টোয়াইন খালে ভেলাভিযান এর গল্প নিয়ে এলাম আজ। বান্দরবানের টোয়াইন খালের নামটা প্রথম বারের মত শুনেছিলাম কালপুরুষ অপূ ভাইয়ের কাছে। ২০১৭ এর ফেব্রুয়ারী/মার্চ মাসে উনি টোয়াইন খাল অভিযানের পরিকল্পনা নেন। আমার অভিজ্ঞতার গল্পটা ঐ অভিযান থেকে হলে ভালই হত। কিন্তু সেবারে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সেই টোয়াইন অভিযানের সুযোগ এক বছর পর আমার সামনে আবার এলো কির্সতং মাউন্টের ট্রাভেল শো তৈরীর পরিকল্পনার হাত ধরে।
সে যাই হোক, তৃতীয় দিনের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার জন্যই কি-বোর্ড এ আঙ্গুল চালাচ্ছি। তৃতীয় দিন আমরা ক্যাম্প গ্রাউন্ড থেকে বের হয়ে হাঁটছি টোয়াইন খাল ধরে। আমরা জানি সামনে বড় বড় কুম পড়বে। কুম এড়িয়ে এগিয়ে যেতে হলে কুমের খানিক আগেই বাম পাশ দিয়ে উপরে উঠে যাওয়া পাহাড়ী রাস্তা ধরতে হবে। এই কুমময় এলাকার আরো খানিক আগে যখন আমরা পৌঁছলাম, তখন খালের একটা অংশ পার হওয়া নিয়ে অহেতুক চিন্তায় পড়ে গেলাম। চিন্তার উদ্রেকটা আমিই ঘটিয়েছিলাম খালের পাশেই একটা বাঁশের ভেলা পড়ে থাকতে দেখে। এমন ভেলায় করে কুম পার হওয়ার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। ভেলা দেখে মনে হলো আমার সেই ইচ্ছা হয়ত পূরণ হতে চলেছে। বেশ খুশির অনুভূতি হচ্ছিল। এই অংশে ভেলার আসলেই কোন দরকার ছিলনা তেমন, তবুও হাঁটু-কোমর পানিতে ভেলায় করে কিছুক্ষণ ভাবের সাথে ভাসলাম। ফারুক ভাই এ ভেসে বেড়ানোর কিছ শট নেওয়ায় আমিও কিছু সময় বেশিই পেলাম ভেসে থাকার জন্য। তখনও জানতাম না যে সামনে আমাকে আরও ডিউটি দিতে হবে।
এই পর্ব শেষ করে এগোতে থাকলাম সবাই। ঐ কুমময় এলাকায় পৌঁছানোর আগে খালের একটা খতরনাক জায়গা পার হতে হবে। মোটামুটি বুক পর্যন্ত হিমশীতল পানিতে নেমে খালের এপাশ থেকে ওপাশে যেতে হবে। তারিফ ভাইকে অনুসরণ করে খাল পার হয়ে পাথর বেয়ে উঠার আগেই নিয়ন্ত্রন হারিয়ে খাদে না, একেবারে পানিতে পড়ে গেলাম। সঙ্গে থাকা ব্যাগও পড়ল পানিতে। ব্যাগ তেমন না ভিজলেও যে পকেটে মোবাইল ছিল সেই পকেটটা ভিজে গিয়ে মোবাইলটাকে কোমায় পাঠিয়ে দেয় এবং আমার ছবি তোলাও অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। আমার স্মরনীয় কিছু মুহুর্তের ছবি তোলা হল না মোবাইল নষ্ট হবার কারণে।
মন খারাপ, সামনে এগোচ্ছি, তারিফ ভাই বলল কুমে আইসা পড়ছি। আমাদের সামনে কুমময় অঞ্চল। কেন কুমময় অঞ্চল বলছি বুঝা যাবে একটু পর। বাম পাশে সোজা উপরে উঠে গেছে কুম এড়ানোর রাস্তা। এই ক্লান্ত দেহে এমন খাড়া পথ দেখতে কারোরই সুখ বোধ হবার কধা নয়। ঐ পথ ধরে তারিফ ভাই এবং সানি ভাই আগেরবার অপূভাই এর অভিযানে সাথে গিয়েছিল। তাই তারিফ ভাই এর এই পথ চেনা। ফারুক ভাই গত দিন পড়ে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পাওয়ায় উনিও কুম এড়িয়ে যাবার পথের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। সিদ্ধান্ত হল আমরা কুম ধরেই এগোবো। ব্যাগ রেখে আমি আর তারিফ ভাই সামনের কুমটা পার হয়ে দ্বিতীয় কুমের সামনে এলাম। এতটুকু পথ গ্রামের মানুষদেরই করা। তারা এখানে মাছ ধরতে আসে। এরপর আমরা দুজন পাথর ধরে ধরে বেশ কায়দা করে সামান্যই সামনে এগোতে পারি। মুন্না ভাই দূরে উপরে দাঁড়িয়ে আমাদের রাস্তা দেখানোর চেষ্টা করছিলেন।
পায়ে হাঁটার পথ খুঁজে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম আমরা, যেখানে ফারুক ভাই আর সানি ভাই অপেক্ষা করছিল। আশ্চর্যজনক ভাবে এখানেও একটা বাঁশের ভেলা পাওয়া যায়। আমাকে বলা হল ভেলা নিয়ে কুম ধরে এগিয়ে যেতে। আমি আসলে এই মুহুর্তে এমন কিছুর জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। কুম নিয়ে আমার ভেতর একটা ভয়, অস্বস্তি সবসময় কাজ করে। কুমটা বেশ বড়, আমাকে একলা যেতে হবে, এইসব ভাবতে ভাবতে আমি ভেলায় উঠলাম।
ভেলা নিয়ে খানিক যেতেই বাঁশ দিয়ে নিচে ধাক্কা দিতে গিয়ে দেখি নিচে কিছু ঠেকছে না। ঐ মুহুর্তে অনুভূতিটা খুবই অদ্ভুত ছিল। অস্বস্তির ঠ্যালায় পড়ে বলেই ফেললাম যে আমি একলা যাইতে পারব না। পর মুহুর্তেই মাথায় এলো এমন সুযোগ কি তাহলে ভয় নামক অনুভূতির কাছে হেরে যাবে? ভেলা চালিয়ে কুম পেরোনোর গল্প কি শুধু অপূ ভাই আর ব্লগ গুলো থেকেই শুনে যাবো? ভেলার উপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, নীচে গভীর, সবুজ পানি। সবাইকে বললাম আমি ভেলা নিয়ে যাচ্ছি। অন্যরা আমার ব্যাগ নিয়ে এগোলো। এবার আমি একা চলছি। চলছে টোয়াইন খালে ভেলাভিযান আমার।
শরীর তো ছমছম করছে অনেকক্ষণ হল। ছমছমে শরীর নিয়েই থমথমে কুম ধরে ভেলা নিয়ে এগোচ্ছি। প্রতি মুহুর্তেই মনে হচ্ছে এই এখনই এলো, কি এলো?! হয়ত ড্রাগন, হয়ত বিশাল বড় এনাকোন্ডা। আমি টু শব্দ করার আগেই এরা আমাকে সবুজ পানির অতল তলে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাক, আসুক, দেখা যাবে- ভেবে সবুজ পানি কেটে বাঁশ চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ মনে হল- না, এভাবে বেপরোয়া ভাবে পানির নিচে বাঁশ চালালে যদি কারোর গায়ে লাগে!! সে যদি রাগ করে!!! এই সব ভাবনা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভেবে গেলাম। এইসব হাউ মাউ খাউ ভাবতে ভাবতে গলা ছেড়ে গান ধরলাম- ওরে ও পরানের মাঝি, আমার কথা লইও ওরে মাঝি আমার কথা লইও. . . ঝড় তুফান আইলেরে ডিঙ্গা কিনারে লাগাইও রে, আমার কথা লইও।
এর মধ্যেই প্রথম কুমের শেষ মাথায় এসে পড়েছি, দুই পাশের পাথর কাছাকাছি এসে পড়েছে, পানির স্রোত তীব্র হচ্ছে। গান গাইতে গাইতেই বেশ কায়দা কসরত করে ভেলা নিয়ে এগোচ্ছি জোর স্রোতের বিপরীতে। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার ভয় কেটে গেছে। এরপর তিন ঘন্টা ছিল শুধুই উপভোগ্য রোমাঞ্চ এবং ভেলায় করে দলবল নিয়ে কুম পাড়ি দেবার গল্প। সেই গল্প পরে আবার কোনদিন হোক।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।