“বাগডোগরা এয়ারপোর্টে এসে প্লেন নামল ঠিক সাড়ে সাতটায়। কলকাতা থেকেই বাবা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন যাতে আমাদের জন্য এখানে একটা জিপ মজুত থাকে। আমরা সটান জিপে না উঠে আগে এয়ারপোর্টের রেস্টোরান্টে গিয়ে বেশ ভাল করে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম; কারণ এখান থেকে গ্যাংটক যেতে লাগবে প্রায় ছ-সাত ঘণ্টা। রাস্তা খারাপ থাকলে আরও বেশি লাগতে পারে। তবে ভরসা এই যে আজি সবে চোদ্দই এপ্রিল; মনে হয় এখনও তেমন বর্ষা নামেনি।
অমলেটটা শেষ করে মাছ ভাজা ধরেছি, এমন সময় দেখি প্লেনের সেই ভদ্রলোকটি একটা কোনার টেবিল থেকে উঠে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে আমাদেরই দিকে হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন।
‘আপনারা কি ড্যাং, না ক্যাং, না গ্যাং?
আমি তো প্রশ্ন শুনে ঘাবড়েই গেলাম। এ আবার কী হেঁয়ালিতে কথা বলছেন। ভদ্রলোক? কিন্তু ফেলুদা তৎক্ষণাৎ হেসে উত্তর দিল ‘গ্যাং।”
বলুনতো কোন বইয়ের লাইন এগুলো? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, গ্যাংটকে গণ্ডগোল। সত্যজিত রায়ের ফেলুদা সিরিজের এই বিখ্যাত বইটি দিয়েই আমার গ্যাংটকের সাথে পরিচয় সেই ছোটবেলাতেই। এরপরে তিস্তা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। এরপরে কলেজে উঠে পড়লাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “বুকের মধ্যে আগুন” যার শেষ কটা পাতা আমি চোখের পানিতে ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। কেন জানিনা ওই সময় এত তীব্র অনুভূতি হয়েছিল আমার পাগলাটে ছেলেগুলোর জন্য। সেই বইয়ে নেপালি গোর্খা অফিসারের জন্য নতুন করে মনে পড়ল গ্যাংটকের কথা। কারণ সেই সময় নেপালি গোর্খারা প্রায়ই আন্দোলন করত সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে। এরপরে দেখলাম দারজিলিং এর পথে পথে গোর্খাদের সেঁটে দেওয়া নানান পোস্টার। সেই সময় থেকেই অনুমতি ছাড়া গ্যাংটকে প্রবেশ বারণ। যেহেতু বারণ সেটা নিয়ে আমার তেমন আগ্রহও ছিল না।
বেশ কিছুদিন হল আমাদের বাংলাদেশীদের জন্য অনুমতি সাপেক্ষে ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে সিকিম। আগেও অনুমতি নিয়ে যাওয়া যেত সিকিম কিন্তু সেই অনুমতি পাওয়া সহজ ছিলনা। এখন খুব সহজেই দেশের ভিসা সেন্টারেই আবেদন করে সাতদিনের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে অনুমতি।অথবা শিলিগুড়ি পৌঁছেও তৎক্ষণাৎ পাওয়া যেতে পারে সিকিম ভ্রমণের অনুমতি। কাজেই যাদের স্বপ্ন ছিল সিকিম ভ্রমণ করার তাদের এখন সুবর্ণ সুযোগ।
আমরা হলাম হুজুগে বাঙালি। আমরা বেশির ভাগই ঘোরার পরিকল্পনা করি বা ঘুরতে যাই অন্যের তোলা ছবি দেখে। “সে গেছে, আমারও যাইতে হবে” অধিকাংশ মানুষ জনেরই এমন মনোভাব। এর ফলে যা হয়, ভ্রমণের প্রতি প্যাশন না থাকলে যা হয় তাহলো এর ওর কাছ থেকে শুনে সেই জায়গায় বেড়াতে চলে যায় আর ফিরে এসে গালাগালি করে যে, ছবি বেশি এডিট ছিল বা নানান রকম অসুবিধা ছিল যা তারা জানত না। তাই কোথাও যাবার আগে সেই জায়গাটা নিয়ে পড়াশুনা করা খুবই জরুরী। অবাধ ইন্টারনেটের কারণে এখনতো তথ্য অনেক সহজলভ্য কিন্তু সেই কষ্টটুকু আমরা করতে চাইনা। অন্য কারো কাছ থেকে যদি রেডিমেড একটা ট্যুর প্ল্যান পাওয়া যায় তাহলে আমার কি দরকার সময় নষ্ট করে প্ল্যান রেডি করার, সেই সময়টায় বরং আমি আর কিছুক্ষণ ফেসবুকিং করতে পারি।
আপাতত সিকিম বেড়াতে যাবার আমার কোন পরিকল্পনা নেই। সিকিম এর মূল আকর্ষণ হিমালয়। সেটা ভারত, নেপাল বা ভুটানের নানান জায়গা থেকে দেখার পরে সিকিমের প্রতি সেই তীব্র আকর্ষণটা নেই। সময় সুযোগ হলে হয়তো যাব। কিন্তু আমার ফেসবুকে ভ্রমণপ্রিয় বন্ধুদের সিকিম নিয়ে উচ্ছ্বাসের কারণে ইচ্ছে হল সিকিম নিয়ে নতুন করে জানতে।
সিকিম শব্দটা এসেছে দুটো লিম্বু শব্দ su, যার অর্থ নতুন এবং khyim, যার অর্থ জায়গা বা বাড়ি। সিকিম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি রাজ্য যার রাজধানী গ্যাংটক। আয়তনে ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম প্রদেশ হলেও বৈচিত্রে ভরপুর এই রাজ্য। এর উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত, পূর্বে ভুটান, পশ্চিমে নেপাল এবং দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গ।
সিকিম এ অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘা ভারতের সর্বোচ্চ পর্বত শিখর এবং পৃথিবীতে তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত শিখর। মুলত এই পর্বতই সিকিমকে দিয়েছে তার অনবদ্য রুপ। একমাত্র এখান থেকেই উপভোগ করা সম্ভব কাঞ্চনজঙ্ঘার নিরবিচ্ছিন্ন রুপ। সিকিমের প্রায় ৩৫% এলাকাই কাঞ্চনজঙ্ঘা জাতীয় উদ্যান।
স্বর্গসম সিকিম এ হিমালয় পর্বতমালার পাশাপাশি আর আছে অতি উচ্চতায় লেক, ঝর্ণা, হাজারো মনেস্ট্রি, প্যাগোডা ইত্যাদি। সিকিমের এই সৌন্দর্যের কারণে লেপচা জনগোষ্ঠী, যারা সিকিমের আদি বাসিন্দা তারা সিকিমকে Nye-mae-el বলে যার অর্থ স্বর্গ।
এই ভূস্বর্গ সিকিম এ বেড়ানোর জন্য একটা ভ্রমণ পরিকল্পনা দিলাম যা থেকে আপনারা কিছুটা হলেও ধারণা নিতে পারবেন।
- দিন ১। ঢাকা থেকে চেংরাবান্ধা বর্ডার পার হয়ে সোজা গ্যাংটক। গ্যাংটকে ঘুরাঘুরি এবং রাত্রিযাপন।
- দিন ২। আজ চলে যান লাচুং এ। যাবার পথে দেখুন মাঙ্গান ভ্যালি, সিঙ্ঘিক ঝর্ণা, নাগা ঝর্ণা, চুম্থাং ভ্যালি ইত্যাদি। লাচুং এ রাত্রিযাপন করুন।
- দিন ৩। আজ ঘুরতে যান ইয়াম্থাং ভ্যালি। যাবার পথে দেখুন সিংবা রডোডেন্ড্রন পার্ক, উষ্ণ প্রসবন। লাচুং এ ফিরে চলে যান লাচেনে। সেখানেই রাত্রিযাপন।
- দিন ৪। খুব ভোরে রওনা হয়ে যান থাঙ্গু ভ্যালি হয়ে বেড়ানো শেষে ফিরে যান গ্যাংটক। সেখানেই রাত্রি যাপন করুন।
- দিন ৫। আজ চলে যান পেলিং এ। আশে পাশে ঘুরাঘুরি আর শপিং করে সেখানেই রাত্রিযাপন করুন।
- দিন ৬। আজ বেড়ান পেলিং এর হেলিপ্যাড, খেচেওপালরি লেক, কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝর্ণা, পেমাইয়াংসে মনাস্টেরি, রাবডেন্টসে, রিম্বি ঝর্ণা, দারাপ চেরি গ্রাম, রক গার্ডেন ইত্যাদি। পেলিং এ রাত্রিযাপন করুন।
- দিন ৭। আজ পেলিং থেকে সোজা চলে যান চেংরাবান্ধা বর্ডারে। পথে কালিম্পং পড়বে, চাইলে সেখানে কিছুটা সময় বিরতি নিতে পারেন।
এইসব ছাড়াও সিকিমে দেখার মত আরো অনেক অনেক জায়গা আছে যা আসলে অল্প সময়ে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। তাই আপনার হাতে কি পরিমাণ সময় আছে সেটা বুঝে নিজের সুবিধামত একটা পরিকল্পনা করাই সবচেয়ে ভাল হবে। এই পরিকল্পনা করতে করতে আমি গুগল ম্যাপে বেশ ভালই একটা সিকিম ট্যুর দিয়ে ফেললাম।
কিছু জিনিস যা মনে রাখা জরুরী
১। সিকিম ভ্রমণের সবচেয়ে ভাল সময় এপ্রিল থেকে জুন এবং সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর। এই সময়ে ফোটে রডোডেন্ড্রনসহ অন্যান্য রংবেরঙ এর ফুল। তাই প্রকৃতি সেজে থাকে অপরূপ সাজে। অন্য সময়গুলোতে বৈরি আবহাওয়ার কারণে অনেক রাস্তা বন্ধ থাকতে পারে যা আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা নষ্ট করে দিতে পারে।
২। সিকিমের গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই অবশ্যই যাবার আগে জেনে যাবেন সেখানে তাপমাত্রা কত থাকবে, সেই অনুযায়ী গরম কাপড়ের প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে।
৩। এটি ভারতের সবচেয়ে পরিবেশগতভাবে সচেতন রাজ্য, যার ফলে প্লাস্টিকের জলের বোতল এবং স্টাইরোফোম ইত্যাদি পণ্য এখানে নিষিদ্ধ তাই যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন।
৪। অন্য দেশের মাটিতে এমন কোন আচরণ করবেন না যাতে নিজের দেশ নিয়ে অন্যদের খারাপ ধারণা তৈরি হয়।
৫। দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরতে যেতে অনুমতির প্রয়োজন হয় তাই যাবার পূর্বে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে রাখবেন।
এই লেখাতে দেওয়া তথ্য বা ভ্রমণ পরিকল্পনা পুরোটাই নানান ওয়েবসাইট ঘেঁটে পাওয়া। জায়গার নামগুলোর উচ্চারণ ভিন্ন হতে পারে। তথ্যে ভুল থাকলে, জানালে সেটা ঠিক করে দেওয়া হবে।
স্বর্গসম সিকিম এ আপনার ভ্রমণ শুভ হোক।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
