নাফাকুম, পার্বত্য জেলা বান্দরবানের গহীনে এক অনিন্দ্য সুন্দর ঝর্ণার নাম। এই ঝর্ণা, বা ঝর্ণায় পৌঁছাবার পথটুকু এত সুন্দর যে আপনি বিশ্বাসই করতে চাইবেন না যে এত সুন্দর কোন জায়গা আমাদের এই বাংলাদেশে আছে। কিন্তু এই ঝর্ণা সহজগম্য নয়। এটি বান্দরবান জেলার থানছি উপজেলার রেমাক্রিতে অবস্থিত। রেমাক্রি থেকেও প্রায় ৩ ঘণ্টার পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা, ঝিরি পথ ধরে যেতে হবে আপনাকে। এইটুকু পড়েই দমে গেলেন তো? ভাবছেন আপনার পক্ষে এত কষ্ট করে কোনোভাবেই সম্ভব না নাফাকুম পর্যন্ত যাওয়া? আপনি হয়তো ভাবছেন, এত মোটা শরীর নিয়ে কিভাবে হাঁটব পাহাড়ি রাস্তায়, হয়তো ভাবছেন এত বয়সে এই শরীরে এত অ্যাডভেঞ্চার পোষাবে কিনা!!! আপনি হয়তো নিজেকে আনফিট ভাবছেন নাফাকুম যাওয়ার জন্য!!! আপনার জন্যে এমন একটি নাফাকুম ট্রিপ প্ল্যান প্রয়োজন যাতে আপনি একটু আত্মবিশ্বাসী হলেই যেতে পারবেন নাফাকুম। আপনার পরিকল্পনাটাকে গুছিয়ে দিতেই এই আর্টিক্যাল, নাফাকুম যাত্রার টুকিটাকি ।
প্রথম দিনঃ সকালে বাসে করে রওনা হয়ে যান বান্দরবান। সন্ধ্যায় পৌঁছে বান্দরবান শহরটা একটু ঘুরে আরাম করুন হোটেলে।
দ্বিতীয় দিনঃ সকালে একটা ভাড়া করা জীপে চলে যান থানছি। সেখানে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নৌকা করে রেমাক্রি রওনা হবেন। পথে উপভোগ করতে পারবেন সাঙ্গু নদীর সৌন্দর্য, রাজা পাথর এলাকা। কিছুটা সময় কাটান তিন্দুতে। এখানকার ছোট বড় পাথর, নদীর সবুজ পানি আর চারপাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য বিমোহিত করবে আপনার মন। রেমাক্রির ছোট ক্যাসকেডটা চোখে পড়লেই বুঝে যাবেন পৌঁছে গেছেন রেমাক্রি। বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাবেন রেমাক্রি। অনেক রেস্ট নিন রেমাক্রিতে কারণ পরদিনই কিন্তু আসল অ্যাডভেঞ্চারের দিন।
তৃতীয় দিনঃ বেশ সকালেই রওনা হয়ে যান নাফাকুমের পথে। সাধারণত আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাগে রেমাক্রি বাজার থেকে নাফাকুম পৌঁছাতে। আপনি না হয় সময় একটু বেশিই নিন। ধীরে সুস্থে, যেভাবে আপনি আরাম বোধ করবেন সেভাবেই এগিয়ে যেতে থাকেন। ক্লান্ত লাগলে কোথাও বসুন ৫ টা মিনিট। প্রকৃতির অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করুন, ছবি তুলুন। সাথে কিছু হালকা খাবার, পানি নিবেন। যখন মনে করবেন কষ্ট হচ্ছে তখন একটা খেজুর, বা একটা ক্যান্ডি বা মাংগো বার কিছু একটা খেয়ে নিন। সাথে স্যালাইন রাখতে পারেন। কিছুক্ষণ পর পর অল্প করে স্যালাইন খাবেন যা আপনাকে অনেক সতেজ রাখবে।এভাবেই এক সময় পৌঁছে যাবেন নাফাকুম। প্রাণ ভরে উপভোগ করুন নাফাকুমের সৌন্দর্য। নিজেকে বিলিন করে দিন ঝর্ণায় অবগাহন করে।আপনি যদি দুপুর ১২ টার মধ্যে নাফাকুমে পৌঁছাতে পারেন তাহলে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় পাবেন সেখানে কাটানোর জন্য। যথেষ্ট রেস্ট নিন, ঝর্ণার স্বচ্ছ সবুজ জলে সাঁতার কাটুন ইচ্ছেমতন। যা আপনার ভ্রমণের আনন্দকে বাড়িয়ে দেবে বহুগুন! কিছু একটা খান, দেখবেন পথের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। ফিরতি পথেও একই ভাবে ফিরুন আপনার নিজস্ব গতিতে। কে কত সামনে এগিয়ে আছে তা আপনার দেখার বিষয় না, আপনি আপনার মত করে এগিয়ে যান। পথের দিকে খেয়াল রাখুন। পথ ডিঙোতে অসুবিধা হলে অন্য কারো সাহায্য নিন। আশা করা যায় সন্ধ্যা নামার আগেই আপনি পৌঁছে যাবেন রেমাক্রি বাজার।
চতুর্থ দিনঃ সকালে রেমাক্রি থেকে নৌকা করে রওনা হন থানছি বাজারের উদ্দেশ্যে। থানছি থেকে জীপে করে বিকেলের মধ্যে চলে যান বান্দরবান। রাতের বাসে ফিরে যান ঢাকায়। বিশ্রাম করতে চাইলে রাতটা বান্দরবান শহরে কাটিয়ে পরদিন সকালে ঢাকার বাস ধরুন।
গুগল ম্যাপে থানছি।
নাফাকুম যেতে হলে থানছি থেকে গাইড নিতে হবে। আপনার ভ্রমণকে সহজ এবং উপভোগ্য করার জন্য গাইড সবরকমের সহযোগিতা করবে। সাঁতার না জানলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সাথে রাখুন। আর এই ট্রিপে সবচেয়ে জরুরি যে জিনিসটা তা হলো পাহাড়ি পথে চলার জন্য এক জোড়া ভালো গ্রিপওয়ালা জুতা।
যারা নাফাকুম যাবার সাহস করে উঠতে পারেন না, যারা অতটা হাঁটতে পারেন না বা একটিভ না তাদের জন্য এই প্ল্যানটা। অনেক সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে যেতে থাকেন দেখবেন এক সময় পৌঁছে গেছেন নাফাকুমের সামনে। আমরা সবাই চাই প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে, পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে ভ্রমণে যেতে যাতে আনন্দটা সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া যায়। পরিবারের সবাই হয়তো সব রকম অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরের জন্য নিজেদের উপযোগী মনে করেন না। আপনার বাবা-মা কে সাথে নিয়ে বা অন্তত আপনার মোটকু ভাইটিকে নিয়ে নাফাকুম উপভোগ করতে চাইলে এই নাফাকুম যাত্রার টুকিটাকি নিঃসন্দেহে আপনার ভ্রমণের একটা দারুণ সহায়ক হতে পারে।
কিছু টিপস:
১। আপনার বাজেটের সমস্যা না থাকলে ঢাকা থেকে বা ঢাকায় ফেরার সময় এসি বাসে যাতায়াত করতে পারেন এসি বাসে পথের ক্লান্তি অনেক কম হয়।
২। যদি বড় দল হয় তাহলে বান্দরবান থেকে থানছি স্থানীয় বাসে যাতায়াত না করে চান্দের গাড়ি ভাড়া করতে পারেন সেই সাথে বাড়তি হিসেবে নীলগিরি আর চিম্বুক ঘুরতে পারেন। বাসে বান্দরবান থেকে থানছি যাওয়া বা থানছি থেকে বান্দরবান আসা বাস ছাড়ার নির্দিষ্ট সময় আছে। সেটা জেনে পরিকল্পনা করুন।
৩। নিজের এবং দলের নিরাপত্তার জন্য বিজিবি ক্যাম্পে যেয়ে নিজের এবং দলের প্রত্যেকের তথ্য দিয়ে অনুমতি নেবেন। এসময় জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে রাখতে হবে।
৪। কম খরচে আদিবাসীদের ঘরে থাকতে পারবেন।
৫। এই সব অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আছে তাই ভ্রমণের আগের দিন থেকেই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ঔষধ সেবন শুরু করা উচিত। মশার জন্য ওডোমস ক্রিম সাথে নিতে পারেন।
৬। যেহেতু পথের বেশির ভাগই কাটবে নদী বা ঝিরিতে তাই ব্যাগের জিনিস পত্র ভালোভাবে পলিথিনে মুড়ে নিন। মূল্যবান জিনিস রাখুন ড্রাই প্যাকের ভেতরে।
৭। ভালো গ্রিপের জুতা পরবেন অবশ্যই।
৮। ব্যাগ যথা সম্ভব হালকা রাখুন। অপ্রয়োজনীয় জিনিস ঠেসে ভরে ওজন বাড়াবেন না কারণ এই ব্যাগ কিন্তু আপনাকেই বহন করতে হবে।
৯। কিছু সাধারণ ঔষধ, পেইন কিলার আর আপনার প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো সাথে রাখুন।
১০। এই পথে জোঁক ধরবে কাজেই পায়ে মোজা পড়ুন।
১১। আদিবাসী ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করুন। অনুমতি ছাড়া কারো ছবি তোলা ঠিক নয়।
টাকার হিসাব: কত লাগতে পারে ঢাকা থেকে নাফাকুম যেতে আসতে? আসলে এটা নির্ভর করছে আপনারা কয় জন যাবেন, কিভাবে যাবেন, কিভাবে থাকবেন এই সবের উপরে। তারপরেও মোটামুটি একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করছি কিন্তু মনে রাখবেন এই টাকার অঙ্কগুলো যেকোনো সময় কোন পূর্ব নোটিশ ছাড়াই পরিবর্তিত হতে পারে।
♣ ঢাকা-বান্দরবান বা বান্দরবান-ঢাকা নন এসি বাসে ৬২০ টাকা এবং এসি বাসে ৯৫০ থেকে ১৫০০ টাকা।
♣ বাসে বান্দরবান থেকে থানছি যাওয়া বা থানছি থেকে বান্দরবান আসা ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা।
♣ চাদের গাড়িতে বান্দরবান থেকে থানছি যাওয়া বা থানছি থেকে বান্দরবান আসা ভাড়া পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।
♣ গাইড সমিতির ফি ১০০ টাকা এবং গাইডের ফি প্রথম দিন ৭০০ টাকা এবং তারপরের প্রতিদিন ৫০০ টাকা।
♣ থানছি থেকে রেমাক্রি ইঞ্জিন বোট ভাড়া নেবে ২০০০-২৫০০ টাকা।
♣ আদিবাসীদের ঘরে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় রাতে থাকতে পারবেন।
♣ একবেলা ভাত খাবার খরচ ১০০-১৫০ টাকা। এবার আপনি বুঝে নিন আপনার দলের জন্য কেমন হতে পারে নাফাকুম ঘুরতে যাবার খরচ।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
