সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। সহস্র বছরের একটুকরো স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মালাক্কা শহরের রাস্তায় এদিক সেদিক ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরছি। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে খ্যাত মালয়েশিয়ার প্রাচীন এই শহরটায় প্রতিটি বর্গইঞ্চি জায়গা যেন শুধু দেখার নয় হৃদয় দিয়ে অনুভব করার মত। কোথাও ১৮০০ সালের গির্জা তো কোথাও ১৪০০ সালের বাড়ি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে শুরু করে বাড়ির দরজা পর্যন্ত সব কিছুতেই প্রাচীনতার ছোঁয়া স্পষ্ট। দুপুরের পর থেকে যতটুকু পারা যায় শহরটা ঘুরে মালাক্কার মাঝ বরাবর বইতে থাকা নদী পাড়ের বাঁধানো রাস্তা ধরে হাঁটছি আমরা। বার, রেষ্টুরেন্ট, ডর্মেটরি সবখানেই জমজমাট সান্ধ্যকালীন গানের আসর বসে গেছে ইতোমধ্যেই। আমাদের ঘুরোঘুরি গন্তব্যহীন হলেও সামনে কি আছে তা দেখার আগ্রহ তো রয়েছেই তাই নদী ছেড়ে এবার বড় রাস্তাটা ধরেছি।
চুপচাপ গিয়ে তাদের মাঝে বসার কিছু সময় পর আমার সাথে থাকা বন্ধুর মাথার দুষ্টু বুদ্ধির জোরেই লোকটা একসময় ঘোষণা করলো ”আমরা অপূকে আমাদের মাঝে গান করার অনুরোধ করছি”। একটু আধটু গাইতে যখন জানি অতএব, না করার কোন মানে নেই তাই এগিয়ে গিয়ে গীটারটা হাতে নিলাম। লোকটার বাড়ানো হাতটা ধরতেই খুব বিনয়ের সাথে বলল আমি ই-কিয়ং। তোমাদেরই মত এখানে গান শুনতে এসেছি। যখনই সুযোগ পাই এখানে আসি নাকামিচির গান শুনতে। এখানে যা কিছু দেখছ সবই নাকামিচি-র। এই বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জাপানিদের মত চেহারার লোকটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
নাকামিচি দারুণ রসিক লোক, সে বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে মাইক্রোফোনে আমার পরিচয় দিয়ে আমাকে আরো একবার গান শুরু করার অনুরোধ জানালো। কি গাইবো. কি গাইবো ভেবে গানস এন্ড রোজেস-এর নকিন অন হেভেনস ডোর দিয়েই শুরু করলাম। গানের মাঝের ইন্টারলিউডটা বাজানো শুরু করতেই কোন রকম টাইম মিস করা ছাড়াই নাকামিচি তার হারমোনিকার যাদু দেখানো শুরু করলো।
সে এক অবাক করা সুর। সম্মোহিতের মত তার সাথে গীটার বাজিয়ে চলেছি আমি। গাইছি ও প্রাণ খুলে। এদিকে ই-কিয়ং একের পর এক ছবি তুলে চলেছে আমাদের। এভাবে আরো কিছু হাসি-ঠাট্টা, আরো দুএকটা বাউল গানের পর নাকামিচিকে বললাম আমি তোমার গান শুনতে চাই। দারুণ প্রাণচঞ্চল আর রসিক লোকটা হাসতে হাসতে আমাকে জানালো, আমি আজ ভুল করে আমার ঔষধ না খেয়ে আমার কুকুরের জন্য আনা ঔষধগুলো খেয়ে ফেলেছি!! আমার গান যে তোমার কেমন লাগবে কে জানে!!! আমিও হাসতে হাসতে তাকে জানালাম যাই হোক, আমার শুনতে কোন আপত্তি নেই।
নাকামিচির হাতে গীটারটা দিয়ে দর্শকসারিতে গিয়ে বসলাম আবারো। সামনে রাখা অনেকগুলো হারমোনিকা থেকে আবারো একটা হারমোনিকা বেছে নিয়ে সে শুরু করলো ডীপ পার্পলের স্মোক অন দ্য ওয়াটার। অসাধারণ গীটারের সাথে, দুর্দান্ত হারমোনিকা আর সেই সাথে নাকামিচির অবাক করা কন্ঠ যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুরো ডাচ স্কোয়ার। অসাধারণ গায়কি সাথে গীটার আর হারমোনিকার যাদুতে মেশানো নাকামিচি এরপর একে একে গেয়ে চলেছে হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া. কান্ট্রি রোড, জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল. অ্যানিস সং-সহ নাম না জানা বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন গান। সময় কিভাবে পেরিয়েছিলো জানিনা সেদিন। বেশ রাতে আগামীকাল আবারও আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নাকামিচি আর ই-কিয়ং-এর কাছ থেকে বিদায় নিলাম সেদিনের মত।
পরদিন আবারো সারাদিন দিক-বিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রাচীন সব স্থাপনা, দূর্গ, বাড়ি, নগর ভবন, প্রাসাদ, মন্দির, জাদুঘরের অলি-গলি ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই সন্ধ্যা। সন্ধ্যায় যেহেতু নাকমিচির গানের আড্ডায় যাওয়ার প্লান তাই নাইট ফটোগ্রাফী ছাড়া তেমন কোন প্লান হাতে রাখিনি। ডাচ স্কোয়ারে পৌঁছুতেই নাকামিচির অকৃত্রিম উল্লাস এবং যথারীতি জানালো আজকেও সে ভুল করে কুকুরের ঔষধটাই খেয়ে এসেছে!!! গীটারটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো তুমি গাইতে থাকো আমি কটা বিয়ার নিয়ে আসি। নাকামিচির দর্শকদের মাঝে আবারও গেয়ে চলেছি এর মাঝে সেও বিয়ারের ক্যান নিয়ে আমার সাথে এসে যোগ দিয়েছে। গানের ফাঁকে তাকে জানালাম কাল খুব ভোরে মালাক্কা ছেড়ে যাব। তোমার সাথে হয়ত কাল আর দেখা হবেনা। আজকেই বিদায় নিবো আমরা। নাকামিচির মন খারাপ করা চেহারাটা এখনো চোখে ভাসে। গীটারটা স্ট্যান্ডে রেখে ক্রাইস্ট চার্চের বাঁধানো চত্বরটায় গিয়ে বসলাম আমরা সবাই। কত শত সব কথা, আবারো আসার কিংবা যাওয়ার অনুরোধ, নাকামিচির রসিকতা, আবারো গীটার আর হারমোনিকায় সুকি আকি, নাথিং এলস মেটার, লীভিং অন এ জেট প্লেন এর ঝড় সব কিছু মিলিয়ে অনন্য সাধারণ একটা পরিবেশ। সবাই হাসিখুশি আবার সবার মাঝে কেমন যেন ভাই কিংবা বন্ধু ছেড়ে যাওয়ার একটা কষ্ট।
রাত বাড়ছে। নাইট ফটোগ্রাফী, খাওয়া দাওয়া, খুব ভোরে ক্যামেরুন হাইল্যান্ড যাওয়ার বাস সব মিলিয়ে একসময় সত্যিকারের বিদায় নেবার পালা। ক্রাইস্ট চার্চের ফুটপাতে দাঁড়ানো নাকামিচি-র সাথে শেষবারের মত হাত মিলিয়ে হাঁটা শুরু করেছি। কিছুটা এগিয়ে পিছু ফিরে যা দেখলাম তার সাথে পৃথিবীর কোন কিছুর তুলনা চলে কিনা জানা নেই। প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স, হালকা গড়নের, দারুণ হাস্যোজ্জল নাকামিচি চোখ মুছছে অসহায়ের মত। আমরা ঘুরে তাকাতেই অপ্রস্তুতের মত হাত নেড়ে আবারো বিদায় জানানোর চেষ্টারত লোকটার জন্য প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিলো। আমরাও চুপচাপ হাত নাড়ছি। পথ কখনও কখনও খুব নিষ্ঠুর হয়। পা চলতে না চাইলেও পা-কে চলতে বাধ্য করানোতে পথের কোন জুড়ি নেই। হাঁটছি আর পিছু ফিরে দেখছি হাত নাড়তে থাকা মধ্যবয়সী লোকটাকে। আমরা পথের বাঁকে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কাতর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অদ্ভুৎ লোকটাকে আজীবন মিস করবো।
ভালো থেকো নাকামিচি……
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।