দামতুয়া আর তার আশেপাশের প্রায় সব ক্যাসকেইড, ঝিরি কিংবা ঝর্ণাগুলো বলা যায় বাড়ির কাছেই। পান বাজারে দাঁড়ালেই স্থানীয় বাইক চালকরা নির্ধারিত চুক্তিতে থানছি-আলিকদম রোডের  ১৭  কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছে দেবে যেখান থেকে ধেই-ধেই করতে করতে আপনার পথচলা শুরু হবে। মাত্র ৪ ঘন্টায় ঘুরে আসা যায় এমন একটা ট্রেইলে কিছু ছবি পাওয়ার আশায় নামতেই বৃষ্টির যেন আর তর সইলোনা!! আকাশ ফুটো হয়ে যাওয়া বৃষ্টি-তে , মাত্র এক মিনিটের মাঝে দারুণ একটা শাওয়ার নিতে নিতেই পথ চলেছি। সাথে নিয়ে আসা ডে-প্যাকে ক্যামেরা, লেন্স, পাওয়ার ব্যাংক ইত্যাদি বেশ নিরাপদ আর শুকনো অবস্থায় আছে। সারাক্ষণ ভাবছি বৃষ্টিটা এই বুঝি থামলো!! বৃষ্টি না থামলে ঝিরির পানি বেড়ে যাবে এবং এইমুহুর্তে এমন কিছু আমি কল্পনাও করতে চাইছিনা। কিন্তু বিধি বাম! আমাদের এসব ভাবনায় বৃষ্টির কিই বা আসে যায়!

ঝিরিতে পৌঁছে অবাক হবার প্রশ্নই আসেনা। দুকুল চাপিয়ে প্রমত্তা ঝিরি বইতে থাকবে আর আমরা পাড়ে দাঁড়িয়ে খিস্তি আওড়াবো!!  এমনই তো হবার কথা! রাগে দুঃখে নিজেকে একটা ভেজা পাহাড়ি শুয়োর মনে হলেও মাথার ভিতর ভাবনার গিজগিজ। সাথে দড়ি নেই আর দড়ি ছাড়া এই ঝিরি পার হবার চিন্তাই করা উচিত নয়। এখন কি করা যায়? কি করা উচিত? এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই মেন ক্রুং (মুরং ছেলে) এর সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত হলো, আপাতত পানি কমার অপেক্ষা করি। পানি কমুক আর আমরা এই ফাঁকে কাছাকাছি আরেকটা ঝর্ণায় যাওয়ার চেষ্টা করি। কিছুটা জঙ্গলাকীর্ণ পথ হলেও তেমন অসুবিধা হবার কথা নয়। তাছাড়া সাথে থাকা শখের দাড়ালো দা-টা তো জংলা কেটে পথ তৈরি করার অপেক্ষায় চকচক করছে। অতএব, সমস্যা কই।

আমাদের কাঙ্খিত ঝর্ণার পথটা আমাদের ফিরে যাওয়ার পথেই তাই নতুন উদ্যমে ফিরে যাওয়া শুরু করলাম। এর মাঝে বৃষ্টিও একটু কমেছে। আগের মত আর চোখ-মুখ ফুটো করে দিচ্ছে না এই আশ্বিন মাসের বৃষ্টিটা। চেনা পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। মেম্বার পাড়া অতিক্রম আরো কিছুদূর যাওয়ার পর মেন ক্রুং ডানপাশের একটা পথের চিহ্ন দেখিয়ে বলল দাদা এটাই পথ, এই পথ ধরে ঝিরিতে নেমে ঝর্ণার পথ ধরবো। আমরাও তথাস্তু বলেই প্রস্তুত।

সব কিছুই ঠিকঠাক, সাথে থাকা গো-প্রো টা একহাতে ধরে, কোন একসময় ব্যবহার হতো কি হতোনা এমন একটা থিকথিকে কাদায় মাখা পথ বেয়ে নেমে চলেছি। আমার ঠিক সামনেই মেন ক্রুং ঝোপ-জঙ্গল কেটে পথ পরিস্কার করে এগোচ্ছে। কাদা, পিচ্ছিল পথ আর বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে এবার শুরু জোঁকের অত্যাচার। কিছুক্ষণ পরপরই গা থেকে জোঁক ছাড়ানোটা একসময় বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেলেও জোঁকের উপদ্রব বরাবরের মতই সীমাহীন। যদিও এই মুহুর্তে সামনে অপেক্ষমান ঝর্ণাটার আশায় এই সব যন্ত্রনা মেনে নেয়া ছাড়া মাথায় আর কোন ভাবনা আসবেনা তা পাহাড়ে-জঙ্গল ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর অজানা নয়। যাই হোক, পথটা ইতিমধ্যে কিছুটা সমান হয়ে এসেছে। একদম শেষের বেশ জংলা একটা জায়গা পার হয়েই সোজা ঝিরিতে এসে দাঁড়ালাম। পাহাড়ি ঢলের কাদামাখা পানিতে কুল উপচানো ঝিরিটা দেখে গ্রামের বাড়ির অজিত মামার চায়ের দোকানের হাঁড়ির কথা মনে পড়ছিল বারবার। এটা আমার সবসময় হয়। ঝিরির পানি ঘোলা দেখলেই মাথার ভিতর অজিত মামার চায়ের হাঁড়ি ঘুরতে থাকে। যাইহোক, এই মুহুর্তে চায়ের ভাবনার চেয়ে জরুরী ভাবনা সামনের ঝর্ণাটা।

ফুঁসতে থাকা পাহাড়ি ঢলের পানিতে পড়ে যাওয়া বাঁচিয়ে, পিচ্ছিল সব পাথর ডিঙ্গিয়ে খুব সাবধানে পথ চলছি সবাই। ঝিরির কিছু জায়গায় ঝর্ণার নিচের দিকে থাকা ক্যাসকেইডের কারণে বেশ শিকড় বাকড় ধরে বড় বড় সব বোল্ডারে উঠতে হচ্ছে। বারবার ভাবছি, এত কষ্টের শেষে প্রাপ্তিটা যে কেমন হবে কে জানে!! এসব ভাবতে ভাবতে একটা বেশ বড়সড় পাথরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। উপর থেকে মেন ক্রুং স্রোতের গর্জন চাপিয়ে চিৎকার করে লতা-শিকড় যা হাতে পাওয়া যায় তা ধরে উঠার বুদ্ধি দিচ্ছে। সাথে দড়ি না থাকায় নিজেকে খুব আহাম্মক মনে হচ্ছিলো। কিন্তু ভেবে আর কি হবে! তাছাড়া আমরা কেউ তো আর এমন কিছুর পরিকল্পনা নিয়ে এদিকটায় আসিনি। যাই হোক উঠতে তো হবেই। মোটা মোটা লতা আর শিকড় ধরে ধরে একসময় উপরে উঠে এলাম সবাই। দেখতে যতটা ভয়ংকর মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা ততটা ভয়ংকর না হলেও দড়ি নিয়ে আসার কথাটা মাথা থেকে একদম উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

বোল্ডারটার মাথায় উঠে আসতেই মনটা একেবারে ঝকমক করে উঠলো। সবারই দাঁত বেরিয়ে এসেছে খুশিতে। চোখের সামনের বিশাল পাথুরে দেয়ালটায় বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে তুমুল গর্জন তুলে নেমে আসা ঝর্ণাটা যে এত সুন্দর হবে ভাবিনি। কোন ক্লান্তি, শ্রান্তি কিংবা শেষ নেই যেন এই প্রপাত পতনের। ঝর্ণার একটানা শব্দ আর বাতাসের তোড় গায়ে মেখে পরম মুগ্ধতায় এই দারুণ সুন্দরের দিকে তাকিয়ে আছি সবাই। এর মাঝে ‍আমাদের আনন্দটা আরো বাড়িয়ে দিতেই যেন বৃষ্টিটা থেমে গেল হুট করে। তড়িঘড়ি ব্যাগের ভেতরে রাখা ক্যামেরাগুলো বের করে ঝাপিয়ে পড়লাম এই অসাধারণ সময়টা ফ্রেমে ধরে রাখার চেষ্টায়। ছবি আর ভিডিওগ্রাফির এক ফাঁকে আবারো আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। কোন রকম ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছি এমন সময় মেন ক্রুং জানালো ঝিরি ধরে না যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমরা যদি ঝর্ণার বিপরীত দিকের রীজ-টা ধরে উঠে যেতে পারি তাহলে খুব ভাল হয়। নতুন করে ভাবনা চিন্তার সময় নেই এখন যে কোন সময় ঝর্ণার পানি অনেক বেড়ে যেতে পারে তাই মেন ক্রুং এর কথাটাই মেনে নিলাম।

বিশ্রী রকমের একটা খাড়াই ধরে উঠা শুরু করলাম। স্বাভাবিক অবস্থায় হয়ত চিন্তাও করতাম না এই রকম খাড়া একটা জায়গায় ঝোপ জঙ্গল বেয়ে ওঠার। কিন্তু আমাদের দ্বিতীয় বার চিন্তার কোন অবকাশ ছিলনা প্রাকৃতিক বৈরিতার কারণে। অঝোরে নেমে আসা বৃষ্টির পানিতে ভয়ানক কাদা আর পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া পথটার প্রতি পদক্ষেপেই জঙ্গল পরিস্কার করতে হচ্ছে। হাত, পা দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে, বাঁশ, শন আর কাঁটার খোঁচা সহ্য করে, জোঁক আর মশার অত্যাচার মাথায় করে উঠছি তো উঠছিই। এর যেন শেষ নেই কোন। কোথাও একটুখানি সমতল নেই যেখানে পা দুটোকে একটু আরাম করে দাঁড় করাবো। ভয় ধরে যাওয়া খাঁড়া একটা জায়গায় গাছের ডাল ধরে কোনোমতে ঝুলে আছি, সেই ডালেও জায়গায় জায়গায় কাঁটা, পিছনে আর পায়ের নিচে আক্ষরিক অর্থে কিছুই নেই। এখান থেকে পড়লে কত ফিট নিচে গিয়ে পড়ব জানা নেই।

সব কষ্টের একটা শেষ আছে সেটা নিশ্চিত করার জন্যই হয়ত প্রচন্ড অমানুষিক পরিশ্রমের পর একসময় আমরা জুমের এক কলা বাগানে এসে পৌঁছুলাম।  বাগানটাকে পাশ কাটিয়ে নতুন উদ্দোমে আরো খানিক উঠতেই দেখলাম সকালের হেঁটে যাওয়া পথের এক জায়গায় এসে দড়িয়েছি আমরা।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম আর সাথে থাকা বিস্কুট, খেজুর আর বাদামগুলোর সদ্ব্যবহার করে আবারো পথ চলা শুরু। এবারের গন্তব্য ফেলে আসা দামতুয়া…

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

সাইরু হিল রিসোর্টসাইরু হিল রিসোর্ট
মাউন্ট বাটুরের পথে ভিডিওগ্রাফীসবুজের ছায়ায় স্বপ্নের বসবাস

About the Author: Kaalpurush Apu

তথ্যপ্রযুক্তির কর্পোরেট মোড়কটা একপাশে ছুড়ে ফেলে ভবঘুরে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত কালপুরুষ অপূ ভালোবাসেন প্রকৃতি আর তার মাঝে লুকিয়ে থাকা হাজারো রূপ রহস্য। নীলচে সবুজ বন, ছলছল বইতে থাকা নদী, দাম্ভিক পাহাড়, তুষার ঢাকা শিখর, রুক্ষ পাথুরে দেয়াল ছুঁয়ে অবিরত পথ খুঁজে ফেরা কালপুরুষ অপূ স্বপ্ন দেখেন এমন এক পৃথিবীর, যেখানে পাখিরা দিশা হারায় না, যেখানে সারাটা সময় সবুজের ভীরে লুটোপুটিতে ব্যস্ত সোনালী রোদ্দুর, যেখানে জোনাকির আলোয় আলোকিত হয় আদিম অন্ধকার, যেখানে মানুষরূপী পিশাচের নগ্নতার শিকার হয়না অবাক নীল এই পৃথিবীর কোন কিছুই!

Sharing does not make you less important!

সাইরু হিল রিসোর্টসাইরু হিল রিসোর্ট
মাউন্ট বাটুরের পথে ভিডিওগ্রাফীসবুজের ছায়ায় স্বপ্নের বসবাস

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

সাইরু হিল রিসোর্টসাইরু হিল রিসোর্ট
মাউন্ট বাটুরের পথে ভিডিওগ্রাফীসবুজের ছায়ায় স্বপ্নের বসবাস

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!