২০১৭ র ৩রা এপ্রিল। হোয়াটস অ্যাপে একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চার গ্রুপের জন্ম হল। প্রস্তাবিত দু’চারটে নামের থেকে শেষ পর্যন্ত তার চূড়ান্ত নামকরণ হল ‘1st TAAT: 2017’  যা ভেঙে লিখলে দাঁড়ায় 1st Trans Ayodhya Adventure Trek:2017। বাংলায় খোলসা করে লিখলে লিখতে হবে অযোধ‍্যা পাহাড়ের দুই প্রান্ত বিস্তারি সাহসিক ট্রেক। এই অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকের বৈশিষ্ট্য হল পাহাড় জঙ্গল পার হয়ে অযোধ‍্যা পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত অবধি পাঁচ /ছ’দিন ধরে যখন সেটা চলবে তখন

১) কোন বাড়িতে বা তাঁবুতে থাকা যাবে না; প্লাস্টিক শীট দিয়ে যে যার নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করে নেবে
২) এই ক’দিন নিজের খাবার নিজেকে করে নিতে হবে; তার জন‍্য রান্নার বাসনপত্র, পাঁচ ছয় দিনের মতো নিজের পছন্দের কাঁচা সব্জী, চাল-ডাল-তেল-মশলা সব নিজেকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে; রান্নার লোক পাওয়া যাবে না, তৈরি খাবার‌ও পাওয়া যাবে না
৩) রান্নার আগুন জঙ্গলের কাঠ, পাতা দিয়ে করতে পারলে ভাল, তা না হলে একেবারে খুলে ফেলা যায় এমন প্রাইমাস স্টোভ, কেরোসিন তেল, কাগজ আর মোম দিয়ে তৈরি বিশেষ জ্বালানী, দেশলাই ইত‍্যাদি নিয়ে যেতে হবে
৪) সঙ্গে কোনও মালবাহক থাকবে না
৫) কোনও পথপ্রদর্শক না থাকাই বাঞ্ছনীয়; পরিবর্তে স্থানীয় বিশদ মানচিত্রের সাহায‍্য নেওয়া হবে
৬) বৃষ্টি-বাদল, সাপ-খোপ, পোকা-মাকড়ের হাত থেকে বাঁচার ব‍্যবস্থা রাখতে হবে
৭) প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে শুরু করে শরীরকে চাঙ্গা রাখার সব ওষুধপত্র যেন সঙ্গে থাকে।

এর ওপর তো নিজের জামা-কাপড়, অতিরিক্ত জুতো, টর্চ, বাইনোকুলার, ক‍্যামেরা, স্লিপিং ব‍্যাগ, ম‍্যাট্রেস ইত‍্যাদি আছেই। মোটামুটি একটা ১৫ থেকে ২০ কিলোর বোঝা ওই কদিন নিজেকে ব‌ইতে হবে। ব‍্যাপারটা কিন্তু খুব সহজ নয় । চোদ্দ বছর বাদে একটা স্বপ্ন সফল হ‌ওয়ার গোড়া পত্তন হল।

চোদ্দ বছর আগে শিলিগুড়ির HNAF ক্লাবের প্রাণ-পুরুষ অনিমেষ বোসের আমন্ত্রণে প্রথম ‘ অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং ’এর সঙ্গে পরিচিত হ‌ই। ওর সঙ্গে তার পরবর্তী পাঁচ বছরে আরও তিনটি ওই রকম অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিংএ অংশ নেবার সুযোগ আসে। সব কয়টা অ্যাডভেঞ্চার ট্রেক‌ই অনুষ্ঠিত হয় উত্তরবঙ্গের হিমালয়ের কোলে। দু’তিনটে ট্রেক করার পর আমার মাথায় প্রশ্ন জাগে এই ধরণের অ্যাডভেঞ্চার ট্রেক কি আমাদের দক্ষিণবঙ্গে করা যায় না? উত্তর সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে যাই ‘হ‍্যাঁ, অবশ‍্য‌ই করা যায়’। কিন্তু তখন করা সম্ভব ছিল না। তার কারণ দক্ষিণবঙ্গের যে অঞ্চলে এই ‘ অ্যাডভেঞ্চার ট্রেক ’ করা সম্ভব সেই পুরুলিয়া বা পশ্চিম মেদিনীপুর তখন মাওবাদী অধ‍্যুষিত অঞ্চল। মাত্র পাঁচ ছ’বছর আগে থেকে অযোধ‍্যা পাহাড়ের হাতে গোনা কয়েকটা জায়গায় যেমন মাঠা, পারডি, গজাবুরু, পাখি পাহাড়, শিরকাবাদ আর খয়রাবেরাতে শিলারোহণ এবং ক‍্যাম্পিং কোর্স আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু ‘ অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং ’ তো আর এক জায়গায় বসে করা যায় না। তাই তার কথা তখনও ভাবা যাচ্ছিল না।

ইতোমধ‍্যে, গতানুগতিক প্রথাসিদ্ধ রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসে, ২০১৬ র ফেব্রুয়ারিতে ‘সাহস উৎসব পরিষদ’ অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে মাঠায় চার দিন ধরে তাদের ‘প্রথম সাহস উৎসব’ উদযাপন করল। সম্পূর্ণ নতুন একটি অ্যাডভেঞ্চার ভিত্তিক অনুষ্ঠান। সকলেই একটু চিন্তিত ছিল, কী হবে সেখানে, তাই নিয়ে। উৎসব শেষে দেখা গেল সবাই খুব অসন্তুষ্ট। কারণটা কী, না এমন একটা মনোগ্রাহী অনুষ্ঠান চার দিনে শেষ করা উচিত হয় নি। সামনের বার পাঁচ দিনে করতেই হবে। তাদের উৎসাহেই ২০১৭ র ফেব্রুয়ারিতে অযোধ‍্যা পাহাড়ে মাঠার বিপরীত প্রান্তে শিরকাবাদে সাফল‍্যের সঙ্গে পাঁচ দিনের ‘ দ্বিতীয় সাহস উৎসব’ উদযাপিত হল।              

সাফল‍্যের পাশাপাশি একটা দুর্ভাগ্যজনক অন্ধকারময় জগতের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় ঘটল। ‘প্রথম সাহস উৎসব’ এর প্রচণ্ড উদ্দীপনা আর জনপ্রিয়তা দেখে কয়েকজন স্বনামধন‍্য পর্বতারোহী ‘দ্বিতীয় সাহস উৎসব’ যাতে না হয় তার জন‍্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। হায় আমরা কোন জগতে বাস করি! কিন্তু তাদের সমস্ত অপচেষ্টায় জল ঢেলে দিয়ে দ্বিতীয় সাহস উৎসবের সাহসী সদস্যরা, অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি তাদের নিখাদ ভালবাসার পরিচয় রেখে গেলেন পাঁচদিন ধরে ‘সাহস উৎসব’ পালন করে।

আপনারা নিশ্চয়‌ই এতক্ষণে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন যে কী এমন অনুষ্ঠান এই উৎসবে হয় যার জন্য এর এত জনপ্রিয়তা? ব‍্যাপারটা সহজে এবং ভালভাবে বোঝার জন‍্য যে কোনো একটা রেস্তোরাঁর কথা ভাবুন। সেখানে ঢুকে চেয়ারে বসার পর রেস্তোরাঁর লোকেরা কী করে? আপনার হাতে একটা মেনু কার্ড ধরায়। আপনি তার থেকে আপনার পছন্দ মতো খাবার দিতে বলেন। অন‍্য লোকেরা আবার তাদের পছন্দসই অন‍্য খাবার বেছে নেন। আপনারা অন‍্য কোনোদিন সেই রেস্তোরাঁয় আবার গেলে খাবার পাল্টাতে পারেন আবার নাও পারেন, সেটা আপনার ইচ্ছা । 

সাহস উৎসবেও ঠিক এক‌ই নিয়ম। সাহস উৎসব প্রাঙ্গনে পৌঁছানোর পর নথিভুক্তিকরণের কাজ হয়ে গেলে সেখানে যত রকম সাহসিক অর্থাৎ  অ্যাডভেঞ্চারমূলক কাজকর্ম করা সম্ভব তার একটা ‘মেনু কার্ড’ প্রথমেই সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। তার মধ‍্যে মোটামুটি কী কী ‘খাবার’ থাকে তার একটা তালিকা পেশ করছি। ‘স্যুপ’ হিসেবে থাকে স্বপরিচিতি জ্ঞাপন আর ‘স্টার্টার’ হিসেবে বলে দেওয়া হয় উৎসবের নিয়মাবলি। ‘মেইন কোর্স’এর মধ‍্যে থাকে ক‍্যাম্পিং, রক ক্লাইম্বিং, জাঙ্গল ট্রেকিং, অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং, অযোধ‍্যা পাহাড়ের এক বা একাধিক শৃঙ্গে আরোহণ, ম‍্যাপ রীডিং, হিল বাইকিং, ওরিয়েন্টিয়ারিং (আমরা যতদূর জানি ভারতবর্ষের‌ অন‍্য কোথাও এই ওরিয়েন্টিয়ারিং কখনও করানো হয় না)। এর সঙ্গে ‘সালাড’ আর ‘চাটনি’ হিসেবে থাকে বার্ড ওয়াচিং, স্টার ওয়াচিং, অ্যাডভেঞ্চার ফটোগ্রাফি, স্থানীয় আদিবাসী গ্রাম ভ্রমণ আর আশে পাশের পর্যটনের স্থানগুলো ঘোরা। তারপর ‘ডেসার্ট’ হিসেবে দেওয়া হয় কিছু অ্যাডভেঞ্চার সংক্রান্ত আলোচনা যেমন – পশ্চিমবঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারের অ আ ক খ, হিমালয় এবং অযোধ‍্যা পাহাড়ের পরিচিতি, অভিযাত্রীদের ব‍্যক্তিগত অভিযানের রোমাঞ্চকর গল্প ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি। অবশেষে ‘পান’ হিসেবে পাওয়া যাবে ‘ক‍্যাম্প-ফায়ার’ সঙ্গে ‘হজমী’ স্থানীয় ছৌ- নাচ। 

এইবার সবার খাবারের ফরমায়েশ জানার পর এক একটা খাবারের‌ আগ্রহীদের জন্য এক একটা দল করে তাদের সঙ্গে প্রয়োজন মতো প্রশিক্ষক বা নির্দেশক দিয়ে পাহাড় জঙ্গলের উপযুক্ত স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সারাদিনে শুধু আসল কয়েকপ্রস্থ খাবারের যেমন মর্নিং টি, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ইভিনিং স্ন‍্যাক্স, ডিনার ইত‍্যাদির সময়গুলোই শুধু আগের থেকে ঠিক করা থাকে। বাকি সব যে কখন হবে, কাদের নিয়ে হবে, কোথায় হবে কিছুর‌ই ঠিক থাকে না। সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তনশীল, বৈচিত্র্যময়, খোলামেলা, তাড়নাহীন কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং অ্যাডভেঞ্চার মথিত কয়েকটা জমাট অনুষ্ঠানের তোড়া এই ‘সাহস উৎসব’। দিনের শেষে আবার নতুন করে পরের দিনের ‘খাবারের’ অর্ডার নেওয়া হয় এবং সেইমতো ব‍্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এইভাবেই একদিন উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে।

এখন প্রথমবারের উৎসব চার দিনের ছিল বলে সেই সময় মেনুতে ‘ অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং ’ রাখা যায়নি। দ্বিতীয়বার পাঁচদিন হ‌ওয়ায় সেই সুযোগটা পাওয়া গেল এবং দশজনের একটা দলকে মাত্র দু’দিনের জন্য ছোট্ট একটা পরীক্ষামূলক ‘ অ্যাডভেঞ্চার ট্রেক ’এ নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। ফিরে এসেই সবাই আবদার ধরল একটা বড় করে শুধু ‘ অ্যাডভেঞ্চার ট্রেক ’ই করতে হবে। ফলে আমার মাথায় সেই চোদ্দ বছরের পুরনো ভূতটা নড়ে চড়ে বসল। বহুদিন ধরে লালিত অযোধ‍্যা পাহাড়ে এই ট্রেকের পরিকল্পনা সংক্ষেপে ওদের সামনে তুলে ধরলাম। সবাই সঙ্গে সঙ্গে চনমনিয়ে উঠল। পারলে তখন‌‌ই র‌ওনা দেয়। তাদের প্রবল আগ্রহ আর চাহিদার চাপে সেই দ্বিতীয় সাহস উৎসবে উপস্থিত সদস‍্যদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে, তাদের মত অনুযায়ী, সেইদিনই অযোধ‍্যা পাহাড়ে প্রস্তাবিত প্রথম অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকের দিনক্ষণ, শুক্লপক্ষের কথা মনে রেখে ২৮শে  নভেম্বর থেকে ২রা ডিসেম্বর, ২০১৭ ঠিক করে ফেলা হয়। কারা এই ট্রেকে অংশগ্রহণ করতে পারবে সেটাও বলে দেওয়া হয়। কে এই অভিযানে নেতৃত্ব দেবেন তার নাম ঘোষণা করা হয়।

প্রথমেই এই অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকে যোগ দেওয়ার জন‍্য যারা যোগ‍্য বিবেচিত হয়েছিল তাদের এই হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে নাম উঠল। ফলে কয়েকদিনের মধ্যে কাগজে কলমে (হোয়াটস অ্যাপ এ) প্রায় ২৮ জনের একটা সঙ্ঘবদ্ধ দল তৈরি হয়ে গেছে দেখলাম। নানা অসুবিধার জন‍্য পরে কয়েকজন তাদের নাম প্রত‍্যাহার করে। ট্রেকের সব আলোচনা তো আর হোয়াটস অ্যাপে করা সম্ভব নয় তাই গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ‍্যে একটা প্রাথমিক মিটিং আর তিন তিনটে কর্মশালা সংগঠিত করতে হয়েছিল এবং সেটা করতে হয়েছিল ট্রেকের সদস‍্যদের আগ্রহের আতিশয‍্যে। 

এবার দেখা যাক সেই সব মিটিংএ আর হোয়াটস অ্যাপে কত রকম আলোচনা আর পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছিল। প্রথমেই অভিযাত্রীদের নাম ঠিকানা, নিকট আত্মীয়ের নাম আর মোবাইল নং, ব্লাড গ্রুপ, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা সব লেখা হল। দেখা গেল ১৮ থেকে ৫৮ অবধি সব বয়সী সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষজন‌ই সেখানে আছে। 

তারপর একটা মানচিত্রে ট্রেকের গতিপথ বুঝিয়ে দেওয়া হল। এই ট্রেক শুরু হবে ৩০০ মিটারে আর শেষ দিন উঠতে হবে সর্বোচ্চ উচ্চতায় চামটু শৃঙ্গে (৬৯৯ মিটার)। মজা হল না গুগল ম‍্যাপ, না উইকিপেডিয়া, না আমাদের স্কুলের ভূগোল ব‌ই, কোথাও উল্লেখ করা নেই যে চামটু অযোধ‍্যা পাহাড়ের তথা দক্ষিণবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। বরং ভুল তথ‍্য দিয়ে বলা আছে গর্গাবুরুই অযোধ‍্যার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। অযোধ‍্যায় অনেকেই যায় কিন্তু চামটুর মাথায় ওঠা দূরে থাক তাকে দেখতেই পায় খুব কম লোক, জানে আরও কম। নিজেদের রাজ‍্যটাকেই আমরা এখনও ঠিক মতো চিনি না। সেই অভাবটা দূর করাই এই ট্রেকের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য।

এই অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকের আর একটা উদ্দেশ‍্য হল অভিযাত্রীদের‌ আত্মবিশ্বাসী, স্বাবলম্বী এবং সাহসী করে তোলা। সেই কারণে হোয়াটস অ্যাপে আগুনের ব‍্যবহার নিয়ে বেশ কয়েকদিন আলোচনা চলল। জঙ্গলে আগুন জ্বালানো এখন প্রায় নিষেধ। তাই পুরো খুলে ফেলা যায় এই রকম ছোট পেতলের প্রাইমাস স্টোভ কোথায় পাওয়া যায়, তার কত দাম ইত‍্যাদি আলোচনা হল। অনেকে কিনেও ফেলল। তারপর দত্তপুকুরে এক বাগান বাড়িতে তার ব‍্যবহার দেখানো হল। অবশ‍্য জরুরী পরিস্থিতিতে কাঠ, সরু ডাল, শুকনো পাতা দিয়ে বৃষ্টির মধ‍্যেও কী ভাবে আগুন তৈরি করতে হয় সেটাও শিখে রাখা হল।

এইবার নজর পড়ল তাঁবুর পরিবর্তে প্লাস্টিক শীট দিয়ে নিজেদের আস্তানা বা শেলটার বানানোর বিদ‍্যে রপ্ত করায়। কোন মাপের কটা শীট লাগবে, কোন ধরনের শীট কিনতে হবে, তার কোন কোন রং চলবে না, তার সাথে ব্রাউন টেপ, সেফটি পিন, দড়ি, সুতলি, কতটা লাগবে সব বলা হল। শেলটার সিধে আর টানটান রাখার জন‍্য দড়ি টেনে যে সব গিঁট দেবার প্রয়োজন সে সব শেখানো হল। তারপর সেই সব নিয়ে দত্তপুকুরের এক বাগানে শেলটার বানিয়ে সবাই হাত পাকাল। কোনটা একজনের, কোনটা দু’জন বা তিনজনের শেলটার। একটার থেকে আর একটার চেহারা, চরিত্র, রং সব আলাদা। দেখেও সুখ। নিজের তৈরি ঘরে থেকে আরও সুখ। তারপর বাবুই পাখির সেই ‘কাঁচা অথচ খাসা ঘর’ যখন ঝড় বৃষ্টির ঝাপটাও হাসি মুখে স‌ইবে তখন তো সুখের পরাকাষ্ঠা।

এইবার রান্না। বাড়িতে যে ভাবে চর্ব‍্য চোষ‍্য লেহ‍্য পেয় তৈরি হয় সে ভাবে রান্না এখানে নামঞ্জুর। আমাকে অল্প সময়ে, অল্প আগুনে, সারাদিনে প্রয়োজন মতো, আমার শারীরিক শক্তির ক্ষয় পূরণ করতে সক্ষম, এমন পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে হবে। আবার রোজ দু’বেলা শুধু খিচুড়ি, ম‍্যাগি বা ছাতু চিঁড়ে খেয়ে রান্না করার মজা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করাও চলবে না। রান্না প্রকৃত‌ই একটা শিল্প।  প্রত‍্যেক অভিযাত্রীকে এই শিল্পে কিছুটা রপ্ত হতেই হবে। একজন মানুষের খেতে কোন খাবার কতটা লাগে তার হিসেব করা আর তা দিয়ে ট্রেকের প্রতিকূল পরিবেশে বুদ্ধি খাটিয়ে, উপযুক্ত উপকরণ সহযোগে, অভিনব পদ্ধতি প্রয়োগ করে, রান্না সুসম্পন্ন করার মধ‍্যে যে মুন্সিয়ানা সেটাই এই ট্রেকে চর্চা করার বিষয়। এক কর্মশালায় তার‌ও অনুশীলন হল।

নিজেদের রুকস‍্যাকে ১৫ থেকে ২০ কিলো মাল ভরে কয়েক কিলোমিটার হাঁটার সক্ষমতা দেখা হল। শারীরিক সক্ষমতা বাড়াবার জন‍্য তার অনেক আগেই হোয়াটস অ্যাপে ভিডিও দেখিয়ে সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছিল কোন কোন ধরণের শরীরচর্চা কতক্ষণ ধরে করতে হবে ।

এরপর ‘ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড স্পোর্টস’ এর উদ‍্যোগে বেহালার বিদ‍্যাসাগর হসপিটালে সারাদিন ধরে শুধু ফার্স্ট এইডের এক কর্মশালায় এই অভিযানের সদস‍্যরা অংশগ্রহণ করে। শুধু সাপ, পোকা মাকড়, হাতি নিয়েও একটা অডিও-ভিসুয়াল কর্মশালা হল। একটা সামান‍্য অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকের জন‍্য তার সদস‍্যরা কতটা আগ্রহী এবং আন্তরিক হলে এত সব করা সম্ভব হয়! 

এছাড়াও রাত্রে, বিশেষ করে রান্নার সময়ে, কী ভাবে আলোর ব‍্যবস্থা করা যাবে; যে সময়ে ট্রেক চলবে সেই সময়ের আবহাওয়ার খবর আগাম পাওয়া যাবে কী ভাবে; হাঁটতে হাঁটতে বোতল বার না করে সেখান থেকে পাইপ দিয়ে জল খাওয়ার বস্তু – ক‍্যামেল ব‍্যাগ, কোথায় পাওয়া যাবে; স্থানীয় বন দপ্তর, পুলিশ, পঞ্চায়েত, সবাইকে ট্রেকের  কথা জানানো; ঠিক সময়ে যাওয়া-আসার অগ্রিম ট্রেনের টিকিট কাটা; রেল স্টেশন থেকে ট্রেক শুরুর জায়গা আবার ট্রেক যেখানে শেষ হবে সেখান থেকে রেল স্টেশন পর্যন্ত গাড়ির ব‍্যবস্থা করা ইত‍্যাদি হাজারটা কাজ যাবার আগে করতে হয়েছে।

সব শেষের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল এই ছোট্ট কিন্তু মহার্ঘ ট্রেকের ভাবনা শুরু হ‌ওয়ার সময় থেকে শেষ পর্যন্ত তার কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা লেখা এবং তার ছবি তোলা এবং সেটা সবাইকেই সাধ‍্যমতো চেষ্টা করতে হবে। ভবিষ‍্যৎ ট্রেকারদের জন‍্য সব তথ‍্য ঠিকঠাক রাখা একটা আবশ‍্যিক কর্তব‍্যের মধ‍্যে পড়ে। তারপর সবার লেখা আর ছবি এক জায়গায় করে, ঠিক ভাবে সম্পাদনা করে, কোনো পত্রিকায় ছাপাতে হবে।

দু’লক্ষ বছর আগে আমাদের পূর্ব-পুরুষ ‘হোমো সেপিয়ানদের’ (ল্যাটিন অর্থে জ্ঞানী ব‍্যক্তি) বসবাস ছিল সুদূর আফ্রিকায়। ষাট হাজার বছর আগে, আর‌ও জ্ঞানের সন্ধানে কি না জানি না, তবে অবশ‍্য‌ই বৈচিত্র্যের সন্ধানে, তারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সেই মানুষ ভারতবর্ষে এসে উপস্থিত হয় চল্লিশ হাজার বছর আগে। আদিমতম সেই মানুষদের অতুলনীয় এবং দুর্দমনীয় দীর্ঘ অভিযানের এক অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের প্রতিচ্ছবিই ‌হল বর্তমান আধুনিক মানুষের সমস্ত অ্যাডভেঞ্চারমূলক কর্মকাণ্ড। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অভিযানের চিরন্তন স্বভাব আর ইচ্ছা পরম্পরাক্রমে রক্তে মজ্জায় প্রবাহিত হয়ে এখনও মানুষের শরীরে এবং মনে ‘বিপন্ন বিস্ময়ে খেলা করে’। অযোধ‍্যা পাহাড়ে এই ছোট্ট ট্রেকটাও, বিশাল সমুদ্রের মতো সেই আদিম অভিযাত্রিক মানসিকতার‌ই এক অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঢেউ। একে দেখতে ছোট লাগে বটে কিন্তু সে মহান ঐতিহ‍্যের বিশ্বস্ত ধারক এবং বাহক।                                                                  

এই চলার শুরু হয়তো আছে শেষ নেই।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

টোয়াইন খালে ভেলাভিযান
নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন
ভারতের সমস্ত উল্লেখযোগ্য অ্যাডভেঞ্চার লোকেশন চিহ্নিত করে রাখা ম্যাপ তৈরি করতে তিনি প্রায় পুরোটা জীবন ব্যয় করেছেন। খুবই সাধারণ, আন্তরিক, আর প্রচন্ড মেধাবী এই মানুষটি ভারতীয় সরকারের National Atlas & Thematic Mapping Organization এ জয়েন্ট ডিরেক্টর ছিলেন। গত ৪২ বছর যাবত জড়িত আছেন বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রাম, ম্যাপ রিডিং কোর্স, অরিয়েন্টিয়ারিং কোর্স আর ক্যাম্পিং কোর্স আর সাহসিক উৎসব নিয়ে।

Sharing does not make you less important!

টোয়াইন খালে ভেলাভিযান
নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

টোয়াইন খালে ভেলাভিযান
নাগ পাহাড় বিজয়ের স্বপ্ন

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!