অনিন্দ্যসুন্দরী আমিয়াকুম বাংলাদেশের ঝরণাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই সুন্দরীর দেখা পেতে হলে আপনাকে পথের কস্ট সহ্য করে যেতে হবে বান্দরবানের গহীনে আর এই সুন্দরীর এমনই অমোঘ আকর্ষণ যে প্রতিকুল পথ পেরিয়ে, হাজারো কষ্ট সয়েও মানুষ ছুটে যায় তার পানে।

ঢাকা থেকে রাতের বাসে রওনা হলে আপনি বান্দরবানে পৌঁছবেন সকালে। এর পরে লোকাল বা চান্দের গাড়িতে করে চলে যেতে পারেন থানছি বাজার। থানছি পৌঁছে গাইড সমিতির কাছ থেকে রেজিস্টার্ড একজন গাইড ঠিক করুন। ভ্রমণপ্রিয় খ্যাপাটেদের কাছে জনপ্রিয় এই ঝরণায় পৌঁছানোর দুটো পথ আছে। চাইলে আপনি দুটোই ব্যবহার করতে পারেন। যাওয়ার সময় যে পথে যাবেন ফেরার সময় ফিরবেন আরেক পথ দিয়ে তাহলে দুটো পথই আপনার দেখা হয়ে যাবে।

পথ ১। থানছি বাজার থেকে রিজার্ভ একটা নৌকা নিয়ে চলে যান রেমাক্রি। পথে পড়বে তিন্দুর বড় পাথর এলাকা। নদীর সবুজ জল, বড় বড় পাথর আর পাহাড় ঘেরা অবাক করা সুন্দর তিন্দু এতটাই মোহনীয় যে এখানে কিছু সময় না থাকলে অনেক সৌন্দর্যই না দেখা রয়ে যাবে। এখানে আছে রাজা পাথর। আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন, এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় অবশ্যই রাজা পাথরকে সম্মান জানাতে হয়। নইলে বিপদ ঘটে। নিঃসন্দেহে মোহিত হবেন আপনি তিন্দুর রূপ দেখে। কিন্তু না আমিয়াকুম যদি আপনার শেষ গন্তব্য হয় তাহলে একটি বেলা এখানে হেলায় কাটিয়ে দেবার সময় আপনি পাবেন না তাই নৌকায় যেতে যেতে যতটুকু দেখা যাবে সেইটুকু দেখতে দেখতে চলে যান রেমাক্রি। ঝিরঝির করে বয়ে যাওয়া রেমাক্রি রেপিড দেখে আজকের মত যাত্রা এখানেই শেষ। রেমাক্রী পৌঁছতে পৌঁছতে হয়ত সন্ধ্যা হয়ে যাবে। এখানেও বিজিবি ক্যাম্পে এন্ট্রি করে নিতে হবে নিজেদের যাবতীয় তথ্য। অতঃপর রাতটা বিশ্রাম করুন কারণ কাল কিন্তু অনেক পথ হাঁটতে হবে। 

খুব ভোরে উঠে রেমাক্রি খাল ধরে হাঁটতে থাকুন। তিন ঘন্টারও কম সময়ে থমকে দাঁড়াবেন আরেক সুন্দরীর সামনে। সেই সুন্দরীর নাম নাফাকুম। অনেক অনেক শুনেছেন নিশ্চয়ই নাফাকুমের নাম। পথ যেহেতু একটাই তাই আমিয়াকুমের পরিকল্পনা করার সময় নাফাকুমটাও একই তালিকায় রাখা উচিত। পরদিন খুব ভোরে শুরু করুন নাফাকুমের পথে হাঁটা। রেমাক্রি খাল ধরে, পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে, কখনো কোমর সমান পানি পেরিয়ে আপনাকে যেতে হবে নাফাকুম। পথটা কঠিন তাই মনে সাহস রাখুন। যতটুকু প্রয়োজন সময় নিন। দ্বিধা না করে সাহায্য চান অন্যের কাছে। পথটা খুব দীর্ঘ মনে হলেও এক সময় ঠিক পৌঁছে যাবেন নাফাকুমের সামনে। এটাই কিন্তু শেষ গন্তব্য নয় তাই এখানে সময় কাটানো হয়ে গেলে এবার হাঁটা ধরুন থুইসা পাড়ার পথে। ঠিক ঠাক মত হাঁটলে সন্ধ্যার মাঝেই পৌঁছে যাবেন থুইসা পাড়া। পাড়ায় পানির কল আছে। ঠাণ্ডা পানিতে ফ্রেশ হয়ে আরাম করুন কারণ কাল কিন্তু দেবতা পাহাড় পাড়ি দিতে হবে।

খুব ভোরে না উঠার কোন বিকল্পই নেই থুইসা পাড়া এসে। কারণ আজ আপনি যাবেন অনিন্দ্যসুন্দরী আমিয়াকুম দেখতে। যত ভোরে বের হবেন তত সময় পাবেন এই সুন্দরীর সাথে সময় কাটানোর। আজ পার হতে হবে দেবতা পাহাড়। হয়ত গল্প শুনেই যাবেন যে দেবতা পাহাড় এক আতঙ্কের নাম। অনেক খাঁড়া পাহাড়, সরু ট্রেইল, পড়ে গেলে একেবারে কয়েকশ ফুট গভীর খাদে পড়বেন, বাঁচার আর আশা থাকবে না, এমন আরও অনেক কিছু। এই সব গল্প শুনে পিছু হটলে কিন্তু এতো কাছে এসে এই সুন্দরীর সাথে আপনার আর দেখা হবে না। তাই গল্প থাকুক গল্পের জায়গায় আপনি এগিয়ে যান সাবধানে। আপনি হেঁটে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন এমন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে হাঁটুন, নিজের ওপর জোর দেবেন না, অমুকে অনেক সামনে চলে গেছে আমাকে ফেলে, যাই আমি দৌড়াই, এমন কিছু ভাববেন না। আপনি চলুন আপনার নিজস্ব গতিতে। তারপর দেবতা পাহাড় থেকে নেমে দেখবেন দাঁড়িয়ে আছেন সুন্দরীর একেবারে পায়ের কাছে।

এবার সময় কাটান এই অনিন্দ্য সুন্দরী ঝরনায়। এখান থেকে কিছুদূর এগিয়ে গেলে আছে ভেলাকুম, সাত ভাই কুম। একটা ভেলা নিয়ে সেদিকটাও ঘুরে আসুন সময়ের মধ্যে। কারণ অন্ধকার হবার আগেই কিন্তু থুইসা পাড়া ফিরতে হবে। আর যদি মনে করেন আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেবেন ক্যাম্পিং করে তাহলে তো কথাই নেই। সারাটা সময় ঘুরে ফিরে উপভোগ করুন প্রকৃতি। পর্যাপ্ত খাবার, তাবু এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নিয়ে একটা চাঁদনি রাত কাটাতে পারেন এই অনিন্দ্য সুন্দরী জলপ্রপাতের পাশে, সাথে থাকুক প্রিয় মানুষেরা যাদের নিয়ে এমন একটা রাত হাসি, গান আড্ডায় ভেসে যাওয়া যায়। 

এই রাতটা হয়ত সেরকম ঘুম হবে না, সে আমিয়াকুম দেখে থুইসা পাড়া ফিরে আসার আনন্দে হোক, বা আমিয়াকুমের পাশের সারা রাত গানের আড্ডার জন্যই হোক। কিন্তু আপনাকে ভোরে উঠতেই হবে কারণ আজ আপনার বাড়ি ফেরার পালা। অনেকতো হল প্রকৃতি দেখা এবারতো বাড়ি ফিরে জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। তাই সকাল সকাল রওনা হয়ে যান থানছির পথে। এবার আপনি ফিরতে পারেন সেই পথ দিয়েই যে পথে আপনি এসেছেন। অথবা

পথ ২। পাহাড় ডিঙ্গিয়ে রেমাক্রি খাল ছেড়ে দিয়ে পদ্ম ঝিরি হয়ে পদ্মমুখে পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে নৌকা করে সোজা চলে যাবেন থানছি। এর পরে ঢাকায় ফিরবেন কি করে সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না। 

কিছু টিপস:
১। আপনার বাজেটের সমস্যা না থাকলে ঢাকা থেকে বা ঢাকায় ফেরার সময় এসি বাসে যাতায়াত করতে পারেন এসি বাসে পথের ক্লান্তি অনেক কম হয়।
২। যদি বড় দল হয় তাহলে বান্দরবান থেকে থানছি স্থানীয় বাসে যাতায়াত না করে চান্দের গাড়ি ভাড়া করতে পারেন সেই সাথে বাড়তি হিসেবে নীলগিরি আর চিম্বুক ঘুরতে পারেন। বাসে বান্দরবান থেকে থানছি যাওয়া বা থানছি থেকে বান্দরবান আসা বাস ছাড়ার নির্দিষ্ট সময় আছে। সেটা জেনে পরিকল্পনা করুন।
৩। নিজের এবং দলের নিরাপত্তার জন্য বিজিবি ক্যাম্পে যেয়ে নিজের এবং দলের প্রত্যেকের তথ্য দিয়ে অনুমতি নেবেন। এসময় জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে রাখতে হবে।
৪। কম খরচে আদিবাসীদের ঘরে থাকতে পারবেন।
৫। এই সব অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আছে তাই ভ্রমণের আগের দিন থেকেই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ঔষধ সেবন শুরু করা উচিত। মশার জন্য ওডোমস ক্রিম সাথে নিতে পারেন।
৬। যেহেতু পথের বেশির ভাগই কাটবে নদী বা ঝিরিতে তাই ব্যাগের জিনিস পত্র ভালোভাবে পলিথিনে মুড়ে নিন। মূল্যবান জিনিস রাখুন ড্রাই প্যাকের ভেতরে। 
৭। ভালো গ্রিপের জুতা পরবেন অবশ্যই। 
৮। ব্যাগ যথা সম্ভব হালকা রাখুন। অপ্রয়োজনীয় জিনিস ঠেসে ভরে ওজন বাড়াবেন না কারণ এই ব্যাগ কিন্তু আপনাকেই বহন করতে হবে। 
৯। কিছু সাধারণ ঔষধ, পেইন কিলার আর আপনার প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো সাথে রাখুন।
১০। এই পথে জোঁক ধরবে কাজেই পায়ে মোজা পড়ুন। 
১১। আদিবাসী ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করুন। অনুমতি ছাড়া কারো ছবি তোলা ঠিক নয়। 

টাকার হিসাব: কত লাগতে পারে ঢাকা থেকে আমিয়াকুম যেতে আসতে? আসলে এটা নির্ভর করছে আপনারা কয় জন যাবেন, কিভাবে যাবেন, কিভাবে থাকবেন এই সবের উপরে। তারপরেও মোটামুটি একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করছি কিন্তু মনে রাখবেন এই টাকার অঙ্কগুলো যেকোনো সময় কোন পূর্ব নোটিশ ছাড়াই পরিবর্তিত হতে পারে। 

♣ ঢাকা-বান্দরবান বা বান্দরবান-ঢাকা নন এসি বাসে ৬২০ টাকা এবং এসি বাসে ৯৫০ থেকে ১৫০০ টাকা।
♣ বাসে বান্দরবান থেকে থানছি যাওয়া বা থানছি থেকে বান্দরবান আসা ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। 
♣ চাদের গাড়িতে বান্দরবান থেকে থানছি যাওয়া বা থানছি থেকে বান্দরবান আসা ভাড়া পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। 
♣ গাইড সমিতির ফি ১০০ টাকা এবং গাইডের ফি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা, নির্ভর করছে কয়দিনের জন্য গাইড নিচ্ছেন তার উপর। 
♣ থানছি থেকে রেমাক্রি ইঞ্জিন বোট ভাড়া নেবে ২০০০-২৫০০ টাকা।
♣ আদিবাসীদের ঘরে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় রাতে থাকতে পারবেন।
♣ একবেলা ভাত খাবার খরচ ১০০-১৫০ টাকা। এবার আপনি বুঝে নিন আপনার দলের জন্য কেমন হতে পারে আমিয়াকুম ঘুরতে যাবার খরচ। 

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

স্কুবা ডাইভিংস্কুবা ডাইভিং ও প্যাডি ওপেন ওয়াটার ডাইভারঃ আমার আপন আধার
হাতির মৃত্যুদন্ডহাতির মৃত্যুদন্ড এবং এক জঘন্য ইতিহাস

About the Author: Aoezora Zinnia

সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস এন্ড ফিস ব্রীডিং বিভাগে কর্মরত আওজোরা জিনিয়া ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। একসময় প্রবাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত জিনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছেন অসংখ্য দেশ। পর্বতারোহণ নিয়েও রয়েছে তার দারুণ দারুণ সব স্বপ্ন। আর সেই পথ ধরেই তিনি ছিলেন মাউন্ট বাটুর, মাউন্ট ফুজি, মাউন্ট কানামো সহ বিভিন্ন পর্বতারোহণ অভিযানে। বনের সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়, ঝিরি, ঝর্ণার প্রতি তীব্র ভালোবাসার টানে সুযোগ পেলেই ছুটে বেড়ান থেকে পাহাড়, প্রান্তর থেকে প্রান্তর, বুনোপথ থেকে বুনোপথে।

Sharing does not make you less important!

স্কুবা ডাইভিংস্কুবা ডাইভিং ও প্যাডি ওপেন ওয়াটার ডাইভারঃ আমার আপন আধার
হাতির মৃত্যুদন্ডহাতির মৃত্যুদন্ড এবং এক জঘন্য ইতিহাস

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

স্কুবা ডাইভিংস্কুবা ডাইভিং ও প্যাডি ওপেন ওয়াটার ডাইভারঃ আমার আপন আধার
হাতির মৃত্যুদন্ডহাতির মৃত্যুদন্ড এবং এক জঘন্য ইতিহাস

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

2 Comments

  1. Sarwar Jahan Chowdhury February 14, 2019 at 7:46 am - Reply

    ধন্যবাদ এই চমৎকার পোস্টের জন্য।

    • Kaalpurush Apu February 17, 2019 at 3:50 pm - Reply

      অনেক ধন্যবাদ… :) :)

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!