বিগত দশকগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে ভ্রমণ এখন অনেক বেশি জনপ্রিয়। তুলনামূলক অনেক বেড়েছে ভ্রমণকারীর সংখ্যা। সড়ক, রেল বা আকাশ পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণকারীদের জন্য নানা রকম সুবিধা, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তথ্য সহজলভ্যতা মানুষকে ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে ভ্রমণ এখন একটা ট্রেন্ড। কিন্তু অনেকেই আবার ভ্রমণে নিরুৎসাহিত রয়ে গেছেন অনেক কারণেই তারমধ্যে অন্যতম কারণ হল ভ্রমণ ব্যয়। অনেকেরই ধারণা ঘুরে বেড়াতে অনেক টাকা লাগে, বিশেষ করে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা না থাকলে বিদেশ বিভূঁইয়ে ঘুরতে যাওয়া উচিৎ নয়। ভ্রমণ ধনীদের সখ হিসেবেই দেখে আসা হয়েছে এত কাল। তবে শুনেছি নেশার টাকা নাকি ভূতে যোগায় আর ভ্রমণতো এক প্রকার নেশাই। তাই আপনি যদি চান ভ্রমণ করতে তবে আপনি নিজে থেকেই কিছু কৌশল বের করে ফেলতে পারবেন যা দ্বারা সম্ভব হবে আপনার ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণের।
আপনার কাছে যদি একটা স্মার্ট ফোন থাকে আর আপনি যদি ভ্রমণ সম্পর্কিত বিভিন্ন সাইটগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট জানেন আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে একটা সুন্দর পরিকল্পনা সাজিয়ে স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করতে পারবেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এবং রাশেদুল ইসলাম ইমরানের কাছ থেকে পাওয়া কিছু টিপস আপনাদের জানাব যা আপনাদের স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করতে সাহায্য করবে।
লংকাউয়ির স্কাই ব্রিজ।
১. প্রমোশনাল অফারে বিমান টিকেট ক্রয়ঃ চোখ রাখুন বিভিন্ন এয়ালাইন্সের প্রোমোশনাল অফারগুলোতে। রিজেন্ট এয়ারওয়েজ প্রায় প্রতি বছরই ঢাকা-কুয়ালালামপুর-ঢাকা রুটে প্রোমোশনাল অফার দিয়ে থাকে যেখানে আপনি ১৫০০০ থেকে ১৭০০০ টাকায় যাওয়া আসার টিকেট কিনতে পারবেন যার স্বাভাবিক ভাড়া ২২-২৫ হাজার টাকার মত। এটা হয়তো সবসময় সবার ক্ষেত্রে সম্ভব হবে না তবে আপনার ভ্রমণের তারিখ যদি রিলাক্সড হয় এবং সব কিছু ম্যানেজ করার সুবিধা থাকে তাহলে এরকম সুযোগ হেলায় হারানো উচিৎ নয়। প্রমোশনাল অফার যদি নাও থাকে, এটা সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য যে বিমানের টিকেট যত আগে কিনবেন ততই কম টাকায় পাবেন (কিছু ব্যতিক্রম বাদে যেমন ঈদ বা ক্রিসমাসের সময়)। এছাড়া আপনি যদি নিয়মিত ভ্রমণ করে থাকেন তাহলে সব সময় এক এজেন্টের কাছ থেকে টিকেট কিনুন যারা আপনার কাছে সবসময় মিনিমাম দামে টিকেট বিক্রি করবে। এছাড়া আপনার যদি ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড থাকে তাহলে সেটা দিয়ে সরাসরি এয়ারলাইন্স বা অন্যান্য বিক্রয় সাইট থেকে টিকেট কিনলে একটু কম দামে কিনতে পারবেন।
লংকাউয়ির বাজেট হস্টেলে।
২. হোটেল বুকিংয়ের জন্য অনলাইন বুকিং: অনলাইন হোটেল বুকিং সাইট আজকাল অহরহ দেখতে পাওয়া যায়। এসব সাইট যে ট্রাভেলারদের কত সময় এবং খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছে সেটা কল্পনাও করা যায়না! Airbnb বা কাউচ সার্ফিং এর মাধ্যমে আপনি স্বল্প মূল্যে বা বিনা পয়সায় স্থানীয় হোস্টদের ঘরে থাকতে পারবেন। বুকিংয়ের জন্য ব্যবহার করত পারেন booking.com ও agoda.com। এত সাইটগুলো থেকে কম দামে হোটেল বুকিং দিতে পারবেন আপনি। আবার যদি বেশ কয়েকবার এই সাইট থেকে বুকিং দেন তাহলে আপনার মেম্বারশিপ আপগ্রেড করে অনেক ধরণের ডিসকাউন্ট পেতে পারেন। agoda.com অনেক সময় অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ডধারীদের ১০ ভাগ ডিসকাউন্ট দেয়। এসব সাইটের মজা হল বিভিন্ন হোটেলে এখানে অতিরিক্ত ডিসকাউন্ট অফার করে সারা বছর জুড়েই। সেই ডিসকাউন্ট কিন্তু সরাসরি গেলে পাওয়া যাবেনা। এটা সাইট এবং হোটেলের মধ্যে পার্টনারশিপ চুক্তির মাধ্যমে অফারগুলো হয়ে থাকে। আবার বুকিং করতে হলে যে আগেই মূল্য পরিশোধ করতে হবে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে তাও নয়। অনেক হোটেলে সুযোগ থাকে আগে বুকিং দিয়ে পরে হোটেলে পৌঁছে তারপর মূল্য পরিশোধ করার। এছাড়া আছে বিভিন্ন ধরণের ইয়থ হস্টেল যেখানে অত্যন্ত কম খরচে প্রাইভেট রুম বা শেয়ার রুম বা ডরমিটরিতে থাকা সম্ভব।
৩. কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে শহরে যেতে বাস বা গ্র্যাব ব্যবহারঃ কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (কেএলআইএ) শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। এখান থেকে কুয়ালালামপুর শহরে যেতে চারটা বিকল্প আছে – মেট্রো রেল, বাস, ট্যাক্সি, ও উবার/গ্র্যাব। কেএলআইএ থেকে কুয়ালালামপুর সেন্টাল স্টেশন বাস ভাড়া মাত্র ১০ রিঙ্গিত (নোটঃ ১ রিঙ্গিত=১৮.৫০ টাকা), যেখানে মেট্রো ভাড়া ৫৫ রিঙ্গিত, ট্যাক্সি ভাড়া ৮৫ রিঙ্গিত, ও উবার/গ্র্যাব ভাড়া ৭০-৭৫ রিঙ্গিত। বাসে করে যেতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা আর মেট্রোতে করে ২৮ মিনিট। ৩২ মিনিট সময় বাঁচাতে অতিরিক্ত ৪৫ রিঙ্গিত খরচ করা বাজেট ভ্রমণকারীদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হবে না। বিলাসবহুল এসি বাসে ভ্রমণও খুব আরামদায়ক।
৪. এয়ার এশিয়ার ডোমেস্টিক ফ্লাইটঃ কুয়ালালামপুর থেকে লংকাউয়ি যাওয়া-আসার জন্য কয়েকটা পথ আছে। সবচেয়ে সুলভ হচ্ছে বাস+ফেরিতে ভ্রমণ, আর সবচেয়ে খরুচে হচ্ছে ট্রেন+ফেরি। আর আকাশপথ হচ্ছে এর মাঝামাঝি, মানে বাসের চেয়ে খরুচে কিন্তু ট্রেনের চেয়ে সস্তা। ও হ্যাঁ, আকাশপথ বলতে আমি এখানে এয়ার এশিয়ার ব্যাগেজ ফ্রি ভাড়ার কথা হিসেব করে বলছি। কুয়ালালামপুর থেকে লংকাউয়ি যাওয়া-আসা মিলিয়ে মোট খরচ হয়েছে মাত্র ৩০ ইউএস ডলার! মানে মাত্র ২৫০০ টাকার মত! এক ঘণ্টার এই ফ্লাইটে কোন খাবার নেইনি আমি। লাগেজও ছিল না সাথে, কেবিন ব্যাগেজ অ্যালাউন্সের ৭ কেজি কোটাতেই আমার দিব্যি চলে গেছে। এই আকাশপথের খরচ যদিও বাসের চেয়ে একটু বেশি কিন্তু এটা আমার যেই পরিমাণ সময় এবং শক্তি বাঁচিয়েছে সেটা হিসেব করলে এই পথের উপযোগিতা বাকি সবগুলোর চেয়ে বেশি।
মালাক্কার পথে প্রান্তরে।
৫. লংকাউয়িতে মোটরবাইক ভাড়াঃ লংকাউয়ি অসাধারণ সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ একটা দ্বীপ কিন্তু এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে শুধু ট্যাক্সি অথবা উবার/গ্র্যাব। সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হচ্ছে যে কয়দিন লংকাউয়ি থাকবেন সে কয়দিনের জন্য মোটরবাইক বা গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া। সেক্ষেত্রে অবশ্যই দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে যেতে হবে সাথে। আমি প্রতিদিন ২০ রিঙ্গিত করে দুই দিনের জন্য মাত্র ৪০ রিঙ্গিতে একটা মোটরবাইক ভাড়া নিয়ে নিয়েছিলাম আমার কটেজ থেকেই। এর সাথে শুধু অতিরিক্ত ৫ রিঙ্গিতের তেল কিনতে হয়েছে আমার। এই দিয়েই দুই দিনে লংকাউয়ি চষে বেড়িয়েছি। দুই দিন পর কুয়ালালামপুর ফেরার সময় হিসেব করে দেখলাম যত জায়গায় আমি ঘুরেছি, সেখানে মোটরবাইক এর বদলে যদি উবার ব্যবহার করতাম তাহলে আমার ভাড়া আসতো ১০০০ রিঙ্গিতেরও বেশি, যেখানে আমার খরচ হয়েছে সাকুল্যে ৪৫ রিঙ্গিত!
৬. Tripadvisor এর ব্যবহারঃ পুরো ভ্রমণেই নানান তথ্য দিয়ে সাহায্য করা Tripadvisor.com আমার খরচ কমাতেও এগিয়ে এলো খাবার বেলায়। বিদেশে গিয়ে সেখানকার স্থানীয়, ভাল ভাল খাবার কে না চেখে দেখতে চায়! কিন্তু যদি ভ্রমণকারীর পরিচিত কেউ ওই দেশে না থেকে থাকে তাহলে ভাল রেস্টুরেন্টের খোঁজ পাওয়া একটু মুশকিল বটে! আর শুধু ভাল হলেই তো হবে না, খরচটাও তো হাতের নাগালে থাকা চাই! এখানেই আমার সাহায্যে এগিয়ে এলো Tripadvisor.com। এই সাইটের মোবাইল অ্যাপ থেকেই আমি দেখে নিলাম ভ্রমণকারীদের রেটিংয়ে কোন কোন রেস্টুরেন্টগুলো একইসাথে ভাল এবং সুলভ মূল্যের। এবং সেসব জায়গায় গিয়েই চেখে দেখলাম মজার মজার সব নাসি গোরেং, ইকান বাকার ইত্যাদি। তবে এর সাথে আরেকটা জিনিসও অনুসরণ করেছি; সেটা হল স্ট্রিট ফুড চেখে দেখা। কুয়ালালামপুরে জালান আলোর নামে একটা জায়গা আছে যেখানে সারি সারি স্ট্রিট ফুডের দোকানে বিক্রি হয় মালয়েশিয়ার প্রায় সবরকম স্থানীয় খাবার। এই স্ট্রিট ফুডে খরচ স্বাভাবিকভাবেই অনেক কম হয়। কুয়ালালামপুরেই আমি অনেক সস্তায় জাপানিজ খাবার সুশি খেয়েছি।
লংকাউয়ির স্কাই ব্রিজে।
৭. কুয়ালালামপুর শহরে যাতায়াতে উবার/গ্র্যাবঃ স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করতে ব্যবহার করতে পারেন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। কুয়ালালামপুর শহরে সব রকম পাবলিক ট্রান্সপোর্টই রয়েছে – মেট্রোরেল, মনোরেল, বাস, ট্যাক্সি, উবার/গ্র্যাব। কিন্তু সহজলভ্যতা, আরাম, এবং খরচ সবদিক হিসেব করে উবার বা গ্র্যাব এর সার্ভিসই নিতে পারেন। এক্ষেত্রে যদি তিনজন একত্রে ভ্রমণ করা যায় তাহলে সেটা হবে সবচেয়ে সাশ্রয়ী কারণ ভাড়াটা তখন মাথাপিছু সেভাবেই শেয়ার হয়ে যায়। আপনি যদি একা বা দুজন থাকেন তাহলে গ্র্যাব শেয়ার ব্যবহার করতে পারেন যা আরও সাশ্রয়ী। তবে ভ্রমণকারী যদি হয় একজন তবে মেট্রো বা মনোরেলে একটু কম ভাড়া পড়বে, যদিও সেটার জন্য আপনাকে হাঁটতে হবে প্রচুর, কুয়ালালামপুরের তপ্ত আবহাওয়ায় যেটা একটু কঠিনই।
৮। ফ্যামিলি বান্ডেল শপঃ এই দোকানগুলোতে আপনি পুরানো, অব্যবহৃত বা ব্যবহৃত কাপড়, টুপি, ব্যাগ ইত্যাদি জিনিস পত্র পাবেন অত্যন্ত কম দামে। দোকান ভরা জিনিসের মধ্যে আপনার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি হয়তো একটু খুঁজতে হবে কিন্তু বাইরে অন্য দোকানের চাইতে অনেক কম দামে পাবেন সেখানে।
কোথাও যাবার আগে সেই জায়গা সম্পর্কে একটু জেনে গেলে এভাবে সব জায়গাতেই কিছু না কিছু উপায় পাওয়া যায় খরচ কমানোর জন্য। সারা পৃথিবীর ব্যাকপ্যাকাররা এই সব টিপস মেনেই কম টাকায় ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। তাই সুযোগের অপেক্ষায় না থেকে টিপস গুলো কাজে লাগান আর সুযোগ তৈরি করে নিন। শুভ হোক আপনার ভ্রমণ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ রাশেদুল ইসলাম ইমরান।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।