চলেছি সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় । রাত ৭ টার ইন্দো-নেপাল সীমান্তের কাক্করভিটা থেকে জয়নগর বাসের টিকিট কেটেই বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি।কারণ হিসেব অনুযায়ী আমার গন্তব্য মিরচাইয়ায় পৌঁছবো রাত ২টায়। হিসেব অনুযায়ী পরেরদিন কাক্করভিটায় থেকে ভোরের বাস ধরে দুপুরে মিরচাইয়া পৌঁছলেও অসুবিধা ছিলোনা। যাইহোক অগত্যা দোকান থেকে একটা নেপালি সিম নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম।

রাত ২.৩০। আমি মিরচাইয়ার কাটারিচকে দাঁড়িয়ে। মানুষ বলতে আমি একাই। কিন্তু বরাবরই নেপালীরা আমার বিশ্বাসের অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকায়, চুরি বা ছিনতাইয়ের এক ফোঁটা চিন্তাও মাথায় আসেনি তখন। কিন্তু রাস্তার পাশের একটা টেবিলে বসে আকাশের রুদ্রমূর্তি দেখে কিছুটা শঙিকত হওয়ার সাথে মশার আক্রমণে নাজেহাল হয়ে ভাবতে থাকি বাকি রাতটা কাটাবো কিভাবে!

বেশিক্ষণ হয়নি জয়নগর থেকে কাক্করভিটার বাস থেকে নামল এক যুগল। পরে কথা বলে বুঝেছিলাম সেদিনই তারা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। আমাকে দেখতে পেয়ে তাদেরও যেন একটু সাহস হল। ছেলেটি নেপালী ভাষায় আমার ফোন থেকে তার কোন দাদাকে ফোন করতে চাওয়ায়, আমার মনে পড়ে নতুন নেওয়া নেপালি সিমটার কথা। তার ফোনেই সিমটা অ্যাক্টিভেট করে আমি তাকে সিমটা ব্যাবহার করতে দিলাম। পাশেই একটা লামা হোটেল, কিন্তু এমন একটা ভাষায় ফোন নাম্বার লিখা যে আমি উদ্ধার করতে না পারলেও ওই যুগলের মেয়েটির সাহায্যে নাম্বারটি উদ্ধার করে ফোন করেও শেষমেষ লাভের ভাড়ার শূণ্যই রইলো। হোটেলের মালিক জানিয়ে দিলেন কোন রুম ফাঁকা নেই। অগ্যতা আমাদের তিনজনের রাতজাগা চায়ের দোকানের বারান্দায়।

প্রথম দর্শন এক বিখ্যাত নেপাল হিমালয়ের শৃঙেগর- লম্বুর হিমাল

এদিকে ছেলেটির সেই দাদা ও তার ৪ বন্ধু হাজির রাত ৩টার দিকে। তারা বাকি রাতটা আমাকে সঙগ দেবে এটা বলে আমাকে নিশ্চিত করলেন। তাদের ইন্টারেক্টিভ আলোচনা ও মশার কামড় দুটোই সমানতালে চলল রাত ৪ পর্যন্ত। এরপর চায়ের দোকান খোলার  সাথে সাথেই হাজির কিছু স্থানীয় মানুষও। ক্ষিদের জ্বালায় নয়, শুধুমাত্র সময়  কাটানোর জন্য প্লেটে নিয়ে বসলাম নেপালের মিস্টি। কিন্তু একটু ফ্রেশ হওয়া আর ৪/৫ ঘন্টার একটা ঘুম খুব দরকার ছিলো। অগ্যতা হোটেলের খোঁজে বের হলাম মিরচাইয়ার রাস্তায়, কিন্তু এই সকালে সবকিছুই বন্ধ।

নিশ্চিন্তে যেথায় বসবাস হাজার পাখির।

দুজন ব্যক্তি রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনকিছু নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তাদের কাছে হোটেলের ব্যাপারে জানতে চাইলে অগত্যা তারা আমাকে ভারতীয় জানতে পেরে অরুণাচলের “পরশুরাম কুন্ড” ব্যাপারে জানতে চাইলে আমি তাদের এব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ায় তারা খুশি হয়ে আমাকে তাদের রুমটা নেওয়ার অফার করেন কারণ তারা ভোরেই কাঠমান্ডুর উদ্দ্যেশে রওনা দেবেন। আমার অত্যন্ত প্রিয় নর্থইষ্টের ট্রাভেলিং নিয়ে যাবতীয় তথ্য রাখার একটা সুফল পাওয়ায় মনে মনে খুব খুশিও হয়েছিলাম। অগত্যা সকাল ৬টায় অবশেষে ঠাই পেলাম হোটেল “এভারেস্টে”। শুরুতেই এভারেস্ট, তা সে হোটেলের নামই না হয় হোক কিন্তু দারুণ এক অনুভূতি। রুমে গিয়েই গভীর ঘুম। হোটেলের কর্মচারীর ডাকাডাকিতে উঠলাম সকাল ১১টায়। কলকাতা থেকে এই ট্রেকিং এর একমাত্র সঙগী দেবরাজদা হাজির হোটেলে। এরপর স্নানখাওয়া শেষে বেলা ১২টায় হাজির হলাম কাটারিচকে।গন্তব্য কাটারী।

ফেভিকল আঠার অ্যাডের মত ভিড়ে ঠাসা বাসে কাটারীর উদ্দ্যেশে রওনা। রাস্তা ততধিক খারাপ। বাসের স্পিড ১৫ কিমির বেশী ছিলোনা কখনই। মাত্র ৩০ কিমি যেতেই লেগে গেলো প্রায় ২ ঘন্টা। সেখান থেকে জীপে ওখালডুঙগা পৌঁছানো রাত ৭ টায়। পরের দিন সকালে আবার জীপে করে রওনা ফাপলুর দিকে। সেখানে পৌঁছে জানতে পারলাম জীপ এখন রিংমোর থেকে আরও আগে তাকসিন্দুলা পর্যন্ত যাবে, কিন্তু সমস্যা ১০ জন আরোহী পাওয়ার পরেই জীপ ছাড়বে। অগত্যা তাতো চিয়া (গরম চা) খেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ট্রেক- নুনথালার পথে।

কারিখোলার পথে -গন্তব্যের মুখ্য আকর্ষন অসংখ্য সাশপেনশান ব্রিজ।

৬ জন হলে অগত্যা দড়াদড়ি করে রওনা দিলাম তাকসিন্দুলার উদ্দেশ্যে। আকাশছোঁওয়া ভাড়া চাইলেও, আমরা হেঁটেই রওনা দেবো বলায়, জীপের ড্রাইভার কিছুটা বাধ্য হয়েই ৫০ টাকা বেশী নিয়ে অবশেষে যেতে রাজী হলেন। রাস্তার অবস্থা আরও দূর্বিসহ। মাঝেই এসে মিশেছে জিরির সেই প্রাচীন তেনজিং-হিলারির  এভারেস্ট অভিযানের সেই বহুপুরোনো  রাস্তা। বেলা ১টায় জীপে নৌকার দুলনি খেয়ে পৌঁছালাম তাকসিন্দুলা। ভাড়া দিতে গিয়ে আরেক ঝামেলা। ড্রাইভার ভারতের একশ টাকার নোট নেবেন না, উল্টে উপরেও চলবেনা বলে অযথা ভয় দেখালেন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সমগ্র নেপালে ভারতের ১০০টাকার নোট বৈধ এবং মূল্য নেপালের ১৬০ টাকা। এখানে জানিয়ে রাখি বাকি সমগ্র ট্রেকিং পথেই আমরা ভারতের ১০০ টাকার নোট ব্যবহার করেছি, কোনরকম কিছু অসুবিধাও হয়নি। অনেক বুঝিয়ে ভাড়া মিটিয়ে বেলা দেড়টায় ট্রেকিং শুরু করা হল।

পোস্টকার্ড পিকচার- তাকসিন্দুলা।

শুরুতেই বিশাল উৎরাই নুনথালার পথে।নেমেই যাচ্ছি রাস্তা, ধানক্ষেত, এলাচেরক্ষেত দিয়ে। নুনথালাতেই যাবতীয় পরিবহনের রাস্তা শেষ। ট্রাকট্রর চলে মাঝে মাঝে। এরপর ভরসা শুধুই দু-পা। নুনথালা পেরিয়ে সাশপেনশান ব্রিজপার হয়েই চড়াই আর চড়াই। প্রায় অন্ধকার পথে হেঁটেই প্রথমদিনের ট্রেকিং এর অবসান কারিখোলায়।

চলবে…

• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (২য় পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৩য় পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৪র্থ পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৫ম পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৬ষ্ট পর্ব)

লিখেছেন তাপস কুমার রায়। স্বাস্থ্যদপ্তরে এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন। নেশা- ক্রিকেট, ট্রেকিং, ইতিহাস ও একটু আলাদা টাইপ অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ আর সাপ।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

মেঘের দেশ সাজেকমেঘের দেশ সাজেক
আন্ধারমানিকজার্নি টু আন্ধারমানিক

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

মেঘের দেশ সাজেকমেঘের দেশ সাজেক
আন্ধারমানিকজার্নি টু আন্ধারমানিক

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

মেঘের দেশ সাজেকমেঘের দেশ সাজেক
আন্ধারমানিকজার্নি টু আন্ধারমানিক

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!