাতেই বরিশাল পৌঁছে গেলেও অপেক্ষা করলাম দিনের আলো ফুটবার। শুনেছি বরিশাল ভালো জায়গা নয়, নামার সময়ও অনেক ভীড় হয় তাই হুড়োহুড়ি না করাই ভালো। ভোরের আলো ফুটলে নেমে এলাম লঞ্চ থেকে। নেমে শুনি কুয়াকাটা যাবার সব বাস, যাত্রী নিয়ে চলে গেছে। আমাদের এখন মাইক্রোবাস রিসার্ভ করে যেতে হবে কুয়াকাটা।
সুযোগ বুঝে মাইক্রোবাস মালিকও অনেক বাড়িয়ে চাইল দাম। আমাদের মধ্যে একজন আবার ঘোষণা দিল সে বাড়ি ফিরে যাবে কারণ বাড়িতে তার বিড়াল রেখে এসেছে, তার অনুপস্থিতিতে বিড়াল হয়তো ঠিকমত খাবার পাবেনা তাই তার ফিরে যেতে হবে। দল হয়ে গেল ৭ জনের। এই ৭ জন মিলে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে মাইক্রোবাসে গেলে ট্যুরের বাজেটই শেষ হয়ে যাবে তাই বিকল্প কোন উপায় খুঁজছিলাম। এই অবস্থা শুধু আমাদের নয়। আরো দুটো দল পেলাম যাদের একই অবস্থা। সবাই মিলে আমরা ৩০ জনের মত হওয়াতে একটা বাস রিজার্ভ করে রওনা হলাম কুয়াকাটা। তাতে অবশ্য সাধারণ ভাড়ার চাইতে সামান্য কিছু বেশী পড়েছিল ভাড়া।
দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কুয়াকাটা। সরকারী এক বাংলোতে দুটো রাতের জন্য বুকিং দিয়ে রাখা হয়েছিল পরিচিত এক সরকারী অফিসারের সাহায্যে। সেখানে পৌঁছে শুরু হল নতুন বিড়ম্বনা। বুকিং দেওয়া হয়েছিল ফোনে। আমরা যে তারিখ বলেছি তারপরের দুই দিন বুকিং দেওয়া আছে। তাহলে আজ রাতটা আমরা থাকবো কোথায়???
পূজার ছুটিতে আশে পাশের সবাই এসেছে সমুদ্র স্নানে। রুম ফাঁকা পাওয়া দায়। আমরা মেয়েরা অপেক্ষা করতে লাগলাম বাংলোর বারান্দায় আর ছেলেরা দুইভাগে ভাগ হয়ে দুইদিকে গেল রুমের খোঁজে। এক ঘন্টা পর দুই দলই বাংলোতে হাজির। কোথাও রুম ফাঁকা নেই। টিনের ঘরে চৌকি পাতা রুমও ৩০০০ টাকা ভাড়া চায়।
আমাদের সাথে একটা টেন্ট ছিল। কোথাও টেন্ট পিচ করবো কিনা ভাবছি অগত্যা সাথে থাকা রবি মামা জানালেন এখানে চারতলা এক হাসপাতালের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এটার হস্তান্তর এবং উদ্বোধন হবে। এটার চারতলায় ডাক্তারদের থাকার জন্য কিছু ঘর বানানো আছে। কেয়ারটেরারের সাথে কথা বলে সেখানে হয়তো থাকার ব্যবস্থা করা যাবে।
সবাই একটা ভ্যানে করে ছুটলাম ওদিকে। আমাদের দেখে কেয়ারটেকার রাজী হলেন থাকতে দিতে। পোটলা পাটলি নিয়ে আমরা চলে গেলাম চার তলায়। দুই পাশে ছটা করে বারোটা ঘর, প্রতিটার সাথে লাগানো টয়লেট। আমার ভীষণ ভালো লাগছিল, যেখানে থাকার জায়গাই পাওয়া যাচ্ছিলনা সেখানে ৭ জনের জন্য এখন ১২ টা আনকোরা ঘর। তবে ঘর ফাঁকা, কিছুই নেই। আমাদের সাথে স্লিপিং ব্যাগ ছিল কাজেই কোন অসুবিধা হলনা থাকতে। থাকা নিয়ে সমস্ত দুর্ভাবনা মিলিয়ে গিয়ে এবার খুশীতে মন ভরে উঠল। এই পুরো বিল্ডিং এ আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। কাউকে বিরক্ত না করেই ইচ্ছে মত চেঁচামেচি, হই হুল্লোড় করতে পারব আমরা।
থাকার ব্যবস্থাতো হল এবার কুয়াকাটা ঘুরে দেখার পালা। সাগরপাড়েই গড়ে উঠেছে নানান খাবারের হোটেল আর স্যুভিনিরের দোকান। আমার এক ছাত্রের পরামর্শে মা হোটেলে খেলাম।অনেক ভালো ছিল খাবার। প্রায় ২৪ ঘন্টা পরে এমন ভালো ভাত, ডাল, ভর্তা, মাছ পেয়ে সবাই পেটপুরে খেলাম। কুয়াকাটা ভ্রমণগন্তব্য হিসেবে নজর কেড়েছে খুব বেশীদিন হয়নি তারপরেও এখানে অনেক কিছুই বেশ নিয়ম মাফিক এবং সাজানো গোছানো মনে হল। কুয়াকাটায় কলাপাড়ায় মূল বিচের মোড়টাতে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই আপনার ধারণা হয়ে যাবে কুয়াকাটাতে দেখার কি আছে আর কিভাবে সেগুলো দেখতে যেতে হবে। দর্শনীয় স্থানের ছবি সব বিভিন্ন ভ্রমণ প্যাকেজের সাইনবোর্ড টাঙানোতো আছেই সেই সাথে সেখানে রয়েছে অনেক মোটর বাইকওয়ালা যারা অফার করবে কুয়াকাটা ঘুরিয়ে দেখানোর।
সেই কলাপাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমরা গল্প করছিলাম। পরিচিত সরকারী অফিসার দিয়ে বাংলো বুকিং করার পরেও আমরা কি ভেজালে পড়লাম সেসব নিয়ে কথা হচ্ছিল বেশ উচ্চস্বরেই। এসব শুনেই হয়ত এক টুরিস্ট পুলিশ এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন আমাদের কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। সরকারি কোন অফিসার আমাদের বন্ধু এটা ধরে নিয়েই হয়ত বেশ আন্তরিক ছিল তারা আমাদের সাথে। যেকোন সমস্যায় তারা আমাদের সাহায্য করবে এই আশ্বাস দিল।
কলাপাড়া বিচে কাঠের চেয়ারের সারি।
কলাপাড়া মোড় পেরিয়ে আমরা সোজা চলে এলাম সমুদ্রের ধারে। পাড় ঘেঁষে বিছিয়ে রাখা হয়েছে কাঠের লম্বা চেয়ার। প্রতিটি চেয়ারের সাথে আছে একটি করে ছাতা। এখানে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলাম একটু। পায়ের সামনে আছড়ে ভেঙে পড়ছে সমুদ্রকন্যা। যেন প্রথম দেখা পেয়ে ভীষণ আহ্লাদিত। ভরপেট খেয়ে এখন এইটুকু সুখ খুব দরকার ছিল। তীব্র রোদ তাই দুরন্ত ঢেউয়ের ডাক সেরকম করে ডাকছিল না। চেয়ারে ছাতার ছায়ায় বসে মৃদুমন্দ বাতাসে একটু নিজের মনে ডুব দিতেই বেশি ভালো লাগছিল।
কক্সসবাজারের মত এখানেও আছে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। আপনাদের স্মরণীয় মুহূর্তগুলো ছবিতে ধরে রাখতে সাহায্য করবে এই সব ফটোগ্রাফার। ডিজিটাল এই যুগে মোটামুটি সবার কাছেই ক্যামেরা আছে। আর সবার ফোনের ক্যামেরাতো আছেই তাই এসব ফটোগ্রাফারের তেমন কদর নেই। তবে সাথে কেউ না থাকলে প্রিয় মুহূর্তগুলো ধরে রাখার জন্য এদের বিকল্প নেই। আবার আপনার অজান্তেই আপনার এমন দারুণ সব ছবি তুলবে যা আসলে বন্ধুদের ক্যামেরা থেকে পাবেন না আপনি। এই বীচে আছে ঘোড়া। এই সব ঘোড়ার পিঠে চড়ে আপনি ওয়েস্টার্ন নায়ক নায়িকাদের মত ঘুরে বেড়াতে পারবেন সমুদ্রতীর ধরে। কেউ কেউ চা কফি বা কোমল পানীয় নিয়ে ঘুরছে। কারো কাছে আছে চিপস বা বাদাম ভাজা। কেউ জানতে চায় ডাবের পানি খাব কিনা।
কলাপাড়া বিচে চলছে সমুদ্রের সাথে মিতালি।
চেয়ারে আপন মনে বসে থাকার উপায় নেই এই সব হকারদের যন্ত্রণায়। একটু পর পর একেক জন এসে জিজ্ঞাসা করবে আপা ছবি তুলবেন? অথবা চা কফি খাব কিনা বা বাদাম ভাজা লাগবে কিনা। এর মাঝেই একটু তন্দ্রা দিয়ে উঠে পড়লাম চেয়ার ছেড়ে। কুয়াকাটায় সবচেয়ে সুন্দর সূর্যাস্ত নাকি লেবুর চরে দেখা যায়। সেখানেই যাব আজকের সূর্যাস্ত দেখতে।
সমুদ্রের পাড়ের চেয়ার ছেড়ে ওঠে রওনা হলাম লেবুর চরে। কুয়াকাটার নানান দর্শনীয় জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে মোটর বাইক। এছাড়া আর কোন গণপরিবহনের সুবিধা নেই এখানে। তবে আমরা ভ্যানে করে রওনা হলাম লেবুর চরের দিকে। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে দারুণ ছিল সেই ভ্যান যাত্রা। লেবুর চরে আমরা পৌঁছলাম একে বারে ঠিক সময়ে। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে প্রায়। শরতের নীল আকাশের সূর্যের লালচে আভায় মাখামাখি হয়ে আছে আকাশ। সিঁদূরে মেঘের অক্লান্ত আনাগোনা চলছে। যেন গোধূলীর রঙে হল এ ধরণী স্বপ্নের দেশ!! মনে মনে গুনগুন করতে লাগলাম হেমন্তের বিখ্যাত গান সূর্য ডেবার পালা আসে যদি আসুক বেশতো। গানের কথা মতই যেন তারপরে পৃথিবীতে আধারের ধূপছায়া নেমে এল। সমুদ্রের পাড়ে ডুবে থাকা একটি একাকী গাছ দাঁড়িয়ে ছিল। সেই আলো আঁধারিতে ভীষণ আপন মনে হচ্ছিল সেই গাছটাকে।
লেবুর চরে একাকী গাছ।
লেবুর চরে সমুদ্রের মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদি বিক্রি হয়। দামও সহনীয়। পেটপুরে খেলাম মাছ আর কাঁকড়া। বেশ ভীড় এখানে। অর্ডার করে খাবার পেতে বেশ সময় লাগল কিন্তু সমুদ্রের ধারে বসে গল্প করতে করতে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে সময় কিভাবে যেন কেটে গেল। খাওয়া শেষে ফিরে এলাম কুয়াকাটা বীচে।
সারাদিনের নানান ঝক্কি ঝামেলা, রোদের তেজ ইত্যাদির জন্য সাগরে নামা হয়নি এখন আর সামলে রাখা গেলনা। পাড়ে পৌঁছেই ঝাপিয়ে পড়লাম সমুদ্রের বুকে। আকাশে নতুন কোজাগরীর চাঁদ। রুপালী আলোর প্রতিফলনে চিক চিক করছে সমুদ্রের পানি। কিছু অপার্থিব সময় কাটলো সমুদ্রের বুকে। বেশী রাত হলেও সমস্যা নেই, এখানে আছে টুরিস্ট পুলিশ যাদের সাথে আমাদের ইতোমধ্যে আরও এক বার দেখা হয়েছে। তারা আশ্বাস দিয়েছেন আমাদের কোন সমস্যা হবে না। পুজার ভিড় উপলক্ষে তারা বেশ সক্রিয়। তাদের বদৌলতে এখন সমুদ্রের ধারে বেশ রাতেও হাঁটা যায়। ফিরে এলাম হাসপাতালে। দিনের বেলায় অতটা বোঝা যায় নি কিন্তু রাতের নিস্তব্ধায় ভেসে আসতে লাগল সমুদ্রের গর্জন। সমুদ্রের গর্জনের গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম কখন টেরও পেলাম না।
পরদিন একটা ট্রলারে করে গেলাম টেংরাগিরি সংরক্ষিত বন বা ফাতরার বন, লাল কাঁকড়ার চরে। সাগরের বুক চিরে ট্রলার চলল লাল কাঁকড়ার চরের উদ্দেশ্যে। চরে যখন নৌকা ভিড়ল তখন দেখলাম লাল রঙের একটা দ্বীপ এটা। অদূরে ঘন সবুজ ঝাউবন। দ্বীপে নামার সাথে সাথে লাল চর সাদা বালুর চর হয়ে গেল। সাদা বালির চরটাতে লাল কাঁকড়া এমন ভাবে বিচরণ করছিল যে চরটাকে মনে হচ্ছিল লাল রঙের। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সাথে সাথে বালির গর্তে ঢুকে গেল সব। তাড়া করেও দু একটাকে ধরা গেলনা। অনেক বকের দেখা মিলল এখানে। আরো দুএকটা নাম না জানা পাখি দেখে সাথে থাকা ফটোগ্রাফাররা তাদের ফ্রেম বন্দী করতে ভুললেন না। সবুজ ঝাউবনে হেঁটে বেড়ালাম অনেকক্ষণ। শহর থেকে অনেক দূরে এই প্রকৃতির বুকে এইটুকু হাঁটাতেই আমার সব সুখ।
কাঁকড়ার চরের ঝাউ বনে।
কাঁকড়ার চর থেকে গেলাম টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনে। এই বনটি বরগুনা জেলার অন্তর্ভুক্ত। এটি ম্যানগ্রোভ বন। অদূরে দেখা যায় সুন্দরবনের একাংশ। টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনও অনেকটা সুন্দরবনের মতই। বৈচিত্রপূর্ণ গাছগাছালিতে ভরা এ বন। কাদা পথ মাড়িয়ে বেতের বনের ভিতর দিয়ে বেশ খানিকটা গেলাম। আমরা এসেছি নদী দিয়ে, কিন্তু এটার আরেক পাশে সমুদ্র। সমুদ্র পর্যন্ত যাবার পথটুকুতে এতো কাদা যে, ওই পথ মাড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করলনা সমুদ্রের পাড়ে।বনের ভিতরে দারুণ সুন্দর মিঠা পানির পুকুর আছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে সেই শান্ত পুকুরের ধারে আড্ডা চলল অনেকক্ষণ।
টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনে বেত বনের মাঝে দিয়ে হেঁটে যাই।
শুঁটকি বানানো হচ্ছে।
এক চরে নেমে দেখলাম সেখানে অনেক জায়গা জুড়ে চলছে শুঁটকি বানানো। জেলেরা মাছ ধরে এনে শুঁটকি করতে দিচ্ছে। এখান থেকে চাইলে শুঁটকি কেনাও যায়। কিছু কিছু মাছ ধরে বাজারে নেবার জন্যও নিয়ে যাচ্ছে। এই কুয়াকাটা থেকেই গভীর সমুদ্রে নৌকা যায় মাছ ধরতে। সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে যাওয়া সম্ভব মাঝিদের এই মাছ ধরা নৌকা করে। একবার অবশ্যই এখানে যেতে হবে ডলফিনের খেলা দেখতে। কুয়াকাটার পশ্চিমে রয়েছে পায়রা এবং বিষখালী নদী, পূর্বে রয়েছে আগুনমুখো নদী, এ তিন নদীর মোহনায় কাটালাম কিছুটা সময়।
টেংরাগিরির ভিতরের পুকুর।
কুয়াকাটায় ফিরে এলাম মাথার ওপর তপ্ত সূর্য নিয়ে। তাই দুপুরে খাবার পর একটু বিশ্রাম নেওয়ার কোন বিকল্প ছিলনা। কিন্তু বেশীক্ষণ সুখ কপালে সইল না। বাইকওয়ালারা এসে হর্ণ বাজাতে শুরু করল তারা আমাদের নিয়ে যাবে রাখাইন পল্লীসহ আরো কিছু জায়গায়। সময়ের সদ্ব্যবহার করতেই জোর করে বেরিয়ে পড়লাম বাইকে করে মিশ্রী পাড়া বৌদ্ধ মন্দির আর রাখাইন পল্লী ঘুরতে যাবার জন্য। বৌদ্ধ মন্দিরের ভেতরে আছে গৌতম বুদ্ধের বেশ বড় একটা মূর্তি। এই মন্দিরের পেছনেই দেখা মিলল একটা কুয়োর। শুনেছি আরাকানরা এই অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করার পরে পানি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনেক কুয়ো তৈরি করেছিল, যা থেকে এই এলাকার নাম হয়েছে কুয়াকাটা। রাখাইন পল্লী গড়ে উঠেছে কয়েক ঘর রাখাইন নিয়ে। সেখানে রাখাইনদের তাতেঁ বোনা কাপড় পাওয়া যায় সুলভ মুল্যে।
রাখাইন পল্লীতে চাদর বুনছি।
কাল চলে যাব তাই শেষবারের মত কুয়াকাটার সূর্যাস্ত দেখতে ছুটলাম কুয়াকাটা বীচে। গ্রামের মেঠো পথ ধরে ছুটে চলা বাইকে বসে, দুপাশের সবুজ ধান ক্ষেত বা রাস্তার দুধারে গাছের সারি দেখে মন ভরে গেল। বুঝলাম কাল ভীষণ কস্ট হবে কুয়াকাটা ছেড়ে যেতে। সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখার জন্য আমরা যেন ধাওয়া করছিলাম পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যকে। সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে ধরতে পেলাম সূর্যকে, ইতোমধ্যে বাড়ি ফেরার পথ ধরেছে সূর্যমামা। যাবার আগে রাঙিয়ে দিচ্ছেন নীল আকাশকে তার লাল আভায়। চারদিক মাখামাখি সেই আভায়। লালের সেই আভা পড়েছে সমুদ্রের নীল পানিতে। যেন গলিত সোনা ভেসে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে। সূর্যাস্তের পর আজ কুয়াকাটা বীচেই চলল কাঁকড়া খাবার পালা। ট্যুরিজম ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে এখানে। টুরিস্টদের আকর্ষণ করতে, চাহিদা মেটাতে গড়ে উঠেছে নানান বাহারি দোকান।
কলাপাড়া বিচের সূর্যাস্তের লাল আভায়।
পরদিন ভোর ৪ টায় চলে এল বাইকওয়ালারা। আমরা তৈরীই ছিলাম। হর্ণ শুনেই নীচে নেমে এলাম। এত ভোরে কোথায় যাচ্ছি আমরা!!! হুম আমরা যাচ্ছি গঙ্গামতির চরে সূর্যোদয় দেখতে। সেই অন্ধকার রাতে বাইকের পিছনে ছুটছি বালুর ওপর দিয়ে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে। বাইক চলতে শুরু করল সমুদ্রের একদম তীর ঘেষে। তখন ভাটা চলছিল। বাইক চালকরা ভীষণ দক্ষ। অবলীলায় কখনো সমুদ্রতটের বালুর উপর দিয়ে, কখনোবা আছড়ে পরা ঢেউয়ের উপর দিয়ে চালাতে লাগলেন। বাইক রাইড টা মনে রাখার মত রোমাঞ্চকর ছিল। ঠান্ডা বাতাসে কাঁপছিল শরীর কিন্তু আমরা ছুটেই চলছিলাম কারণ সূর্য ওঠার আগেই আমাদের পৌঁছাতে হবে গঙ্গামতির চরে। পৌঁছে দেখি অনেক অনেক মানুষ সেখানে। সবাই এসেছে সূর্যোদয় দেখতে। সেখানে একটি মাত্র দোকান ছিল যেখানে পাউরুটি, কলা আর চা বিক্রি হচ্ছিল। সবাই ভীড় জমিয়েছে সেই দোকানে। ভোরের সেই ঠান্ডায় দারুণ আরাম দিচ্ছিল গরম গরম চা।
অপেক্ষার পালা শেষ হল সূর্যের প্রথম আভার সাথে সাথে। গঙ্গামতির চরে কিছু ম্যানগ্রুভ জাতীয় অদ্ভুত আকৃতির গাছ ছিল। হয়তো সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্রমাগত ধাক্কায় গাছগুলো ওই আকৃতি পেয়েছে। তখনো সেখানে ক্ষণে ক্ষণে আছড়ে পড়ছিল সমুদ্রের ঢেউ আর তাতেই মনে হচ্ছিল এটা চেনা কোন জগত নয়। অন্য কোন জগতের একটা অংশ চলে এসেছে এখানে। শরতের আকাশ, আলোছাঁয়ায় ঘেরা বন আর সমস্ত চরাচর জুড়ে লুটিয়ে পড়া উদয়মান সূর্যের রুপালী আলোর আদুরে শুভ্রতায় মাখামাখি কুয়াকাটার গঙ্গামতির চর দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
গঙ্গামতির চরে সূর্যোদয় দেখার পরে
দুটো গাছে হ্যামক বেঁধে নিলাম। হ্যামকে শুয়ে শুয়ে উপভোগ করতে লাগলাম প্রকৃতিকে। পূর্বদিগন্তে তখন সূর্যের হালকা লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে যা র তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়ছিল। আকাশময় লালচে আলো আর তার আভায় সোনালী হওয়া সমুদ্রের পানিতে উদভ্রান্তের মত ছুটে বেড়ালাম। সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়ালে আমার ইচ্ছে করে সোজা হেঁটে চলে যেতে যাকে মনে করে কবিগুরু গেয়েছেন সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে দেখে পথে যেতে তুলনাহীনারে…. আমি অতি নগন্য একজন মানুষ কিন্তু এই গানের সুবাদেই কেন যেন তুলনাহীনা হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে সমুদ্রের ধারে এলে।
গঙ্গামতির চরে সূর্যোদয়।
সোনা সোনা রোদের আলোয় চলছিল ছবি তোলা নানান ভঙ্গিমায়। কেউ সূর্যকে হাতের মুঠোয় নিয়ে, কেউ বা ডিমের কুসুমের মত মুখে নিয়ে তুলছিল ছবি। হ্যামকে বসে বসে এইসব দেখতে মজাই লাগছিল। অদূরে ঝাউবনে ঢাকা একটা চর হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমাদের কিন্তু না আর সময় কই? এবার যে ফেরার পথ ধরতে হবে।
গঙ্গামতির চরে সূর্যোদয়ের সময়।
দুটো দিন ভীষণ আনন্দ আর উত্তেজনায় কেটে গেল কুয়াকাটাতে। আরও অনেক কিছুই ছিল ঘুরে দেখবার মত। সোনার চর, মন্তাজের চর এসবই আছে আশে পাশে কিন্তু এবেলা আর নয়। আবার কখনো আসা যাবে নতুন করে আরো নতুন নতুন জায়গা দেখতে।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
খুব ভালো লাগলো কুয়াকাটার ভ্রমন কাহিনি। যাবার ইচ্ছায় রইলাম
এক সাথে যাওয়া যাবে দাদা।