চাকুরীর কারণে গাজীপুরের বাসিন্দা হওয়ায় অনেকেই মনে করেন এই এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা রিসোর্টগুলোর আদ্যোপান্ত আমার জানা। কিন্তু ওই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গিয়েছেন, ”দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের ওপর, একটি শিশির বিন্দু”, কাছাকাছি অনেক রিসোর্টের অবস্থান থাকা সত্ত্বেও সেভাবে যাওয়া হয়নি কোথাও। দেশের আনাচে কানাচে ছুটে বেড়ালেও ভাবতাম হাতের কাছের এইসব প্রশান্তির রিসোর্টে আর একটু বুড়ো হলে ঘুরতে যাব যখন আর বনে বাদারে, পাহাড়ে ঝর্ণায় ঘুরে বেড়াতে কষ্ট হবে। ভাবনা যেহেতু লাগামহীন ঘোড়া অতএব, সেই বুড়ো বয়সের ভাবনাগুলো একপাশে রেখেই কিছুটা সময় কাটিয়ে এলাম গাজীপুরের জল ও জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে।
শীতের আমেজ মাখানো এক সকালে পৌঁছে গেলাম জল ও জঙ্গলের কাব্য এর মূল ফটকে। আলী বাবা চল্লিশ চোরের সেই গল্পের মতই যেন গাড়ীর হর্ণ দিয়ে চিচিং ফাক শব্দ করতেই খুলে গেল এক অন্য জগতের দরজা, বুঝলাম খুব একটা খারাপ কাটবেনা সময় এখানে। গাড়ী থেকে নামতেই দেখলাম বিশাল এক পুকুর। লাল রঙের ফাইটোপ্লাঙ্কটনের আধিক্যের কারণে লালচে গালিচার রূপ ধারণ করেছে পুকুরটা। সেই পুকুরের পাড় ধরে এগোতেই পেলাম উষ্ণ অভ্যর্থনা সাথে এক গ্লাস লেবুর শরবত। সবেতো শুরু হলো খাওয়া, আরো খাবারের বর্ণণা যথাসময়ে আসবে। এরপরে অভ্যর্থনা জানালো গানের দলের শিল্পীরা। মাটিতেই পাটি বিছিয়ে হারমোনিয়াম, ঢোল আর মন্দিরার তালে চলছে গান আর সেই গানের সুরে আচ্ছন্ন পুরো জল ও জঙ্গলের কাব্য।
জল ও জঙ্গলের কাব্য এর কেন্দ্রে পৌঁছে মোটামুটি দিশেহারাই হয়ে গেলাম যে এখন কি করব আর কি করব না!!! কোন দিকে যাব আর কোন দিকে যাব না। প্রথমেই আমার জন্য বরাদ্দ ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হল। ঘর বলতে, কাঠের মেঝেতে দেড় ফুট উঁচু বাঁশের বেড়ার দেয়াল আর মাথার উপরে টিন বা ছনের চাল। একে ঘর না বলে মাচাং বলাই শ্রেয়। জল ও জঙ্গলের কাব্য এর কোন স্থাপনাতেই চার দেয়াল নেই। রেলিং এর মত খানিক উঁচু বাঁশের বেড়ার পরে বাকীটা ফাঁকা যার কারণে প্রকৃতিকে উপভোগ করা যায় নিবিড় ভাবে। পুরো জায়গাটাতেই গ্রাম্য পরিবেশ। উপেক্ষা করা হয়েছে ইটের ব্যবহার। মনে হচ্ছিল যেন ফিরে গেছি সেই ছোট বেলায়, যখন বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেই চলে যেতাম গ্রামের বাড়ী। ভীষণ যত্নে সাজানো হয়েছে পুরো জল ও জঙ্গলের কাব্য। কোথাও এতটুকু কৃত্রিমতা নেই। একদিকে যেমন চলছে চালের আটা দিয়ে রুটি তৈরী করা আর সেকা, পাশাপাশি অন্য দিকে চলছে চিতই পিঠা বানানোর ধুম! পাশেই আরেকজন ভেজে চলেছে তেলে ভাজা মচমচে পরোটা।
ছবিঃ আমাদের জন্য বরাদ্দ ঘর আর টার সামনের বট গাছ
বিশাল এক বট গাছের গোড়ায় অবস্থিত আমাদের মাচাং এ বিছানো তোষকে একটুখানি গড়াগড়ি দিতে না দিতেই ডাক পড়ল নাস্তা খাওয়ার। বট গাছের নীচেই খাবার টেবিল পেতে দেওয়া হয়েছে। বুফে সিস্টেমে যে যার ইচ্ছে মত যা খুশী খাও। সকালের নাস্তায় ছিল চালের আটার রুটি, পরোটা আর চিতই পিঠা। সাথে মুরগী ভুনা, মিক্স সবজী, ধনে পাতা ভর্তা আর ঝোলা গুড়। কি খাব সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়াই মুশকিল। যেহেতু পরোটা সব সময়ই খাওয়া হয় তাই আমি খেলাম মুরগী ভুনা দিয়ে চালের আটার রুটি। আর ধনে পাতা ভর্তা আর ঝোলা গুড় দিয়ে একটা চিতই পিঠা। পেট পুরে খেয়ে এবার এক কাপ চা খাওয়ার পালা। আমি সাধারণত চা খাইনা কিন্তু এমন ঠান্ডা লেগেছিল যে ঠিক মত কথা বলাও যাচ্ছিল না। আমার এই অবস্থা দেখে চায়ের কারিগর জেমস ভাই অতি যত্নে আদা, পুদিনা পাতা ইত্যাদি দিয়ে দারুণ এক চা বানিয়ে দিলেন। সেই চা খেয়ে আমার ঠান্ডা মনে হল যেন অর্ধেক কমে গেল। উল্লেখ্য এখানে রান্না করার জায়গা উন্মুক্ত। একেক ধরণের খাবার তৈরির জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা জায়গা। চা বানানোর জায়গায় বসে আপনি সারাদিন যতবার ইচ্ছে চা খেতে পারবেন। আমি নিশ্চিত এইটা পড়ে আমার চা পাগল বন্ধু জিসান আর অপূ ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিয়েছে।
ভরপেট নাস্তা খাওয়া হল, চাও খাওয়া হলো এবারতো চারপাশটা একটু ঘুরে দেখবার পালা। কয়েকটা মাত্র স্থাপনা, যেখানে দর্শনার্থীরা বিশ্রাম নিতে পারে। বাকীটা যেমন ছিল সেভাবেই রেখে দেওয়া। গাছের গুড়ি বা কান্ড ব্যবহার করে বানানো হয়েছে বসার জন্য জায়গা। ছোট্ট একটা জলাশয়ে ফুটে থাকা কয়টা গোলাপী শাপলা হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। ছুটে চললাম সেইদিকে। সেখানে একটা ছাউনি আছে যেখানে বসে প্রকৃতি যেমন উপভোগ করা যাবে তেমনি আড্ডাও জমবে দারুণ। এই জল ও জঙ্গলের কাব্য র সীমানার তিন দিকেই রয়েছে বিল যেখানে বর্ষাকালে থৈ থৈ করে পানি। অতএব, নিশ্চিন্তে বলে দেয়া যায় বর্ষায় জল ও জঙ্গলের কাব্য -এর রুপ অতুলনীয়। আবার শীতকালে পানি প্রায় শুকিয়ে যায়। কোন কোন জায়গায় এমনকি ধান চাষও করা হয়। জল ও জঙ্গলের কাব্য র নিজস্ব জমিতেই হয় নানান সবজীর চাষ যা দিয়েই তৈরী করা হয় অতিথিদের জন্য মজার মজার খাবার। এখানে রয়েছে বিশাল এক খোলা প্রান্তর যেটাকে কখনো বানাতে পারবেন ফুটবল বা ক্রিকেট মাঠ।চাইলে খেলতে পারবেন ব্যাডমিন্টন। কিংবা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, ছিবুড়ি, কানামাছি ইত্যাদি খেলেও উপভোগ করতে পারেন একটা বেলা। আর এতসব কিছু করতে ইচ্ছে না করলে একটা হ্যামক টানিয়ে নিন গাছের সাথে। হ্যামকে শুয়ে শুয়ে কখন চোখ বুজে ফেলবেন টেরও পাওয়া যাবেনা।
ছবিঃ ছোট্ট শাপলার পুকুর আর তার ছোট্ট ঘাট
খোলা রান্নাঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম রান্নার আয়োজন। এক জায়গায় বানানে হচ্ছে জলপাই এর চাটনি। একপাশে দেখলাম লাউ পাতা কেটে রাখা, এদিয়ে তৈরী হবে নোনা ইলিশের পাতুরী। অন্য আরেক রান্নাঘরে পাশাপাশি চুলায় চলছে পোলাও আর মুরগীর রোস্ট রান্না। পরোটার চুলার কাজ শেষ তাই সেটা বন্ধ। তার পাশেই ঢেকিতে চলছে মাসকলাই ডাল ভাঙার কাজ। ঢেঁকির পাশেই আবার চায়ের স্টল তাই এক কাপ চা খেতে খেতে ছোট বেলারমত ঢেঁকির পাড়ে বসে দেখলাম ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে চা শেষ করে নিজেও চেস্টা করেছি ঢেঁকিতে ডাল ভাঙার। মাছ কোটার জায়গাটা একটু আলাদা, একটু দূরে। বিল থেকে ধরা মাছেই হবে আমাদের আজকের আহার।
অর্ধেকটা এলাকা চক্কর দিয়ে এসে বেশ ক্লান্ত তখন। সবাই যে যার মত ঘোরাঘুরি, আড্ডা-গল্পে মশগুল। আমি মাচাং এর নরম তোষকটায় গা এলিয়ে দিয়ে চার পাশ দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানিনা। ঘুম ভাঙল দুপুরের খাবার পরিবেশনের হাক ডাকে। খোলা আকাশের নীচে শীতের হালকা রোদ পিঠে লাগিয়ে খেতে বসলাম আয়োজন করে। এক সাথে এত মজার মজার খাবার, সব খাওয়া সম্ভব না দেখে এক প্রকার রাগই লাগছিল। টেবিলের ভর্তি কত যে খাবার ছিল সব মনে রাখাও সম্ভব নয়। গতানুগতিক পোলাও, মুরগীর রোস্ট আর সালাদ তো আছেই। সাদা ভাতের সাথে খাবার জন্য ছিল কয়েক রকম ভর্তা, ভাজি, কারি, ডাল, আচার ইত্যাদি। ভর্তা ছিল লইট্যা শুঁটকির ভর্তা, চেপা শুঁটকির ভর্তা, মুসুরের ডাল ভর্তা, কাঁচা টমেটো ভর্তা আর বেগুন ভর্তা। ছিল নোনা ইলিশের পাতুরী, মচমচে করে করলা ভাজা, আলু-বেগুন দিয়ে শুঁটকি, আলু-ফুলকপি দিয়ে পুঁটি মাছ, রুই মাছ ভাজা, মিক্স সবজী, চালতা দিয়ে ডাল, মুড়িঘন্ট এবং ঢেঁকি ছাটা মাসকলাইয়ের ডাল। আরো দু একটা পদ থাকলেও থাকতে পারে, এতসব খাবারের নাম মনে রাখাও সম্ভব না। এমন খাওয়া দাওয়ার পর, দুপুরের নরম রোদ গা এলিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ না করলেই নয়। ছুটির দিনে এই একটু আয়েশের জন্য প্রাণটা মুখিয়ে থাকে।
ভাত ঘুম শেষ হতে না হতেও ফেরার সময় হয়ে যায়। কিন্তু বাউল গানইতো শোনা হলনা প্রাণ ভরে অতএব, গানের জায়গাটায় গিয়ে বিছিয়ে রাখা পাটিতে আয়েস করে গান শুনতে বসে পড়লাম। ঢোল, হারমোনিয়াম আর দোতারার সম্মিলিত সুরের মাঝে ধন্য ধন্য বলি তারে, কে বানাইলো এমন রঙ মহলখানা, চলিতে চরণ চলেনা সহ একটার পর একটা গান গেয়েই চলেছে এই গ্রাম্য গায়েনের দল। আমাদের অনুরোধে রবীন্দ্র সংগীতও হলো দুয়েকটা। গানের সুরগুলোকে মাথায় চাপিয়ে এরপর খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম নৌকায়। শীতের দিন, ছোট দিনের বেলায় খুব তাড়াতাড়িই সূর্য ঢলে পড়ে পশ্চিম দিগন্তে আর সেই সাথে বেজে ওঠে আমাদের ফিরে যাবার ঘন্টা। দুপুরের খাবারই হজম হয়নি এর মাঝে আবারো পরিবেশন করা হল রকমারী শীতের পিঠা। ভরা পেটে আর খাবার প্রশ্নই ওঠেনা তাই পিঠে পুলি ব্যাগে ভরে নিয়ে এক কাপ রং চা হাতে হাঁটতে শুরু করলাম গাড়ীর দিকে।
ঢাকার এত কাছে এমন গ্রামীণ পরিবেশে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগের সদ্বব্যবহার করা উচিত সবারই।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
