অনেক দিন ধরেই বান্দরবানের রুমা/ বগালেক বাদে অন্য কোথাও পা বাড়ানোর শুধু স্বপ্নই দেখে গেলাম, পরিকল্পনা করেই গেলাম, ব্যাকপ্যাকও গুছিয়ে ফেললাম, কিন্তু নানা ঝামেলায় পা আর বাড়ানো হলনা। ল্যাপটপের পর্দা দিয়ে ওই গুগল আর্থ পর্যন্তই। তারপরেও স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন । হাজারটা ঝামেলার মাঝে আবার পরিকল্পনা করতে থাকলাম। আমি আর মিনহাজ মিলে ঠিক করি যে ঈদের ছুটিতে পাহাড়ে থাকতেই হবে আর সফল করতে হবে নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন । মিনহাজ বাড়িতে জানিয়ে দিল কোরবানির ঈদে বাসায় যাবে না। পরে সাইফও যোগ দিল আমাদের সাথে। বাসের টিকিট কাটলাম এবং বাসে উঠে বসার পর আমরা অতঃপর বুঝতে পারলাম এবার যাওয়া হচ্ছে আমাদের।

বাস কমলাপুর থেকে সময়ের মোটামুটি আধা ঘন্টা পরে ছেড়ে দিল। মজার ব্যাপার, প্যারার ব্যাপার যাই বলিনা কেন ব্যাপারটা হল আমাদের ড্রাইভারের এটাই বান্দরবানে প্রথম যাত্রা।  সম্পূর্ন অনভিজ্ঞ একজন ড্রাইভারের হাতে আমাদের বাস। অনভিজ্ঞতাটা শুধু বান্দরবান শহরের পৌঁছানোর আগের পাহাড়ি রাস্তাটুকুর ক্ষেত্রে। একটু ভুলে আমরা ভীষণ বিপদে পড়তে পারি আর শেষ হয়ে যেতে পারে আমাদের নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন । রাত পোহালেই ঈদের সকাল। হাইওয়েতে জ্যামের যেমন আশংকা করেছিলাম তেমনটা ছিল না।

চট্টগ্রাম শহর যখন অতিক্রম করছি তখন দিনের আলো ফুটে গেছে। এখানে এখানে ওখানে গরু বাঁধা। এদের কোরবানি করা হবে। ঈদের সকাল। মানুষের ব্যস্ততা আর এই নিরীহ জন্তুগুলোর জন্য আফসোস করছি। বান্দরবানে পৌঁছাই সকাল ৮ টায়। আমরা তাড়াতড়ি হেঁটে রুমা যাবার বাস স্ট্যান্ডে চলে যাই। বাস সাড়ে আটটায় ছাড়বে। সম্পূর্ন অন্যরকম একটা ঈদের দিনের শুরু আমাদের তিনজনের। শহরে অন্যরা এখন অন্যরকম সময় কাটাচ্ছে। ওরা আজ অনেক রক্ত দেখবে, আর নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন তে বিভোর আমরা দেখব অনেক সবুজ।

রুমা বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে শুনি ঈদের দিন এর দোহাই দিয়ে ওরা বাস সম্পূর্ন না ভরা পর্যন্ত ছাড়বে না। অল্প কয়টা মানুষ আমরা বাস স্ট্যান্ডে। আশা করে ছিলাম যে নামাযের পর হয়ত লোক এসে পড়বে। কিসের কি, সেই বাস আমাদের কে সাড়ে তিন ঘন্টার জন্য ল্যাটানোর সুযোগ দিয়ে ঠাই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। আমরা ওখানে অলস সময় কাটাচ্ছি। আর আমাদের নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন পরিকল্পনার বারোটা বেজে কখন অন্য কিছু বাজবে তার আলোচনা করতে করতে ১২ টার দিকে বাস ছেড়ে ৩ টার দিকে পৌঁছে গেল রুমা।              

রুমায় নামার একটু আগে থকেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বৃষ্টিটা এই মুহুর্তে কাম্য না মোটেই। আমরা রুমা বাজারে ঢুকেই বুঝে নিলাম ঝামেলা হবে। ট্যুরিস্ট একটাও দেখা যাচ্ছে না। তার মানে আর্মিরা ব্যস্ত না। রুমা বাজারে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে জিপিএস এ রাস্তাটা দেখে বুঝে নিলাম। মিলিটারির ক্যাম্পের নিচে দিয়েই সোজা যেই রাস্তা ঐ রাস্তা ধরেই যেতে হবে। কালপুরুষ অপূ ওস্তাদের শেখানো মন্ত্র পাঠ করে আমরা আর্মি ক্যাম্প পার হয়ে গেলাম। আমি আর সাইফ একসাথে আর মিনহাজ পরে আমাদের সাথে যোগ দেয়। আর্মি ক্যাম্প পার হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল বার বার এই ডাক দিল। আমরা হাঁটতে হাঁটতে ঘরবাড়ি পার করে রাস্তা ইতোমধ্যে একবার ভুল করে মোটামুটি আপহিল ট্রেইল ধরে হাঁটা শুরু করে দিয়েছি। এখন একেবারেই নিশ্চিত যে আর্মি আর দেখবে না আমাদের। চূড়ান্ত স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছিলাম। এই রাস্তায় এখন আমি ইচ্ছা মত চলতে পারব। কোন গাইড নাই, আর্মি নাই, মানুষ নাই। ইচ্ছা হইলে হাঁটব, ইচ্ছা না হইলে ল্যাটাব। কার কি যায় আসে?

আমরা মোটামুটি আধা ঘন্টা হেঁটে বৃষ্টির কবলে পড়লাম। সাইফ ব্যাগের ওজনে এরই মধ্যে প্রায় কাবু হয়ে যাচ্ছে। চেহারা দেখে বোঝাই যায় বেচারা স্বাধীনতার দাম দিচ্ছে। ওজন কমানোর জন্য টেন্ট আর রেইন কোট রাস্তার পাশে জংগলের মধ্যে রেখে আসল। জিপিএস এ মার্ক করে রাখলাম জায়গাটা। এখানে এসে আমরা মোটামুটি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। তখন ৪ টার বেশি বাজে। আমি এর মধ্যে জুতা পরে ব্যাগটাকে কোনরকম পলিথিন দিয়ে ঢেকে নিলাম। তখন উপর থেকে একটা দল নেমে আসছিল। তারাও আমাদের মত পলাতক আসামী। তারা সকালে প্রাংশা ঝর্না দেখার জন্য বেরিয়েছিল। আমরা তাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে সামনে আপহিল ধরে উঠতে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ একটানা উঠার পর এখন সমান রাস্তা। এটা গাড়ীর রাস্তা। জায়গাটা উঁচুতে অনেক। এখানে এসেই আমাদের ল্যাটানো শুরু হল।

একটু পর আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। কিসের জন্য যে আমার এই ভারী ব্যাকপ্যাক বয়ে, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে, জ্বিহবা বের করে হাপাতে হাপাতে পথ চলা জানিনা। হয়ত জানে আমার অবচেতন মন। আমরা শনের বনের মধ্য দিয়ে আশপাশের কাছে দূরের পাহাড় দেখছি আর হাঁটছি। আমাদের সামনে রাস্তা ঢেউ খেলে নিচ থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে আবার উপর থেকে নিচে নেমে যাচ্ছে। চোখের সামনে দুইজন ভারি ব্যাকপ্যাক ঘাড়ে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মিনহাজের মোবাইলে “শ্যামের বাশি ডাকছে রাধা রাধা” গানটা বাজছে। মেঘ গুলো আমাদের পাহাড়ি রাস্তার উপর দিয়ে আমাদের মাথায় শীতল হাত বুলিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে।

এভাবে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে এমন সময় আমাদের একটা খাঁড়া নামতে হবে। এতক্ষণ উপর দিয়ে হাঁটছিলাম। আলো কিছুটা পাচ্ছিলাম। এই খাঁড়াটা নামতেই অন্ধকারে মুড়ে গেলাম। একটু কেমন কেমন করে উঠল শরীর। সতর্কতা অবলম্বন করে নেমেও গেলাম। মাথা ঠাণ্ডা না থাকলে সতর্ক থেকে লাভ নাই। প্যানিক হলেই সব উলটা পালটা শুরু হবে। আমার এমনটাই মনে হয়। সন্ধ্যা হয়ে এলে আমরা মোটামুটি অন্ধকারেই অনেকক্ষণ পর প্রথম কোন দোকান দেখি। এর মাঝে বিকেলের দিকে শুধু দুইজনের সাথে দেখা হয়েছিল। একজন স্কুলে পড়ে। সে বাড়ি থেকে বাজারে যাচ্ছে। খুব চিল মুডে মনে হল। তার মোবাইলে একটা মেটাল গান বাজছিল। সে সানাক্রো পাড়ায় থাকে। এরপর আরেকজনের সাথে দেখ হয়েছিল, উনি বাজার থেকে প্রাংশা পাড়ায় যাচ্ছে যেখানে ওনার বাড়ি। আমরা তখন রাস্তার মাঝে বসে আরাম করছিলাম। আমরা কিছুক্ষণ কথা বলে উনি ওনার পথে এগিয়ে গেলও আমরা বসে রইলাম। পাহাড়িদের সাথে কথা বলাটা সবসময়ই খুব আনন্দের।

তো যা বলছিলাম…

সেই রুমা থেকে আমরা চড়াই বেয়ে উঠছি তো উঠছিই। মং প্রু পাড়ায় ঢোকার সময় জিপিএস ট্র্যাক গুলিয়ে ফেলাতে পৌঁছাতে   সন্ধ্যা ৭.৩০ বেজে গেল, ততক্ষণে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। আমাদের এতক্ষণের হাঁটায় আমরা তেমন বিরক্ত হইনি।  জিপিএসে যখন দেখলাম আমরা মং প্রু পাড়ার কাছাকাছি এসে গিয়েছি, তখন অপূ ভাইয়ের কথা মত মেসা প্রো দিদির দোকান খুঁজে একটু চা খেয়ে জিরিয়ে নিলাম সেখানে। এই দোকানের অভিজ্ঞতাটা খানিক বিব্রতকর ছিল, সারাদিন বিরক্ত হইনি কিন্তু এই দোকানে বসে আমাদের চিলিং মুড উধাও হয়ে গেল।

দোকান থেকে বেরিয়ে পাড়ায় যাবার রাস্তা খুঁজছি, একটা সময় কিভাবে কিভাবে যেন পাড়ায় পৌঁছেও গেলাম। এই প্রথম এমন অবস্থায় বান্দরবানের কোন পাহাড়ি পাড়ায় এসে পৌঁছেছি। কারবারী কাকুর বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছি। এক কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম উনি অস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিলেন, আমি সেই মোতাবেক একটা বাড়িতে গিয়ে ডাকলাম। কিছুক্ষণ পর কারবারী কাকু বের হয়ে আসলেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা কারবারির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পাড়ায় ঢোকার দিকটায় একটা খোলা জায়গায় তাবু টাঙ্গিয়ে থাকব।

আমরা আমাদের নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন পরিকল্পনা কারবারিকে বললাম। কারবারি কাকুর সরলতার কাছে হেরে গিয়ে কাকুর বাসাতেই রাতে আশ্রয় নিতে হল। আমাদেরকে ঝিরির রাস্তা দেখিয়ে দেয়া হয়। ঝিরিটা কারবারি কাকুর বাড়ির পেছনেই ৬০ ফুট মত নিচে। ঝিরির হিম শীতল পানিতে গোসল আমাদের সারাদিনের ক্লান্তু দূর করে দেয়। গোসল সারতে সারতে সারাদিন কি কি ঘটে গেলও তা নিয়ে চুল চেরা বিশ্লেষণে মেতে উঠি। গোসলের ছলে ওখানেই অনেক সময় কাটিয়ে ফিরে গেলাম কাকুর বাসায়। সে রাতে কারবারি কাকুর সাথে বেশ জমে উঠল আড্ডা।

কাকুর সাথে আমাদের আড্ডার ফাঁকেই আমরা নুমথুই, সুহাইসু, আর তুইমেনুর সাথে পরিচিত হলাম। ওরা কাকুর ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। আমরা কিছুক্ষণ গানবাজনা করলাম। গান বাজনার শব্দে পাড়ার আরও কিছু গান পাগল মানুষজনের সাথে পরিচয় হয়ে গেল। আমরা রাতে কাকুর বাসার মাচার উপর আরও অনেকক্ষণ গানবাজনা করে, চাঁদের আলোতে গা ভিজিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পাড়াটা ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। একটা শূকর জবাই করা হল। সকাল সকাল ঘন্টা বেজে উঠতেই ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকে পড়ল। বুঝলাম ঐটাই তাদের স্কুল। আমরা তখন নুমথুই, সুহাইসু, আর তুইমেনুর সাথে খুনসুটি করছি। ওদের ক্লাস বিকালে। ওরা আমাদের ইউকেলেলে, ম্যান্ডোলিন, মন্দিরা গুলা নেড়েচেড়ে দেখে, বাজায়। স্কুল ছুটি হলে আরও অনেক পিচ্চি পাচ্চা এসে জমা হয় কাকুর বাড়িতে। সবাই যন্ত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল আমাদের পিক একটাও হারায় নি। তারা হয়ত ছোটবেলা থেকেই অনেক দ্বায়িত্ববোধ সম্পন্ন। আমরা হলে এতক্ষণে ৩-৪ টা পিক হারিয়ে ফেলতাম। সকালে চিড়া খেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম।

আপাতত আমরা মং প্রু পাড়া থেকে বেরিয়ে আপহিল এর ঠেলা সামলাতে ব্যস্ত, সাথে পেছনে ফেলে আসা উপর থেকে নিচের ছবি দেখার সৌন্দর্য আমাদের বারবার পথের মধ্যে আটকে দিচ্ছিল। আকাশ ছিল চমৎকার। আমরা বেশিরভাগ সময় মেঘে মোড়ানো রাস্তা দিয়েই হেঁটেছি। রোদ না থাকায় কষ্ট ততটা বুঝে উঠতে পারিনি। এভাবে কয়েক দফা আপহিল ডাউনহিল করে আমরা ক্লান্ত হয়ে একটা খাড়া ঢালুর সামনে এসে থামি। সেখানে আমদের দুটো পাহাড়ী কুকুরের সাথে দেখা হয়ে যায়। তাদের ভাব দেখে মনে হল তারা ঠিক আমাদের মেনে নিতে পারলনা তাদের এলাকাতে। তারা আমাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। আমরা তখনও বসে আছি। এর মধ্যে একের পর এক মানুষের দল নিচ থেক উঠে আসতে লাগল। তাদের সাথে আমাদের কথা বার্তা হল। সবাই যাচ্ছে রুমা বাজারে। আমদের দেখে তারা জানতে চাইল আমরা কোথায় যাব। তাদের একেকজনের ঘাড়ে বিশাল বিশাল বস্তা। মানুষগুলো পারেও বটে। কেউ আসছে বলি পাড়া থেকে, কেউ পুকুরপাড়া, কেউ প্রাংশা পাড়া থেকে। ঘাড়ে তাদের জুমে চাষ করা ফসল। বিক্রি হবে। তাদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারলাম এই খাড়াটা নামলেই নিচে ঝিরি। শুনে আফসোস করলাম। নিচে ঝিরি রেখে আমারা এখানে এতক্ষণ বসে রইলাম!!!

পিঠে ব্যাগ তুলে নিয়ে নামতে শুরু করে দিলাম। নামাটা কিছু কিছু জায়গায় বিশ্রী রকম ছিল। নেমেই আমরা ঝিরি পেয়ে গেলাম। গতকাল রুমা থেকে রওনা হওয়ার পর এইটাই চলতি পথে আমাদের প্রথম ঝিরির দেখা। ঝিরির দেখা পেয়ে গেলাম আর তার কোলে কিছুক্ষণ ঘেষাঘেষি করবনা তা তো হয় না। ঝিরিতে আমরা যখন নামি ততক্ষণে রুমায় যাওয়ার লোকদের সবাই উঠে গেছে। ঝিরিটা এখন শান্ত। এখানে শুধু পানির শব্দ। পাখি ডেকে বেড়াচ্ছে পানির শব্দের তালে। আমরা আমাদের শরীর এলিয়ে দিয়েছি ঝিরি, পাথরের কোলে। এখানে আমরা দুটো গান গেয়েছিলাম। এমন পরিবেশে, এমন তালের মাঝে বসে গান গাওয়াটা আমার কাছে সবসময়ই অন্যরকম অনুভূতি দেয়। অনেকে হয়ত বলতে পারেন এরকম পরিবেশে অহেতুক শব্দ না করার কথা। কিন্তু আমার মনে হয় আমার দ্বারা এখানকার কেউই অসুবিধায় পড়বেনা। আমি কখনও তাদের সমস্যার কারণ হব না। আমার মনে হয় পাহাড়ে ভাজে ভাজে বয়ে চলা ঝিরি, ঝিরির সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে থাকা পাথর, পাথরের উপর ঘুরে বেড়ান ছোট বড় পিঁপড়া, পানি, গাছ, পাখি এদের মাঝে মধ্যে এমন গান বাজনা শুনতে খারাপ লাগে না। ওরা হয়ত আনন্দই পাবে।

আমরা যতক্ষণ বসে ছিলাম, গান করছিলাম, ততক্ষণ একটা লোকও এদিক দিয়ে যাতায়াত করল না। যখন গান শেষ হল তখনই কয়েকজন মানুষ যাওয়া আসা শুরু করল। এইটাওই সময়ের জন্য একটা আফসোস ছিল। আমার খুব ইচ্ছা ছিল আমাদে গান বাজনা করতে দেখে তাদের কেমন প্রতিক্রিয়া হয়।

আমরা ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নিয়ে প্রাংশা পাড়ার দিকে চলা শুরু করব এমন সময়েই এখনকার একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। আমরা পলিথিন মুড়িয়ে ব্যাগগুলোকে ভিজে যাওয়া থেকে কোন রকম বাঁচিয়ে কিছুক্ষণ ঝিরি ধরে কিছুক্ষণ ঝিরির পাশের উঁচুনিচু রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে থাকলাম। রাস্তাটা একসময় আমাদের একটা ভ্যালিতে নিয়ে এল। এখানেই পলি প্রাংশা পাড়া। আমরা পাড়ায় ঢুকে একটা দোকানে বসে চা বিস্কুট খেয়ে আবার রওনা দিলাম। সময় অবশ্য কম অপচয় করিনি আমরা।

এই ভ্যালী পেরিয়ে আবার পাহাড়ে চড়া শুরু। এর মধ্যে টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে, থেমে যাচ্ছে, আমরা উঠছি, হাপাচ্ছি, জুড়াচ্ছি। পাহাড়ে ওঠা শুরুর এক পর্যায়ে পাহাড়ের উপর দিয়ে হাঁটছি। এবারের রাস্তা পরিত্যক্ত জুম। পাহাড়ের চুড়ায় যখনই উঠছি তখনই পাহাড়ের সবুজ শরীরের ভাজে মেঘেদের জড়িয়ে যাওয়া দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারিনা। কিসের ভারি ব্যাকপ্যাক, কিসের ক্লান্তি। মেঘ এসে মাঝে মাঝে আমাদের ক্লান্তি ধুয়ে নিয়ে যায়। আমরা হেঁটে যাই পাহাড়ের পিঠের উপর দিয়ে।

জিপিএস দেখে বুঝলাম আমরা ইয়াং রে পাড়ার কাছাকাছি এসে পড়েছি। ইয়াং রে পাড়ার খানিক আগে এসে একটা খোলা মাঠ দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে সাথে থাকা সিদ্ধ ভুট্টা দিয়ে পেটের খানিক পূজা সেরে নিলাম। এর মধ্যে আমরা আলোচনা করছিলাম যে এখানেই আমরা ক্যাম্পিং করব কি না। শেষ পর্যন্ত এখানে আর ক্যাম্পিং করা হয় নি বলে ভালই হয়েছে। এর মধ্যে এক দাদু এসেছে আমরা যেদিক থেকে এসেছি ওদিক থেকে, মানে পলি প্রাংশা পাড়া থেকে। দাদুর সাথে কথা বলে আমরাও জেনে গেলাম ইয়াং রে পাড়া সামনের হালকা উঁচু রাস্তা পেরোলেই। দাদু আমাদেরকে নাকি পলি প্রাংশা পাড়ার চায়ের দোকানে চা খেতে দেখেছে, সেই কথা আমাদের বুঝাল। দাদু থাকেন পলি প্রাংশা পাড়ায়। সারাদিন কাজ করে প্রাংশা পাড়ায় গিয়েছিল একটু শারাব পান করতে। উনি আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে সারাদিন পর একটু শরাব খাওয়া দোষের কিছু না। বরং ভালোই লাগে। আমরাও বুঝে নিয়ে তাকে বিদায় দিলাম। আমরা আরো কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করে পরে এখান থেকে বেরিয়ে একটূ দূর যেতেই ইয়াং রে পাড়ার দেখা পেয়ে গেলাম।

পাড়াটা খুব শান্ত। বৃষ্টি হচ্ছে বলে আরো বেশি চুপচাপ। আমরা প্রথমে ভাবলাম যে এই পাড়াতেই আজকের রাত থাকব। পরে কি থেকে কি হয়ে গেলও আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে জিপিএস এ আঁকা আমাদের ট্রেইল ধরে এগোতে থাকলাম। পাড়াটা পাহাড়ের বেশ উপরে। পাড়া থেকে একটা খালি জায়গায় গেলে ওই পাশের পাহাড়ের রেঞ্জে থাকা তং মক পাড়াটাও দেখা যায় স্পষ্ট। সামনেই বিশাল এক পাহাড়ের রেঞ্জ- লম্বক র। এবার আমাদের নামতে হবে। আমরা জিপিএস দেখে রাস্তা ধরে ধরে নেমে যাচ্ছি। নামতে বেশি সময় লাগে না। তাই একটু পর নামতে নামতে আমরা একটা ঝিরিতে এসে পৌঁছালাম। আর কোন ভাবনা চিন্তা নাই। এখানেই আমাদের ক্যাম্পিং হবে। জায়গাটা অসম্ভব ভাল লাগল। একটা মাঝারি ঝিরি বয়ে যাচ্ছে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে, আর আমরা যেদিক থেকে নেমেছি সে দিন থেকেই আরেকটা ছোট্ট ঝিরি এসে মিলেছে এখানটায়। পাহাড়ের গা ঘেষে ছোট্ট একটা দ্বীপের মত হয়েছে। যেখানটায় ছোট্ট ঝিরির এসে মিলেছে সেখানটায় একটা বাঁশের মাচা করে কিছু ফল রাখা আছে। বুঝলাম পূজার জিনিস। আমরাও ওটার প্রতি সম্মান রেখে ওটার কোন বিনষ্ট সাধন করলাম না। আমরা যখন চলে যাই তখন ওটা তেমনই ছিল আমরা এসে ওটাকে যেমন দেখতে পাই। এখানে আমাদের তাবু ফেলে আমরা রাত্রি যাপন করলাম।

আমরা কিছুটা ভয়ে ছিলাম এই বুঝি রাতে বৃষ্টি আসে। কতবার এরকম মাথায় কল্পনা খেলে গেল যে বৃষ্টি আসল, আমরা ঘুমায়ে আছি, আমরা ভেসে গেছি। যাই হোক বৃষ্টি হয় নি সারা রাত একটুকুও, বরং আমরা সারা রাত চান্দের বাতি জ্বালিয়ে ছিলাম। ঝিরির পানিতে চাদের আলোর প্রতিফলন দেখে মোহনীয় মুগ্ধতায় অনেকটা সময় পার হয়েছে।

একটা ঘটনা ঘটেছে মজার। আমরা রান্না শেষ করে খাওয়া শুরু করেছি। এমন সময় তিনজন কিশোর ছেলে এল। সেটা কোন সমস্যা ছিলনা। তাদের তিনজনের হাতে তিনটা বন্দুক। এটা দেখে আমাদের তিনজনের মনে তিন রকম চিন্তা খেলে গেলও। আসলে সমস্যাটা আমাদের মনের। আমরা আমাদের সমতলের মানুষগুলোকে যেভাবে দেখি ওদেরকেও সেভবেই চিন্তা করে ফেলেছি। বাস্তব আমাদের কল্পনার ধারের কাছে দিয়ে গেলও না। ওরা আমাদের সাথে যখন কথা বলছিল সেখানে আন্তরিকতার কোন কমতি ছিল না। এটা পাহাড়, তারা পাহাড়ি, আমরা সমতলের লোক, তাদের হাতে বন্দুক, তারা তিনজন- এইসব কোন কিছুই তাদের কথা বার্তায় প্রকাশ পেলনা, যেমনটা আমরা সমতলে দেখি। তারা মোটামুটি আক্ষেপ করেই বলল কেন আমরা তাদের পাড়ায় না থেকে এই জংগলে কষ্ট করে থাকছি। আসলে তখন আর কি উত্তর দিব। তাদের ব্যাপারে প্রথমে মনে যেমনটা ভাবনা এসেছিল তার জন্য নিজের মানসিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হল। যাই হোক মানুষগুলো এমন হলে খারাপ হয় না। তারা ছিল শিকারি। তাদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বার্তা হল। তাদেরকে আমরা আমাদের সাথে খাওয়ার জন্য বললাম, কিন্তু তারা আন্তরিকতার সাথে আমাদের প্রত্যাখান করল। তারা যাওয়ার সময় আমাদের আস্বস্ত করল যে এখানে কোন সমস্যা হবেনা। তারা চলে গেল।

পরের দিন আমরা পরিকল্পনা মতই খুব তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি। কিন্তু কিভাবে কিভাবে কিভাবে যেন আমাদের বের হয়ে যেতে যেতে ১০ বেজে যায়। যাই হোক দুই ঘন্টা ক্যাম্প সাইটে ল্যাটানি খেয়ে আমরা ক্যাম্প সাইট গুছিয়ে পরিষ্কার করে হাঁটা শুরু করি। আমরা জানি এ দিন আমাদের প্রায় ১২-১৩ শ ফুট উঠতে হবে। আজ আমদের সামিট ডে। মনে মনে একটু উত্তেজিতই ছিলাম। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়া নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ঘন্টা দেড় মত পাহাড় বেয়ে আমরা গতকাল ইয়াং রে পাড়া থেকে যেই পাড়া দেখেছিলাম সেই পাড়ায় এসে পৌছালাম। এটা তং মক পাড়া। এখানে আমরা এক কাকুর বাসায় ব্যাগ রেখে কাকুর বাসার পাশের পাহাড়ের উপরে উঠে যাওয়ার রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে। উত্তেজনায় আমার ব্যাগ থেকে দা না নিয়েই রওনা হয়ে গেলাম আমরা।

এরপর আমদের শুধুই ওঠা। অবশ্য এখন উঠতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। আমাদের পিঠে কোন ওজন নাই। একটু একটু করে উঠছি আর জিপিএস দেখছি। প্রতি কদম আমাদেরকে পিক সামিটের কাছে একটু একটু করে নিয়ে যেতে লাগল। রাস্তায় আমরা একটা অতীব সুন্দর ঝিরি ফেলে আসি। এই ঝিরির পানিটা একটু বেশিই স্বচ্ছ। যাক ওর পাশে আমরা দাঁড়ালাম না। ফিরে যাওয়ার সময় ওর সাথে দেখা করব আমরা। আমরা উঠতে লাগলাম আবার। জিপিএস এ দেখে বুঝলাম আমরা নাগ পাহাড়ের ঘাড়ের উপর চড়ে বসেছি। যেই রাস্তায় আছি সেটা আমদের কে নিচের নিকে নিয়ে যাবে এবার, বড়থলি পাড়ার দিকে। আমাদের গন্তব্য সেদিকে না। জিপিএস এ আমাদের ট্রেইল দেখাচ্ছে হাতের বাম দিকে। হাতের বাম দিকের রাস্তা দেখে আমার মাথায় নাগ পাহাড় ভেংগে পড়তে চাইল। বাম দিকে কোন রাস্তা নেই। হঠাত করেই সব কিছু বুঝে গেলাম। এবার রাস্তা বানানোর পালা। কিন্তু দা তো রেখে এসেছি পাড়ায়।

কি আর করার। জিপিএস ধরে এগোতে থাকলাম। প্রথম ৪-৫ মিনিট ভাল মতই গেলাম। কিন্তু এর পর আর হাত দিয়ে কাজ হল না। হাত দিয়ে জংগল কেটে রাস্তা বানিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না আর আমাদের পক্ষে এবং আরও ৩০০ ফিট বাকি রেখেই এখান থেকেই নাগ পাহাড় সমান আফসোস নিয়ে নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন নাগ পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দিয়ে ফিরে আসলাম। যেখানটায় বসে রাস্তা খুঁজছিলাম সেখানে বসে কিছুক্ষণ সামনের পাহাড়ের বিশাল রেঞ্জের দিকে অপলক হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মেঘ, নির্মল বাতাস উপভোগ করে ফিরার রাস্তা ধরলাম। আসার সময় আমরা ঐ ফেলে আসা ঝিরিতে অনেকক্ষণ ঝিরিবিলাস করলাম। সেখানে ছোট্ট একটা ঝর্নার মত ছিল। ওখানে গোসল করে ফিরে গিয়ে তং মক পাড়া থেকে ব্যাকপ্যাক নিয়ে ওইদিন ই মং প্রু পাড়াতে ফিরে আসি আমরা। মং প্রু পাড়ায় ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এই ফিরে আসার পথে আমরা খালি হাতে আসিনি। অনেক স্মৃতি, অনেক মানুষের সাথে কথা মগজে ধারণ করে আমাদের ফিরে আসা হয়ত আবার কোন দিন ফেরত যাব এই ভেবেই।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

অভিনব অ্যাডভেঞ্চারঅভিনব অ্যাডভেঞ্চার সন্দর্শনে   
স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া ভ্রমণস্বল্প খরচে মালয়েশিয়া ভ্রমণ
বাউল গান, আড্ডা-শাড্ডা, ঘুরোঘুরি নিয়ে জীবন কাটানো দারুণ প্রাণচঞ্চল আর বোকা মানুষটা হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে অভ্যস্ত রাহাত। দোতারা কিংবা উকুলেলে কাঁধে বন-পাহাড়ের পথে ঘুরে বেড়ানো আর প্রাণ খুলে গাইতে থাকা বোকা মানুষটার স্বপ্ন প্রকৃতির মাঝেই এই একটা জীবন কাটিয়ে যাওয়া.....

Sharing does not make you less important!

অভিনব অ্যাডভেঞ্চারঅভিনব অ্যাডভেঞ্চার সন্দর্শনে   
স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া ভ্রমণস্বল্প খরচে মালয়েশিয়া ভ্রমণ

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

অভিনব অ্যাডভেঞ্চারঅভিনব অ্যাডভেঞ্চার সন্দর্শনে   
স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া ভ্রমণস্বল্প খরচে মালয়েশিয়া ভ্রমণ

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

2 Comments

  1. সাধের চালচিত্র June 14, 2018 at 5:08 pm - Reply

    আরো কিছু আফসোস পরবর্তীতে যোগ হয়েছিল কিন্তু :/

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!