কল্পনা করুন, আপনার চারপাশে সারি সারি পাহাড়, এর মাঝে একটি নিঃসঙ্গ বাড়িতে রাত কাটাচ্ছেন আর আপনাকে সঙ্গ দিচ্ছে মেঘ, আর পূর্ণিমার চাঁদ। এলোমেলো ভাবে এগিয়ে চলা রাশি রাশি মেঘ আপনাকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। রাতের নীরবতা ভেঙ্গে অবিরাম গান গেয়ে চলছে নাম না জানা অসংখ্য পোকা মাকড়ের দল। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? মনে হচ্ছে এ শুধু কল্পনাতেই সম্ভব? না, কল্পনা না। উপরে যা বললাম তার প্রতিটি শব্দ সত্যি। এমন কল্পনাকে হার মানাতে যেতে হবে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুন্জিতে। পাহাড় আমার রক্তে। এ পাহাড় ও পাহাড় ঘুরি আর আফসোস করি কেন যে মেঘালয় আমাদের দেশের অংশ না। এই আফসোস আরো বেড়ে যায় সিলেটে গেলে। সেই আফসোস আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল ইউটিউবে থাকা মেঘালয়ের সৌন্দর্যের ভিডিও দেখে। তবে সেই আফসোসের কিছুটা হলেও এখন ঘুচেছে।
বেশ কিছুদিন আগে কোন ধরণের পরিকল্পনা ছাড়াই বেড়িয়ে পড়লাম মেঘালয়ের উদ্দেশ্যে। জানি না কি করবো, কোথায় যাবো। শুধু জানি যেতে হবে মেঘালয়, কমাতে হবে আফসোস। সাথে আমার মত আরো ৬ জন পাগল। মহাখালি থেকে সিলেটের বাসে উঠেই আগের সপ্তাহে মেঘালয় ঘুরে আসা সৌম্য দাদাকে ফোন দিলাম, বললাম উনি যেন ঘুরবার একটা পরিকল্পনা দেন। সিলেট পৌঁছানোর পর আমাদের ভরসা অনলাইনে পড়া ঝুমুর আপু আর হিমু ভাইয়ের ভাসা ভাসা প্লান আর সৌম্য দাদার প্লান। সিলেটের তামাবিল বর্ডারে যখন আমাদের পা পড়ল তখন বেলা ১১ টার কাছাকাছি। ইমিগ্রেশনের সব ধরণের কাজ শেষ করে যখন আমরা ভারতের ডাউকি বাজারে পৌঁছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকালের শেষভাগে দিন। ক্ষুধায় কাহিল অবস্থা আমাদের। তবে থামলে চলবে না। হাতে সময় সব মিলিয়ে তিনদিন, দেখতে হবে অনেকখানি। তাই কোন ভাবে পেটে কিছু দিয়ে আমরা ছুটলাম টাকাকে রুপি করতে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও মানি এক্সচেন্জ বলতে কিছু নেই। অনেক খোঁজার পর একটা দোকান থেকে অবশেষে টাকাকে রুপিতে পরিবর্তন করা হল। কিন্তু সামনে তখন আরো বড় চ্যালেঞ্জ। যেহেতু দিন পুরোটা প্রায় শেষ ততক্ষণে আমাদের ওই দিনের পরিকল্পনার কোন কিছুই করা সম্ভব না। কোথায় যাবো এটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে করতে আরো ৩০ মিনিট খানেক সময় লাগিয়ে ফেললাম আমরা।
শেষমেশ সিদ্ধান্ত হল যে আমরা শিলং যাবো কিন্তু ডাউকিতে আর কোন গাড়ি নেই যারা আসলে ওই শেষ বেলায় আমাদের নিয়ে শিলং যাবে। যে দুই একজন যেতে চাইলো তাদের চাহিদা দেখে আমাদের বেশ কয়েকবার ছোট ছোট হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। অবশেষে বেশ কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে একজনকে রাজি করানো হল শিলং যাবার জন্যে, শর্ত হচ্ছে যাবার পথে বড় হিল, লিভিং রুট ব্রিজ ও এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম মাওলাইনং দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে। গাড়িতে উঠেই আমি ব্যাগের উপরে মাথা দিয়ে ঘুম। উষা কী তিশার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে দেখি সবাই বড় হিলের ঝর্ণা দেখতে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। চোখ মুছতে মুছতে বাইরে বের হয়ে আমার মুখ দিয়ে প্রথম কথা, ‘আরে এতো আমাদের পাংতুমাই ঝর্ণা’। আমাদের হা হুতাশ করা পাংতুমাই। যে ব্রিজের উপর থেকে বড় হিল তথা পাংতুমাই ঝর্ণা দেখতে হয় সেটার এক পাশে ভারত আরেক পাশে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। ঝর্ণা দেখতে দেখতে মনে পড়লো বাসার কাউকে জানানো হয় নাই যে আমি ঠিকঠাক ভারতে ঢুকেছি। ভারতে ঢুকে ঝর্ণা দেখতে দেখতে বাংলাদেশের সিম দিয়ে প্রয়োজনীয় কথা টুকু সেরে নিলাম। বড় হিল থেকে গাড়ি যখন মাওলাইনং এ পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা প্রায় নেমে গিয়েছে। লিভিং রুট ব্রিজ দেখতে দেখতে রাত নেমে গেলে আমাদের আর মাওলাইনং ঘুরে দেখা হলো না। শিলংয়ের পথে আমরা আর আমাদের সঙ্গী মেঘ বৃষ্টি। যেন আমাদের সাথে মেঘও চলছে শিলং পানে। মেঘ বৃষ্টির সঙ্গে পথ চলতে চলতে রাত ৯টা নাগাদ প্রবেশ করলাম ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’। ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’ নামকরণের সার্থকতা রেখেই শিলং তার সৌন্দর্য পরতে পরতে আমাদের কাছে মেলে ধরেছিলো সেদিন রাতে। কী, অপরূপ সেই রাত! আহা!
পরের দিন সকালে উঠেই গাড়ি ঠিকঠাক করে বেড়িয়ে পড়লাম শিলং শহরের আশেপাশে দেখতে। সারাদিন বিভিন্ন স্পটে ঘুরছি আর আফসোস বেড়েই যাচ্ছে কেন মেঘালয় আমাদের না। পরতে পরতে পাহাড়ে আর রোমাঞ্চে ঘেরা একটা জায়গা। সেদিন শিলংয়ে থেকে পরেরদিন সকালে ছুঁটলাম আঁকা বাঁকা পথে। উদ্দেশ্য আরেক মায়াময় জনপদ চেরাপুঞ্জি। সাথে আগের দিনের গাড়ির ড্রাইভার কাম গাইড ‘ডেভিড দাদা’। তিনি তার গাড়ি নিয়ে ছুঁটছেন এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়। প্রথম গন্তব্য ‘নোয়াকালিকাই’ ঝর্ণা। নোয়াকলিকাইয়ে গিয়েই সবার মন খারাপ। নোয়াকালিকাই ঝর্ণা দেখতে হয় দূরে বানানো ভিউ পয়েন্ট থেকে। যদিও ট্রেক করে কাছাকাছি যাওয়া যায় তবে তাতে নাকি পুরো দিন লেগে যায়। যেহেতু আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই, দূরই তখন একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেই ভরসারও মেঘে খুন হয়ে গেলো মনে হয়। ভিউ পয়েন্টে গিয়ে আরে ঝর্ণা কই? চারদিকে শুধু মেঘ আর মেঘ। আমরা তখন বেশ মন খারাপ করে মেঘের মাঝে দিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রায় ৪০ মিনিটের মত এদিক সেদিক করে ঘুরে যখন গাড়ির দিকে এগুচ্ছি তখনই খুব সম্ভবত হিমু ভাই চিৎকার করে উঠলেন যে, ‘মেঘ সরে গিয়েছে।’ আর সবার মাঝে থাকা বাচ্চা যেন জেগে উঠলো। যে যেভাবে পারল পরিমরি করে দে ছুট। অবশ্যে সেদিনের ‘দে ছুট’ কিন্তু সার্থকতা পেয়েছিল। আমি পাহাড়ে ঝর্ণা ঘোরা মানুষ, অনেক ঝর্ণায় গিয়েছি কিন্তু এত সুন্দর এত বড় ঝর্ণা আমি আর দেখি নি। কী ভয়াবহ সে নোয়াকালিকাই। মনে মনে অবশ্য সেদিন নোয়াকলিকাইয়ের কাছে কথা দিয়ে এসেছি যে আমি আবার ফিরবো তার কাছে, দেখবো তাকে হাত ছোঁয়া দূরত্বে।
আমরা থাকতে থাকতে হিংসুটে মেঘগুলো আবার নোয়াকালিকাইকে আলাদা করে ফেললো। আমাদেরও নামতে হলো পথে নতুন কোনো পথের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে ডেভিড দাদাকে বলেছিলাম, ‘দাদা এমন কোথায় নিয়ে যান যেখানে নি:শব্দ আমাদের ঘিরে ধরবে।’ সারাদিন বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে যখন আমাদের সেই রাতের থাকবার জায়গা নিয়ে গেলেন তখন আমাদের চক্ষু চড়ক গাছে। এ কি দেখছি আমরা? বলতে গেলে নীরব পাথারে বাড়ি বানিয়ে রেখেছেন। আমরা সেই নীরবতায় তার দ্বিতীয় অতিথি। যখন বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম ততক্ষণে আমাদের মাথার উপর চাঁদ মামা ‘ গোল রুটি’ হয়ে আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। সেদিন সারারাত আমাদের সঙ্গ দিয়েছিল। পাহাড়ি পরিবেশে চাঁদের সৌন্দর্য যে কখনো দেখেনি তাকে হয়তো লিখে কেন বলেও প্রকাশ করা যাবে না। কী যে মায়াবী হয়ে উঠে চারপাশ সেটা যদি পৃথিবীর কোন বর্ণমালায় লেখা যেত তাহলে আমি হয়তো সেই লেখার দ্বায়িত্ব সবার আগে নিতাম। আমার বদ্ধ ধারণা, পাহাড়ে ভরা পূর্নিমায় যদি কোন হতাশায় ভোগা মানুষকে ছেড়ে দেওয়া যেত তাহলে যে পূর্ণ জীবনী শক্তি নিয়ে নতুন করে বাঁচবার জন্যে যুদ্ধ করতো।
পরেরদিন ফেরার পালা, সেটা মনে করেই মন বিষন্ন থেকে বিষন্নতর হয়ে যাচ্ছিল। প্রায় অনেকরাত পর্যন্ত হিমেল বাতাসে জোছনায় বসে থেকে একসময় ঘুমাতে গেলাম। যাবার আগে ঝুমুর আপু রীতিমত ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে, ভোর ৪ টায় তিনি আমাদের সবাইকে ডেকে দিবেন। কারণ তিনি সেভেন সিস্টার ঝর্ণার পাশে বসে সূর্যোদোয় দেখবেন। যে কথা সেই কাজ ঠিক ভোর ৪ টায় সবাইকে ঝাকুনিতে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন তিনি। এইদিকে ভোর রাতে পাহাড়ে তাপমাত্রা বেশ কমে যায়। শেষমেশ একটু কাইকুই করে কম্বল গায়ে দিয়ে ঝুমুর আপুর পিছু হাঁটা দিলাম। অনেকবার পাহাড়ে গেলেও এর আগে কখনো পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য হয় নাই। পাহাড়ে সূর্যোদয় যে এত এত নেশাতুর হয় সেটা পুরোটা সময় আমাদের সূর্যের দিকে মন্ত্রমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকা না দেখলে বোঝানো সম্ভব না। নেশাতুর নয়নে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে সেদিন মনে মনে ডেভিড দাদার কাছে নতুন শেখা খাসিয়া ভাষায় বলেছিলাম ‘ নান উয়ান বিয়া, মেঘালয় ’ ( আমি আবার আসবো মেঘালয় )
লেখা ও ছবি: শাহাদাৎ জামান সৈকত
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বাহ্। চমৎকার লাগলো। দুঃখও পেলাম এত অল্পতে শেষ হলো বলে।
আরো বড় বড় লেখা আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা থাকবে। :)