চলেছি সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় । থাগনাগের সকাল, চারিদিকে পৃথিবীর বিখ্যাত ও উচ্চতম শৃঙগগুলির রঙগমঞ্চের মাঝে যেন আমি দাঁড়িয়ে। চারিদিকে বরফে শেতশুভ্র থাগনাগকে পিছনে ফেলে আজ রওনা দিলাম সকাল ঠিক ৬ টায়। ঢিলছোড়া দূরত্বে উড়ে বেড়াচ্ছে হিল পার্টিজ। রীতিমত আফ্রিকান স্পটেড হায়নার মতই হাসস্বর তাদের উদ্ধত কন্ঠস্বর। সেই বরফ পিছল রাস্তাতেই আজ ৩ ঘন্টা চলার পর পৌঁছাবো চোলা পাসের মাথায় সেখান থেকে প্রায় ২ঘন্টা নেমে জোংলা পৌঁছে এগিয়ে যাবো লবুচের দিকে। একটা জলস্রোতধারা সাথেই ক্রমশ উর্দ্ধগামী পথ। সাথে চলছেন একজন বয়স্ক পোর্টার।
সত্যি নেপালের এই মানুষগুলো মহামানব। যেখানে উত্তরাখন্ড বা সিকিমের পোর্টারগুলোর ২০-২৫ কিলোগ্রাম ওজনের বেশী বহন করার নির্দেশ নেই সেখানে ইনি একাই চলছেন প্রায় ৫০ কিলোগ্রাম ওজন নিয়ে সেই বরফ পিচ্ছল রাস্তায়। রীতিমত সেই ওজনের ভারেও ক্লান্তিহীন এদের পথচলা শুধুমাত্র মাঝে মাঝে ইংরাজী “T” অক্ষরের মত হাতেই তৈরী একটা কাঠের মোটা লাঠি বরফের মাঝে দাঁড় করিয়ে তার ওপরেই বসে একটু বিশ্রাম। বেশিক্ষণ ওনার চলার সাথে তাল মেলাতেও পারলাম না। আমাকেই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য দাঁড়াতে হলো। ফিরে দেখি পূর্বা শেরপা তার দল নিয়ে আসছে। চড়াই ভাঙগতে ভাঙগতেই উনার এভারেস্ট অভিযান আর লাদাকের বিখ্যাত সব ক্লাইম্বিং পিক অভিযান নিয়ে কথা হল। এবার ওনার “কে-২” অভিযানেও যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু বিশেষ কারণবশত এবছর উনার যাওয়া হচ্ছে না।
প্রায় ২ঘন্টা চড়াইয়ের পর বিশাল এক পাথর-বরফের সংমিশ্রিত মাঠে এসে পৌঁছালাম। দূরে কিছুটা উঁচুতে একটা বৌদ্ধিষ্ট ফ্ল্যাগ দেখতে পেলাম। অনেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। ফ্ল্যাগ দেখেই উত্তেজিত হয়ে পড়লাম তাহলে ২ ঘন্টাতেই পৌঁছে গেছি চোলাপাসের মাথায়। মিথ্যে বলবো না তচ্ছিল্যের সুরে নিজেই মনে মনে বলে উঠলাম “তাতেই চোলা পাস, যেটা নিয়ে এত ভয়।”৩ ঘন্টার রাস্তা মাত্র ২ ঘন্টায় উঠেছি, ভাবছি গিয়েই রেকর্ডটা গ্রিনিচ বুক অফ ওয়ার্ল্ডে লিখাবো কিনা! কিন্তু পৌঁছে যা শুনলাম তাতে রীতিমত হাওয়া বের হয়ে যাওয়া বেলুনের মত ঠিক চুপসে যাওয়া নয় অনেকটা মাইনাস ২৭৩ডিগ্রি তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনে কোন গোলাপ ফুল ডুবিয়ে তা মাটিতে ফেললে যেভাবে কাচের মত ভেঙেগ যায় ঠিক সেভাবেই চৌচির আমার যাবতীয় উদ্ধতা। যেখানে দাঁড়িয়েছি ওটা চোলা পাসের ভিউ পয়েন্ট মাত্র। চোলাপাসের বেসক্যাম্প হিসেবমত এটাই হওয়া উচিৎ ছিলো। কারণ থাগনাগ থেকে এখানে পৌঁছাতেই প্রায় ২ঘন্টার বেশী সময় লেগে যায়।
থাগনাগের সকাল।
যাই হোক নীচে একটা ছোট গ্লেসিয়ারে আবার নেমে তারপর চড়াই করতে হবে পাসের মাথায়। কিন্তু পাসের ভয়নাকরুপ দেখে রীতিমত প্রাণ ওষ্ঠাগত। বরফের ৭০/৮০ ডিগ্রী এক চড়াই কিন্তু রাস্তা কোথায়! ইশ্বরের স্মরণ করে একটু জল আর শুকনো খাবার খেতে বসে পড়লাম। জানিনা এটাই জীবনের শেষ খাওয়া কি না! পকেটে রাতের ভেজানো কিছু কাচা ছোলা। খেতে খেতেই সিদ্ধান্ত নিলাম প্রাণ নিয়ে পৌছলে চোলার মাথায় ছোলা খাবো। তবে এবারও হিমালয়ের কিছু পাখি হাজির আমাদের অনুপ্রাণিত করতে। রীতিমত ভয়হীনভাবে হাত থেকেই প্রায় খাবার খেতে পাশে চলে আসছিলো।
দাঁড়িয়ে আছি একেবারে পাসের নীচে। প্রথমেই ওপাশ থেকে আসা একজন গাইডের সতর্কবাণী Crampon আছে। পায়ে যদিও Wildcraft Amphibia র জুতো। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এই জুতোর গ্রিপটাও কোন কাজেই আসছে না। উঠছি ধীরে ধীরে। নীচে গ্লেসিয়ার পুল। একটু ভুল হলে নিশ্চিত এ যাত্রায় আর বাড়ি ফেরা হবে না। ট্রেকিং ছেড়ে রীতিমত ক্লাইম্বিং চলছে। একটু বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং জানার জন্য সুবিধাও হচ্ছিলো অনেক। সেই তিন হোল্ড সুনিশ্চিত করেই বেসিক ক্লাইম্বিংয়ের নীতিকথার ভরসাতেই ভাঙগছি এই চড়াই। কখনও পিঞ্চ হোল্ড, থাম হোল্ড বা ইনার কাট। কিন্তু কোন আলগা পাথর ধরতে গিয়ে খসে পড়লে অথবা পা হড়কালে শরীর বেয়ে কারেন্ট দৌড়ে যাচ্ছিলো।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হার মেনেছে যার আত্মবিশ্বাসে।
তবে আগেও বলেছি বিপদের ভয় থাকে ট্রেকিংয়ের যে অংশটায় সেটায় ট্রেক করতে আলাদাই ভালো লাগে। তাই ধীরে ধীরে হলেও আলাদাই অ্যাড্রিনালিন রাশ ফিল করছিলাম। এই পথেই একজন বিদেশি ট্রেকার প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসছিলেন। ভয়মিশ্রিত চোখে তার কন্ঠস্বরে বক্তব্য ” ইফ আই অ্যালাইভ, আই ওইল নেভার কাম নেপাল এগেইন।” একেবারে আমার উল্টো ভাবনা। হিমালয়ের বুকে চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে যাওয়ার মৃত্যুও কম গর্বের নয়! তবে একইপথে থাগনাগের দিকে রসদ নিয়ে নামছিলেন দুজন পোর্টার। কিন্তু সত্যি এই দুরূহ পথেও তাদের চলার ভঙ্গির মধ্যে এতটাও অসাবলীলতা নেই।
প্রায় ৪ ঘন্টা কেটে গেছে। পাসের শেষ অংশটা অনেকটা Overhang কার্নিশের মত। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হিসেব-নিকেশ শেষ চেষ্টার। হঠাৎ মারাদোনার সেই গোলের মতই আমার সামনে হাজির এক “Hand’s of God.” তুষার গাইতি বরফে লাগিয়ে একজন দাজু পাসের প্রায় মাথায় দাঁড়িয়ে আমায় বললেন “তিমরো হাত দিনুস মলাই।” সেই হাত ধরে ক্রলিং করে অবশেষে পৌঁছালাম চোলা পাসের মাথায়।
উত্তেজনার শিহরণ বয়ে যাচ্ছিলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পেরেছি চোলায় পৌঁছতে। চারিদিকে উচ্চতম শৃঙগগুলোর অ্যাম্পিথিয়েটার সাজানো যেনো। অনেকেই ব্যস্ত ছবি তুলতে। একজন চাইনিজ যুবতীর সাথে দেখা পাসের মাথায়। এই উচ্চতাতেও সে খুশি মনে ঠোটের সাজসজ্জা করছিলো লিপস্টিক লাগিয়ে,যা আমাকে বিশ্বাস করাতে রীতিমত বাধ্যই করেছিলো যে মেয়েরা যে কোনস্থানে, যে কোন পরিস্থিতিতেই মেকআপ করতে পারে। মেকআপ শেষ হলে তার অনুরোধে কিছু ছবিও তুলে দিলাম তার। আজ সে ট্রেকিং একটু দেরী করে শুরু করায় দলের অন্যরা আগেই থাগনাগের দিকে নেমে গেছে এবং সে এখন একাকী আমাদের ক্লাইম্ব করা পথে নামবে শুনে আতকে উঠলাম। মনে মনে চিন্তা হল যে ” এই মেয়েটার আদতেও কি সামান্যতম ধারণা আছে যে তার জন্য কি ভয়ংকর পথ অপেক্ষা করে আছে। আর সে নিশ্চিন্তে লিপস্টিক লাগিয়ে ফটোশুট করাচ্ছে।” বিদায় জানাতে গিয়ে সর্বশক্তিমান ইশ্বরের কাছে তার জন্য সফলতা কামনা করলাম। কিন্তু সাথে নিজেরও মাথায় চিন্তা এসে গেলো “আচ্ছা আমাকেও তো এবার জোংলার দিকে নামতে হবে।”
আরেকটা বয়স্ক ট্রেকিংদল তখনও পাসের মাথায়। তাদের গাইড তাদের জন্য ফিক্সড রোপ লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু আমাদের ভরসা ওই সন্তর্পণে দুপায়ের ওপর। নীচে বরফের বিশাল মাঠ। ক্রিভাস থাকলেও কোন উপায় নেই আন্দাজ করার। তাই পায়ের ছাপের ভরসাতেই হাঁটছি অতি সন্তর্পনে। আইসফিল্ড শেষ হয়ে অনেকটা নীচে নেমে গেছে এই পথ। তবে উল্টো দিকের তুলনায় এই দিকটায় পাথরের খাঁজগুলো অনেকটাই বেশী তাই পিচ্ছিলতা কিছুটা কম। পথেই দেখা আবার কোস্টারিকার কোহলির সাথে। একসাথেই প্রায় ৫ ঘন্টায় নেমে আসলাম একটা প্রায় সমতল জায়গায়। পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম উত্তেজনায় চোলায় ছোলা খাওয়ার কথা ভুলেই গেছি। কিন্তু আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো আরও বড় সারপ্রাইজের। ভেনিজুয়ালের একজন ট্রেকার যিনি চোলাপাস পার করে একটা পাথরে বসে আছেন যার দুটো পা কৃত্রিম। সত্যি তার সম্মানে নিজেই নতজানু হলাম। আন্দাজ করতে পারছিলাম শারীরিক প্রতিবন্ধকতাতেও ঠিক কতটা মানসিক শক্তি হলে এতটা বিশ্বাস থাকা সম্ভব নিজের সফলতার ওপর।
যাত্রা শুরু থাগনাগ থেকে।
বিশাল একটা ভ্যালী পার হয়ে আবার কিছুটা চড়াই ভাঙগতেই দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিলো জোংগলাকে। সিদ্ধান্ত হল আজকে আর আর লবুচে যাওয়া সম্ভব নয় অগত্যা ঠাই নিলাম জোংলাতেই। সেই সুযোগে একটু শেভ করে আজকে একটু মানুষ হওয়ার সুযোগটাও পাওয়া গেলো। রাতে Camouflage টুপিতে আমাকে একেবারে ব্রাজিলীয়ন বিখ্যাত খেলোয়াড় রোনাল্ডিনিহোর কমবয়েসী চেহারার মত দেখতে বলে সম্বোধনও জুটলো। অনেকদিন পর ৫০ নেপালী রুপি খরচ করে বাড়িতে ফোন করলাম। কিন্তু নের্টওয়ার্কের সমস্যার জন্য বাবা কিছুই শুনতে পেলেন না। কিন্তু ধীরস্থির হ্যালো হ্যালো শুনে আন্দাজ করলাম বাড়িতে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে।
চলবে…
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (১ম পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (২য় পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৩য় পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৪র্থ পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৬ষ্ট পর্ব)
লিখেছেন তাপস কুমার রায়। স্বাস্থ্যদপ্তরে এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন। নেশা- ক্রিকেট, ট্রেকিং, ইতিহাস ও একটু আলাদা টাইপ অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ আর সাপ।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
