স্কুবা (SCUBA) শব্দের পুরো অর্থ হল সেলফ কনটেইন্ড আন্ডার ওয়াটার ব্রিদিং আপারেটাস অর্থাৎ এই যন্ত্র ব্যবহার করে পানির নিচে স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া যায়। আমি আমার জীবনে প্রথম যখন স্কুবা ডাইভিং করি আন্দামান দ্বীপে। সেই থেকেই স্কুবা ডাইভিং এর প্রতি আমার প্রেমের শুরু, কুসুম কুসুম ভালোলাগা। তার আগে দূর থেকে লোকজনকে করতে দেখতাম, আসক্তি তেমন হয়নি। কিন্তু আন্দামানের স্কুবা ডাইভিং এর পরে ভালোমতোই “নেশা লাগিইয়া দিল রে”। কাজেই মালয়শিয়া পড়াশোনার জন্য এসে সুযোগ খুঁজছিলাম, কোথায় স্কুবা ডাইভিং করা যাবে? বেশ খোঁজাখুঁজির পরে অবশেষে একটা নাম পেলাম, “পেরিন্থিয়ান আইল্যান্ড “।
সেমিস্টার ব্রেকে পেরিন্থিয়ান আইল্যান্ডে পা দিয়ে আমার মনে হল, এখানে কাজ হলেও হতে পারে। পেরিন্থিয়ান আইল্যান্ডে অনেক স্কুবা ডাইভিং স্কুল আছে। এ যেন নানা নামে কোচিং সেন্টার খুলেছে সবাই। সবারই উদ্দেশ্য একটাই, পয়সার বদলে আপনাকে প্রফেশনাল স্কুবা ডাইভিং লাইসেন্স দেবে। কাজেই ভাল ডাইভ মাস্টার বা স্কুবা ডাইভিং ইন্সট্র্যাক্টরের খোঁজ পাওয়া মুস্কিল। চার দিন ঘুরাঘুরির পরে অবশেষে মন মতো একটা স্কুবা ডাইভিং স্কুলের খোঁজ পেলাম, যেখানে আসলেই ভাল একজন ডাইভ মাস্টার আছে। সেই স্কুলে শুরু হল আমার প্রফেশনাল স্কুবা ডাইভিং শেখা, এই শিক্ষা শেষ হলে আমি হব প্যাডি ওপেন ওয়াটার ডাইভার। বুকে পাথর বেঁধে দক্ষিণ চায়না সাগরের পানিতে নামলাম, প্যাডি ওপেন ওয়াটার ডাইভার হয়ে ছাড়বই।
ওয়ান, টু , থ্রী ……… এরপরে ঝপাশ করে একটা শব্দ। চোখের চারপাশে সদ্য গ্লাসে ঢালা সেভেন আপের বুদবুদের মতো বুদবুদের মেলা। এর মাঝে চিত হয়ে ধীরে ধীরে পানিতে পড়ে গভীরে ডুবে যাচ্ছি আমি। আমার মাথা নিচের দিকে আর পা আকাশের দিকে তোলা, পানিতে পড়ার সাথে সাথে আমার পা নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে আর, মাথা উঠে আসছে পানির উপরে। ডান হাত দিয়ে আমার রেগুলেটর আর ফেস মাস্ক শক্ত করে ধরে রেখেছি, কারণ এগুলা পানির ধাক্কায় সরে গেলে অসুবিধা। বাতাস দিয়ে ফোলান বি সি ডি আমাকে কোন মতেই পানিতে ডুবতে দিবে না জানি, তারপরেও ডাইভিং ইন্সট্র্যাক্টর যখন বলে, আনোয়ার এবার তুমি গো ফর “ব্যাক ফ্লিপ এন্ট্রি টু ওয়াটার “ জিহ্বা কেমন জানি ভারী হয়ে আসে, শরীরের মাংসপেশী টানটান হয়ে যায়।
সবকিছু পরে, রেডি হতেই ওয়ান, টু , থ্রী ………ব্যাস, একটা ব্যাক ফিল্প ডাইভ দিয়ে নেমে গেলে তুমি খোলা সাগরে। ভেসে উঠে সব ঠিক থাকলে মাথার উপরে হাত তুলে ডাইভিং ইন্সট্র্যাক্টরকে “ওকে” সিগনাল দিতে হয়। পানিতে খেয়াল করে চারিদিকে দেখি, কোন জেলি ফিস বা অক্টোপাস দেখা যায় নাকি? ওইগুলা থাকলে খবর আছে। ট্রেনিং এর সময়ে অনেক বন্ধুদের জেলিফিসের কামড় খেয়ে কাঁদতে দেখেছি। তারপরে সবার সবকিছু ফাইনাল চেক করে আমাদের ডাইভ শুরু হয়ে যায়। ধীরে ধীরে আমরা ডিফ্লেটর চেপে বি সি ডি র বাতাস বের করে দিতে থাকি, আর নীল সাগর আমাদেরকে তার বুকে জায়গা দেয়। আমাদের সামনে থাকে একটা ডাইভ লাইন, সেটা অনুসরণ করে আমরা আস্তে আস্তে নিচের খোলা নীল সাগরে ডুবতে থাকি।
গভীরে ডোবার ফাঁকে ফাঁকে কানের উপরে পানির যে চাপ পড়ে, সেটা কিছু পরে পরে বন্ধ নাক চেপে অ্যাডজাস্ট করতে থাকি, নতুবা কানের পর্দা ফেটে যাবে, ফলশ্রুতিতে একদম বধির হয়ে যাব। এভাবে কানের পর্দা বাঁচিয়ে আমরা এক সময় সাগরের তলায় পৌঁছাই। তারপরে ডাইভিং ইন্সট্র্যাক্টরের সিগনাল অনুসারে আমরা এক দিকে সাঁতার কাটা শুরু করি। অল্প গভীর ডাইভগুলো তিন মিটার হতে দশ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্যাডি ওপেন ওয়াটার ডাইভার (ব্যাসিক) কোর্সে পাশ করার জন্য কম পক্ষে ১৮ মিটার বা ৫৪ ফুট গভীর পানিতে ডাইভ দিতে হবে, আর প্যাডি অ্যাডভান্স ওপেন ওয়াটার ডাইভার কোর্সে পাশ করার জন্য কম পক্ষে ৩০ মিটার বা ১০০ ফুট গভীর পানিতে ডাইভ দিতে হবে, যা ডিপ ডাইভ নামেও পরিচিত।
এই সময়ে ডাইভিং ইন্সট্র্যাক্টরের কাছে আমাদের পানির নিচে বিভিন্ন কসরতের ধারাবাহিক পরীক্ষা দিতে হয় যেমন, কি ভাবে স্কুবা সেট এয়ার ট্যাঙ্কে ফিট করতে হয়, পানির নিচের বিভিন্ন সিগনাল বা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ, পানির নিচে মাস্কে পানি ঢুকে গেলে কি ভাবে মাস্ক থেকে তা বের করবে, বাতাস শেষ হয়ে গেলে বাডির সহায়তায় কিভাবে পানির উপরে উঠে আসবে, পানির নিচে শ্বাস নেবার রেগুলেটর কিভাবে বদল করবে বা খুঁজে পাবে বা পুরা স্কুবা সেট খুলে সাগরের তলদেশে রেখে আবার পরবে, ডাইভ চাটের ব্যবহার ইত্যাদি। পর পর দুইবার কোন টাস্ক না পারলে সেই টাস্কে ফেল হিসাবে ধরা হয়। আমি প্রথমে প্যাডি ওপেন ওয়াটার ডাইভার (বেসিক) কোর্স করি, এই কোর্সে পাস করার পরবর্তীতে প্যাডি অ্যাডভান্স ওপেন ওয়াটার ডাইভার কোর্সে ভর্তি হবার অনুমতি পাই ও সেই কোর্স এই বছরে সফলতার সাথে শেষ করেছি।
এতদিন পানিতে লাফঝাপ করতাম লাইসেন্স ছাড়া, কিন্তু এখন আমার প্যাডি অ্যাডভান্স ওপেন ওয়াটার ডাইভার কার্ড আছে। এছাড়াও কিনে নিয়েছি আন্ডার ওয়াটার ক্যামেরা। এখন নতুন ওঠা দাঁতের পরীক্ষার অপেক্ষায় আছি । রুখবে আমায় কে?
স্কুবা ডাইভিং করলে কি লাভ ? :
স্কুবা ডাইভিং করলে কমপক্ষে ১০ টা শারীরিক উপকার হয়ে থাকে বলে বিজ্ঞানীরা দাবি করে থাকেন, যা নিম্নরূপ
১। শরীরের শক্তি ও নমনীয়তা বাড়বে: ডাইভিং করলে যেহেতু পানির নিচে সাঁতার কাটতে হয়, ফলে মাংসপেশি ডাঙ্গার চাইতে বেশি কাজ করে কারণ পানির নিচে স্রোতে শরীর বাঁধা পায়। যত সাঁতার কাটবে, শরীর ততই শক্ত ও দৃঢ় হবে, মাংস পেশীর নমনীয়তাও আগের থেকে বাড়বে এবং পুরা শরীরের শক্তি আগের থেকে বাড়বে।
২। দম বাড়বে: স্কুবা ডাইভিং করলে যেহেতু পানির নিচে ধীরে ধীরে গভীর নিঃশ্বাস নিতে হয়, যাতে দম থাকে ও কম বাতাস ব্যবহার হয় ফলে স্কুবা ডাইভিং করলে কম বাতাস টানার কারনে ডাইভারদের হার্ট রেট কমে আসে, শরীর ধীরে ধীরে পূর্বের চেয়ে শান্ত হয়। স্কুবা ডাইভিং করার সময়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিলে, ফুসফুসে কোন আঘাত লাগে না এবং এজমার উপকার হয় কারণ এতে স্বাভাবিকের চেয়ে দম বাড়ে।
৩। রক্ত চাপ কমাতে সাহায্য করে: স্কুবাডাইভিং করলে শুরুতে উত্তেজনার কারণে রক্ত চাপ বাড়লেও, ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এবং পানির গভীরে গেলে ঠাণ্ডার কারণে রক্ত চাপ কমে আসে। এছাড়া স্কুবা ডাইভিং করলে যেহেতু এক সময়ে ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিতে ডাইভাররা অভ্যস্ত হয়ে যায় ফলে পরবর্তীতে শরীরের রক্ত চাপ কমে আসে।
৪। ফিটনেস বাড়বে: স্কুবা ডাইভিং করলে ডাইভারদের ফিটনেস বাড়তে থাকে। কারণ পানির নিচে স্রোতে ডাইভিং করার সময় শরীর পানিতে বাঁধা পায়। ফলে যত গভীর পানিতে সাঁতার কাটবে, শরীর ততই শক্ত ও দৃঢ় হবে ফলে মাংস পেশীর নমনীয়তাও আগের থেকে বাড়বে ফলে পুরা শরীরের ফিটনেস আগের থেকে বাড়বে।
৫। উষ্ণ আবহাওয়ায় ভ্রমণের ইচ্ছা বাড়বে: ঠাণ্ডা পানিতে স্কুবা ডাইভিং করা যায়। তবে শুরুতে গরম পানিতে ডাইভিং করা ভাল। ফলে উষ্ণ আবহাওয়ায়, বা উষ্ণ এলাকায় ডাইভারদের ভ্রমণের ইচ্ছা বাড়বে।
৬। পানির রোগ নিরাময় ক্ষমতা: পানির বেশ কিছু রোগ নিরাময় ক্ষমতা আছে। এটি আপনাকে মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় যে অনুভূতি হয় সেটি ফিরিয়ে দিতে পারে। ফলে মানসিক উৎকর্ষতা বাড়ে। তাছাড়া অনেকক্ষণ লবণ পানিতে সাঁতার কাটলে শরীর ডি-হাইড্রেড হয়ে যায়। ফলে পানির পিপাসা বাড়ে ও বেশি পানি খাওয়া হয়।
৭। জলজ প্রাণীদের সাথে মিথস্ক্রিয়া হয়: স্কুবা ডাইভিং করলে ডাইভারদের সাথে বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণীদের সাথে, দেখা হয়, নানা রকম প্রতিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া হয়। বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণীদের সাথে দেখা ও নানা রকম অভিজ্ঞতা হয় যা আগে কখনো হয়নি।
৮। সূর্যালোকে থাকা হবে: স্কুবা ডাইভিং করলে ডাইভারদের দীর্ঘ সময় সূর্যের নিচে সাঁতার কাটতে হয় বা থাকতে হয়। ফলে শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভিটামিন ডি পায়, যা কিনা কোষের ক্যালসিয়াম শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে সূর্যালোকে বেশি সময় থাকায় শরীরের হাড় শক্ত হয় এবং মস্তিস্কে “এন্ডরফিন” নামের রাসায়নিক যৌগ উৎপন্ন হয়।
৯। সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে: স্কুবা ডাইভিং করলে ডাইভারদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, কারণ একা একা স্কুবা ডাইভিং করা যায় না, একজন সঙ্গী দরকার হয়।
১০। মানসিক চাপ কমায়: স্কুবা ডাইভিং করলে ডাইভারদের মধ্যে মানসিক উৎকণ্ঠা বা চাপ কমে আসে, মন স্থির করা যায়। স্কুবা ডাইভিং করলে যেহেতু ডাইভারদের এক সময়ে ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিতে হয়, ফলে ডাইভাররা তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলে স্কুবা ডাইভিং করলে পরবর্তীতে শরীরের রক্ত চাপ কমে আসে ও মানসিক চাপও কমায় । এছাড়াও নানান ধরণের মাছ বা কোরাল দেখে মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে।
পাদটীকা:
আমি যখন ট্রেকিং শুরু করলাম তখন লোকজন বলাবলি করতো, ভাই নাকি জংগলে ঘুরাঘুরি করেন? ঘটনা কি সত্য? ব্যাপারটা কি? তারপরে যখন পাহাড়ে যাওয়া শুরু করলাম, সবাই বলতো, ভাই পাহাড়ে কি আছে যে এতবার যান? কোন গুপ্তধন পাইছেন নাকি? এখন যখন স্কুবা ডাইভিং শুরু করলাম, সবাই বলতেছে, ডাঙ্গায় কোন চাকুরী না পাইয়া মনে হয় এখন সাগরে নামছে, তিমি মাছরে গোসল করাইবো। এই জাতীয় লোকজনদের জন্য এক বালতি সমবেদনা ও পালটা প্রশ্ন, “বাঁচুম কয়দিন ভাই? আসলে আমার যা যা এই এক জীবনে করার ইচ্ছা সব এক কইরা একটা “থিংগস টু -ডু” তালিকা করছি, মরার আগে আমি আমার তালিকাটা পুরো শেষ করতে চাই।
লিখেছেনঃ আনোয়ার হোসেন চৌধুরী। প্রফেশনাল মাউন্টেনিয়ার, স্কুবা ডাইভার। ভালোবাসেন স্ট্রিট ফুড খেতে আর ছবি তুলতে।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
