‘দুর্বল চিত্তের অধিকারীরা এই পোস্ট থেকে ১০০ হাত দূরে থাকুন’ অথবা ‘মরতে মরতে বেঁচে ফিরলাম হামহাম থেকে’ এমনই সব লাইন দিয়ে শুরু করা গল্প দিয়ে রাজকান্দির হামহাম ঝরণা -র সাথে আমার পরিচয়। হামহাম হলো রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ভারতীয় সীমান্তের কাছে দুই স্টেপের একটা অনিন্দ্য সুন্দর ঝরনা, যার উচ্চতা প্রায় ৭০ ফুট।
পরিচিত/অপরিচিত অনেকের লেখায় উঠে এসেছে এই ঝরনায় পৌঁছানোর, আর সেখান থেকে ফিরে আসার ভয়াবহ সব গল্প। যেমন ভীষণ খাঁড়া পাহাড় আর তার চেয়েও ভীষণ খারাপ এর রাস্তা। রাস্তা বলতে পায়ে চলা পথ আরকি। যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে সেই রাস্তায় হেঁটে সুস্থ শরীরে বাড়ি ফেরা যেন একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রায় তিন ঘণ্টার যাবার রাস্তা, শেষের দিকে গিয়ে পথ নাকি এভারেস্টের হিলারি স্টেপের মতো কঠিন হয়ে যায়।আমার এক ছাত্র তো গল্পই লিখে ফেলল যে, হামহাম দর্শন করে তারা এভারেস্ট বিজয়ের স্বাদ পেয়েছে। আবার জোঁকের রাজ্য সেখানে, চারদিকে কোটি কোটি মোটা জোঁক কিলবিল করছে মানুষের রক্ত খাবার জন্য। এই সব জেনেশুনে আমার একটা ধারণা হলো হামহাম ঝরনার ট্রেক ভীষণ কঠিন কোনো এক ট্রেক, যেখানে আমাকে হিমালয়ের খুম্বু রিজিয়নের মতো কিছু একটা পার হতে হবে আর সেখানে বড় বড় সব এনাকোন্ডা ঘুরে বেড়ায় মানুষকে কামড় দেওয়ার জন্য। চ্যালেঞ্জিং যেকোনো কিছুতে আমার বরাবরই উৎসাহ। তাই এসব ভয়ঙ্কর গল্পে দমে না গিয়ে বরং সময় আর সুযোগ খুঁজছিলাম, কবে যাব রাজকান্দির হামহাম ঝরণা দর্শনে।
২০১৭ সালের নভেম্বরে আশফাক ভাইয়ের ক্লাইম্বার হাব আর লিভিং উইথ ফরেস্টের যৌথ উদ্যোগে হামহাম ক্লাইম্ব করল প্রথমবারের মতো। ছুটি ম্যানেজ করে এই ক্লাইম্বিং ইভেন্টে যোগ দিতে না পারার দুঃখ ভুলতেই ক’দিন পরেই রাসমেলা দেখতে যখন কমলগঞ্জ গেলাম, তখন লিস্টে হামহামও যোগ করে নিলাম। ইচ্ছা ছিল একটা রাত হামহামের ধারে ট্যান্ট পিচ করে কাটাব। সেই অনুযায়ী ট্যান্ট আর প্রয়োজনীয় যা কিছু, সব সাথে নিয়ে রওনা হলাম চারজনের ছোট একটা দল।
কমলগঞ্জ থেকে সিএনজি দিয়ে কলাবনপাড়া পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। পাড়ার কাছাকাছি এসে সিএনজি ছেড়ে দিয়ে কিছু দূর হাঁটতে হয়। কারণ রাস্তা এত খারাপ যে, সিএনজি যেতে পারে না। সেই হাঁটাটুকু হয় চাম্পারাই চা বাগানের মধ্য দিয়ে। অনেক দিন পরে দেশি চা বাগান দেখে উচ্ছ্বাসের কোনো কমতি নেই। ছবি তুলতে তুলতে সন্ধ্যা নাগাদ পাড়ায় পৌঁছলাম। পাড়া থেকে হামহাম যাবার পথে শেষ ঘরটা সঞ্জীবদার। সেখানেই দুই দণ্ড দাঁড়াতে গিয়ে খবর পেলাম বিজিবি কাউকে থাকতে দিচ্ছে না ঝরনার ধারে। এর আগের দিন নাকি রাতের বেলা নিজেরা গিয়ে দর্শণার্থীদের ফিরিয়ে এনেছে পাড়ায়। শুনে আমরা গেলাম বিজিবির সাথে কথা বলতে। তারা জানাল, নিরাপত্তার খাতিরে আপাতত কাউকে সেখানে রাতে থাকার অনুমতি দিচ্ছে না। কাজেই কী আর করা। ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে গেলাম সঞ্জয়দার বাড়ি। ট্যান্ট পিচ করে রাতটা সেখানেই থাকব।
সারা পাড়াজুড়ে তখন রাসের উৎসব। চারদিকে বাদ্য-বাজনা, ঢাক-ঢোলের বাড়ি। মেলা থেকে কিনে আনা ভুভুজেলার কর্কশ শব্দে পুরো গ্রামে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। সঞ্জীব দাদাসহ গেলাম বাজারে চা খেতে। চার সাথে বিস্কুট আর এটা সেটা খেতে খেতে বেশ আড্ডা জমে ওঠল গ্রামবাসীর সাথে। আড্ডা শেষে ফিরে এলাম সঞ্জয়দার বাড়ি। সেদিন রাতে কলাবন পাড়ার কীর্তন গানের আসর বসেছিল সঞ্জয়দার পাশের বাড়িতে। সেখানে নানা রকম পূজার ভোগের সাথে উপভোগ করলাম কীর্তন গান।
রওনা হলাম হামহামের পথে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ঢাকের শব্দে। চোখ কচলাতে কচলাতে ট্যান্ট থেকে বের হয়ে দৌড় লাগালাম শব্দের উৎসের খোঁজে। দেখি বেশ ছোটখাটো একটা মিছিল। মিছিলের মধ্যমণি ১২/১৩ বছর বয়সের একটা ছেলে। সবাই তাকে ঘিরে গাইছে, নাচছে আর বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। বাড়ির বউরা পানি দিয়ে পা ধুয়ে দিচ্ছে সেই ছেলের, আর তারপর প্রণাম করছে। এরপর সাধ্যমতো চাল বা টাকা দিচ্ছে সেই ছেলের সাথে থাকা থলেতে। আমার সঙ্গী-সাথীরা তখনও ঘুমে। এর মাঝেই আওয়াজ শুনে পাশের বাড়ি গিয়ে অনেক দিন পর দেখলাম, ঢেঁকিতে চাল ভেঙে আটা তৈরি করছে পিঠার জন্য।
চলছে পূজা।
ফিরে এসে দেখি সঙ্গীরা সব তোড়জোড় করছে হামহাম অভিযানের। উৎসবের রেশে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ভীষণ চালেঞ্জিং একটা অভিযানে এসেছি। এটি এমন এক অভিযান, যেখান থেকে অনেকেই মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে, এ এমন এক অভিযান, যার গল্প দুর্বলচিত্তের অধিকারীদের পড়া নিষেধ। মন শক্ত করতে করতে ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। তেমন কিছু না, অতিরিক্ত একটা টি শার্ট, কিছু শুকনা খাবার, আর পানি। পানিটা বহন করতে হয়, কারণ হামহামের পানি বেশির ভাগ সময়ই ঘোলা থাকে, খাবার উপযোগী থাকে না। যেহেতু ট্রেক শুরুর জায়গাতেই আমরা রাতে থেকেছি, ভেবেছিলাম খুব ভোরে আমরা রওনা হব, যাতে অন্য কোনো দল পৌঁছানোর আগেই বা ভীড় বাড়ার আগেই আমরা হামহাম থেকে ফিরতে পারি। কিন্তু এটা-সেটা করতে করতে রওনা হতে বেজে গেল প্রায় সকাল ৯টা। ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে রওনা হলাম। দলে আমরা তিনজন হামহামে এই প্রথম যাচ্ছি। আর অপূ তো মাত্র কদিন আগেও হামহামে ক্লাইম্বিং করে গেছে।
অপূ থাকতে গাইড নেবার কোনো প্রশ্নই আসে না। কাজেই ছোট ছোট পায়ে সার বেঁধে রওনা হলাম আমরা চারজন। এটা-সেটা গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রাহাত আবার ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়ে একা একা প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য। হাসি, গল্প, গান-এইভাবেই পার হয়ে যাচ্ছিলাম হামহামের পাহাড়ি পথটা। যেসব ভয়ঙ্কর সব গল্প শুনে এসেছি, তার সাথে পথের কিছুর মিলছিল না। অপূকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, ‘আমরা ঠিক রাস্তায় এসেছি তো? সাধারণ পাহাড়ি ট্রেক যেমন হয়, তেমনি একটা ট্রেক। যেখানে ছবি তুলতে ইচ্ছে করেছে, থেমে ছবি তুলছি। যে জায়গাটা থেকে ইন্ডিয়ান বর্ডার বা ক্যাম্প দেখা যায়, সেখানে একটা বিস্কুট ব্রেকও দিলাম। তারপর নেমে এলাম ঝিরি পথে। অপূর কাছে শুনলাম, এই নামার রাস্তাটুকু অনেক পিছল হয়ে থাকে বৃষ্টি হলে। আমরা খুব ভালো অবস্থায় পেয়েছিলাম ওই জায়গাটুকু। এর পরে শুরু হলো ঝিরি। আমি বরাবরই ঝিরিপ্রেমী। ঝিরি পেলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। কারণে-অকারণে আমি ঝিরির পানিতে পা ভেজাই। ইচ্ছে হয় শরীর ডুবিয়ে রাখি ঝিরির পানিতে।
হামহামের ঝিরি।
হামহামের এই ঝিরির সৌন্দর্য বান্দরবান বা সীতাকুণ্ডের ঝিরির চেয়ে একটু আলাদা। বাঁশ ঝাড়ের প্রাচুর্য, আর বাঁশঝাড় ভেদ করে ঠিকরে বের হওয়া সূর্যের আলো এক অন্যরকম সৌন্দর্য দিয়েছে হামহামের ঝিরিকে। এই পুরো রাস্তাজুড়ে শুধুই আমরা চারজন ছিলাম। পুরোপুরি ভোগ করেছি প্রকৃতির নিস্তব্ধতা, প্রকৃতির কাব্য। গোগ্রাসে গিলেছি সবুজের সৌন্দর্য। এরপর হামহামের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, ফোনের ঘড়িতে তখন বাজে সকাল সাড়ে ১০টা। নিজের চোখকে বা ফোনকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না এই যে, এতদিন ভয়ঙ্কর সব গল্প শুনে এসেছি হামহাম ট্রেইলের, যে ট্রেইল শেষ করতে গড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগে ধরে রেখেছি। সেই ট্রেইল আমরা হাসি-ঠাট্টা, গানে-গল্পে কীভাবে দেড় ঘণ্টায় পার হয়ে এলাম, টেরও পেলাম না। একেকজনের ভয়াবহ সব জোঁকের গল্প আছে হামহামের। আর আমাদের একটা জোঁকও ধরল না!
হামহামের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালাম। বিশাল জলরাশি তীব্র বেগে আছড়ে পড়ছে মাটিতে। মুহূর্তের বিশ্রাম নেই, অবিরাম বয়ে চলছে এর স্রোতধারা। প্রকৃতির কাছে গেলে, মুখোমুখি দাঁড়ালে খুব তুচ্ছ মনে হয় নিজেকে। এই যে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি এখানে, কী বিশাল এর উচ্চতা! কী বিপুল জলরাশি! কী তীব্র তার বেগ! যেন চাইলে মুহূর্তে গ্রাস করে নিতে পারে আমাকে। একদিন আমি থাকব না। কিন্তু এই জলরাশির বয়ে চলা চলতেই থাকবে। এমন কিছু কাব্যিক ভাবনার মাঝে ব্যাঘাত ঘটল অন্যদের হৈচৈ-য়ে। ঝরনার সাথে তারুণ্যের উদ্দাম মিলে মিশে যেন এক হয়ে গেছে। সবাই মিলিয়ে ঝাপাঝাপি করলাম হামহামের মিষ্টি ঠান্ডা পানিতে। ঝরনাটা তখন শুধুই আমাদের চারজনের। মনে হচ্ছিল, এভাবে ভিজতে থাকলে একটা সময় যেন নিজেও ঝরনার একটা অংশ হয়ে যাব। ‘ঠান্ডা লেগে যাবে’ অপূর বকুনিতে যেন ফিরে এলাম বাস্তবে। ঝরনাকে ছেড়ে উঠে আসতে হলো।
হামহামের সামনে আমি।
যেভাবে এসেছি, ফিরতে বেশি সময় লাগবে না আমাদের; ভেবে আরও কিছুক্ষণ ঝরনার ধারে কাটালাম। রাহাত তো কিছুক্ষণ ঘুমিয়েও নিল। আমরা ঝরণাটাকে পাশ কাটিয়ে উঠে গেলাম ঝরণার মাথায়, যেখান থেকে তীব্র বেগে ধেয়ে পড়ছে পানি। সাহস করে একেবারে মাথায় চলে গেলাম, আর হামহামের সামনে থেকে ছবি তুলে দিলো রাহাত। যদিও আমাকে দেখাচ্ছিল বিন্দুর মতো। নেমে এসে সাথে থাকে শুকনা খাবারগুলোর সদ্ব্যবহার করলাম। পেট ভরে পানি খেয়ে আবার রওনা হলাম ফিরে আসার জন্য। আমাদের ফেরার কোনো তাড়া ছিল না। সঞ্জীবদার অনুরোধে ওই রাতটাও উনার বাড়িতেই কাটাব, সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাজেই ফিরে আসার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল আমাদের হাতে। তাই ঠিক করলাম ঝিরি পথের কাছেই সিতাপ নামের একটা ঝরনা আছে কোথাও। সেটা দেখে ঝিরি ধরেই গ্রামে ফিরে যাব।
ঝিরি পথ ধরে এগিয়ে যখন পাহাড়ে ওঠার জায়গাটায় এলাম, তখন দেখলাম একটা দল যাচ্ছে হামহামের দিকে। দলটা আমাদের অতিক্রম করার পর আমরা এগিয়ে চললাম ঝিরি পথ ধরে সিতাপের খোঁজে। সামনে আগাই আর ঝিরি পথ ভয়ঙ্কর দুর্ভেদ্য হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু সিতাপের দেখা আর মেলে না। এত তো সময় লাগার কথা না। আমরা কি তবে পথ হারিয়েছি? নিশ্চিত পথ হারিয়েছি ভাবতে ভাবতে সামনেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, কারণ এখানে এসে আর পিছু ফেরার কোনো মানে হয় না। ভাবছিলাম নিশ্চয়ই সামনে এমন কোনো একটা টার্ন আছে, যেটা দিয়ে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যাবে পাড়াতে। সেই ভাবনাতেই সামনে আগানো। যতই সামনে আগাই, পথ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকে। ঝিরি একসময় গভীর হতে থাকলে ঝিরি ছেড়ে ঝিরির পাশ দিয়ে চলা শুরু করলাম। একসময় কুমগুলো এত ভয়ঙ্কর রূপে দেখা দেয় আর পাশের রাস্তা চলার এত অনুপযোগী হতে থাকে যে, আমরা হঠাৎ করে ঝিরি ছেড়ে পাশের পাহাড় বেয়ে ওঠা শুরু করি। সেই পাহাড় আবার বাঁশের জঙ্গলে ভরা। চলার জন্য কোনো পথই নেই, বাঁশ গাছ সরিয়ে সরিয়ে একটা টিলা পার হয়ে আবার নেমে ঝিরিতে চলে আসলাম। পাশেই গভীর খুম আর তার পাশ দিয়ে চলছি আমরা।
ফিরছি ঝিরি পথ ধরে।
হাঁটতে হাঁটতে সবাই কমবেশি ক্লান্ত। আমাদের সঙ্গে কোনো খাবার নেই, নেই খাবার মত বিশুদ্ধ কিংবা পরিস্কার পানি। সঙ্গে নেই কোনো আলোর ব্যবস্থা। হামহামের চেনা পথ, তাই জিপিএসও সঙ্গে নেওয়া হয়নি। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই যে কারো কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে। অন্ধকার হওয়ার আগেই লোকালয়ে ফিরতে পারব কি না অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে আচমকা খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম যে পাহাড়ি পথের ভয়ঙ্কর সব গল্প শুনে এসেছি, সেই পথ নির্বিঘ্নে পার হয়ে এসে এখন এ কী বিপদে পড়লাম! পথ হারিয়ে না খেতে পেরে মরব না তো? কেউ কি আসবে আমাদের উদ্ধার করতে? এমন সাত-পাঁচ ভাবছি আর এগিয়ে যাচ্ছি। একটা সময় আর পথ নেই। ঝিরি বেয়ে নামতে হবে। নামতে হবে মানে মাঝখানের খাদটুকু লাফ দিয়ে পৌঁছাতে হবে অন্য পারে। সাইফ ছিল সবার সামনে, দেখলাম সে ভয় পাচ্ছে এত উঁচু থেকে লাফ দিতে। অগত্যা আমাদের জংলি অপূ টারজানের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে অন্য আরেক পাশ থেকে নিয়ে এলো লম্বা একটা বাঁশ। আনার সময় পিছলে পড়ে ওর গলায় ঝোলানো ক্যামেরা যায় যায় অবস্থা।
যাই হোক, সেই বাঁশ বেয়ে নামার ব্যবস্থা করে দিলে আমরা নেমে আসলাম আরেক পারে। এপাশে কিছু দূর আগানোর পরে দেখলাম কুমের গভীরতা কমে গেছে, অতএব, আবারো নেমে পড়লাম ঝিরিতে। কী যে ঠান্ডা সেই পানি! নভেম্বরের শেষের দিকের সেই বিকেলে ঝিরিতে ভিজে ঠান্ডা বাঁধানোর কোনো প্ল্যান আমার ছিল না। তাই ঝিরির পানি উপভোগের চাইতে পা চালিয়ে লোকালয়ে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে দেখতে পেলাম ঝিরিটা শেষ হয়ে বেশ সমতল একটা জায়গা। খুব খুশি মনে ঝিরিটুকু পেরিয়ে পথে উঠব ভেবে ঝিরিতে নেমেই দেখি গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আছি। আর ওই গলা পানি পেরিয়ে সমতল জায়গাটা উঠার পর শুধুই হেঁটে চলা। বেলা বেশি নাই, আমাদের সঙ্গে কোনো টর্চ নেই—এই ভাবনা আমাদের তাড়াচ্ছিল ওই পথে। ডানে-বামে না তাকিয়ে শুধুই পথটুকু অতিক্রম করে যাওয়া।
ঝিরি পথ।
এই সারা পথে কোনো একটা জনমানবের দেখা মেলেনি, যাকে জিজ্ঞাসা করা যায় এই জঙ্গল থেকে বের হওয়ার রাস্তা। পায়ে হাঁটার রাস্তা পেয়ে আমরা সোজা এগোতে থাকলাম, যদিও জানি না কোন দিকে যাচ্ছি বা কোথায় যাচ্ছি। এই পথে আদৌ আমরা কলাবনপাড়ায় পৌঁছাতে পারব কি না জানা নেই। তবু পথ চলছিলাম এই ভেবে যে সূর্য ডোবার আগেই আমাদের যেকোনো লোকালয়ে পৌঁছাতে হবে। পেটে অসম্ভব খিদে, পানির তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ—সব ভুলে গিয়ে অবিরাম পথ চলছি তখন। নিজেদের মধ্যে গল্পের ঝুড়ি, হাসাহাসি আর ঠাট্টা বন্ধ হয়ে গিয়েছে সেই কখন টেরও পাইনি। সবার তখন একটাই চিন্তা, দ্রুত বের হতে হবে এই জঙ্গল থেকে। সোজা হাঁটতে হাঁটতে এমন অবস্থা হলো যে সামনে গাছ পড়লে গাছেও উঠে যাচ্ছিলাম আমরা। এভাবে যেতে যেতে যখন একটা বেতের জঙ্গলে এসে পৌঁছলাম তখন একটু প্রাণ ফিরে পেলাম এই ভেবে যে এই জঙ্গলের গল্প আগে শুনেছি। এই বেতের জঙ্গল পেরোলেই আমাদের আকাঙ্ক্ষিত কলাবনপাড়া।
বেতের বনে এসে হাঁটার গতি কমে এলো। দারুণ সুন্দর সেই বন। বেত বন এত সুন্দর হয় আমার জানা ছিল না। একটা সময় বাঁশের সাঁকো পেরোনোর পর যেন অন্য এক জগতের মতো দেখা দিল কলাবনপাড়া। মনে হলে যেন আমরা প্যারালাল ইউনিভারসের কোনো দরজা দিয়ে দেখছি মাঠ পেরিয়ে অদূরে সঞ্জয় দাদার ঘর। সন্ধের ঠিক আগে আগে ঘরে ফিরলাম আমরা। আমাদের জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন দাদা। ঘরে পৌঁছুতেই বৌদি জানাল মুরগির ঝোল রান্না হয়েছে। নাগা মরিচ দিয়ে রাঁধা সেই দারুণ মুরগির ঝোলের স্মৃতি বহুদিন জিভে জল এনে দেবে। খাওয়া শেষে আবারও যথারীতি শুরু হলো গান-বাজনার আড্ডা। যোগ দিল পাড়ার লোকেরাও।
সঞ্জয়দার পরিবারের সাথে।
দারুণ রোমাঞ্চকর একটা দিন কাটিয়ে যখন টেন্টের ভেতরে শরীরটা এলিয়ে দিলাম, মুহূর্তে ঘুমে ঢলে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেও টের পেলাম ভিজছি হামহাম ঝরনার রিমঝিম ধারায়, হেঁটে চলেছি ভয়ঙ্কর সব কুম পেরিয়ে, বেতের বাগান পেরিয়ে অজানা কোনো ঝরনার উদ্দেশে।
হামহাম বর্তমানে বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় একটা ঝরনা। অনেকের পাহাড় যাওয়া বা ঝরনা দেখা শুরুই হয় হামহাম দিয়ে আর তাই হামহামের ট্রেইল নিয়ে চালু রয়েছে ভয়ঙ্কর সব গল্প। তবে বৃষ্টি হলে হামহামের পথ সত্যি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তাই বৃষ্টির সময়টুকু বাদ দিয়ে হামহামে গেলে কোনোরকম বিপদ বা জোঁকে ধরা ছাড়াই ঘুরে আসা যাবে এই অনিন্দ্যসুন্দর ঝরনাটি।
কলাবন পাড়াবাসীর কাছে শুনলাম হামহামের জনপ্রিয়তার জন্য, কলাবনপাড়া থেকে হামহাম পর্যন্ত গাড়ি চলার রাস্তা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সত্যি যদি এমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে তবে তার তীব্র নিন্দা জানাই। গাড়ি যাওয়ার মতো রাস্তা তৈরি হলে দর্শনার্থী বাড়বে নিঃসন্দেহে, কিন্তু প্রকৃতিতে আলিঙ্গন করে, বুনো পথে ধরে হেঁটে যেয়ে ঝরনায় নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রকৃতিকে জয় করার যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেই আনন্দটা নষ্ট হয়ে যাবে। প্রকৃতি থাকুক প্রকৃতির মতো, প্রকৃতিকে প্রাণভরে উপভোগ করতে গিয়ে যেন প্রকৃতিকে ধ্বংস করে না ফেলি আমরা।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
