আবার হেঁটে চলেছি জোঙ্গরির পানে গভীর গোপন অন্ধকারে। এই তো কিছুক্ষণ আগেও হেঁটেছি এরকম নির্জন অবয়বে। তখন ছিল সন্ধ্যার অন্ধকার আর এখন শেষ রাতের আঁধার। তখন ছিল সারা শরীরে মনে যুদ্ধ জিতে যাওয়ার ক্লান্তি ও নিশ্চিন্তি আর এখন শরীর মন খানিক ঘুমিয়ে বেশ তরতাজা। আকাশ যেন কালকের সারা দিনের তুষারপাতের ক্ষতচিহ্ন মুছে দিয়ে রাতের অন্ধকারে তারায় তারায় সাজিয়েছে নিজেকে। আবার সেই অবিরত তুষারপাত পাহাড়ের প্রতিটা খাঁজ, প্রতিটা কোণকে এই রাতের আঁধারে করে তুলেছে শুভ্রবসনা। সেই নীলাভ সাদা আলো সারা পাহাড় জুড়ে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা
এখন বোধহয় ভোর প্রায় চারটে। কাল জোঙ্গরি পৌঁছেছিলাম প্রায় রাত সাড়ে সাতটায়। যখন ক্লান্ত শরীরে কাল জোঙ্গরির ওপরের হাটে ঢুকলাম তখন শরীরে আর কিছু নেই। মোমবাতির আলোয় আবছায়া বন্ধুরা এক এক করে শুকনো জিনিস এগিয়ে দিচ্ছিল আর আমি ভাবছিলাম যে ভাগ্যিস আমার সঙ্গের ছোট স্যাকে ক্যামেরা থাকে বলে অন্য স্যাকে আমার জামাকাপড় রেখেছিলাম, যেটা পোর্টাররা আগেই নিয়ে পৌঁছেছিল। জুতোর ভেতরে বরফ ঢুকে ঠান্ডা জোলো কড়কড়ে, মোজা ২ টো পড়েছিলাম একসাথে, আমরা যে বাতিল ব্যাগ ব্যবহার করি তার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। পড়ার অযোগ্য হয়ে গেছিল ভিজে। বাকি সবকিছু প্লাস্টিকে মুড়ে স্যাকে ঢুকিয়ে চা খেয়ে স্লিপিং ব্যাগে। কোনোরকমে সেই নতুন ছেলেটিকে নিয়ে কাটুক ঢোকা পর্যন্ত চোখ খুলে রেখেছিলাম তারপর ‘সকালে ডাকিস আমি কিন্তু জোঙ্গরি টপ যাবই যাব’, বলেই ঘুম। কখন ওরা আমায় ডেকে রাতের খাবার খাইয়েছে মনে নেই।
তখনো সূর্য্য ওঠেনি
রাত সাড়ে তিনটেতে সবার হাঁকডাকে ঘুম ভাঙলো। সারা শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা। মটকা মেরে খানিকক্ষণ পরে রইলাম, তারপর ধুত্তোর বলে উঠে জ্যাকেট চাপিয়ে ভেজা জুতো পরে সটান বাইরে। তারপর থেকে ঘোরের মধ্যে চলেছি। আমাদের হাটের প্রায় পেছন দিয়েই ট্রেইল ওপরে উঠছে। আমার হেড ল্যাম্প নেই, কাটুকের পেছন পেছন অন্ধের মতো চলেছি। রাতের তারারা আর পাশের নীলাভ সাদা আলো পথ দেখাচ্ছে আমায়। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম আগের দুবারের কথা। এই ২০১৪ তেও পরিষ্কার মনে আছে ২০০৩ সালের কথা। একেবারেই অনভিজ্ঞ আমরা এরকম রাতের বেলা রওনা হয়েছিলাম জোঙ্গরি টপে। তখন হেড ল্যাম্পও ছিলনা, হাতে টর্চ নিয়ে টলমল করে এগোচ্ছি। উঠতে উঠতে, কখনো হামাগুড়ি দিতে দিতে পৌঁছেছিলাম টপে। তখন আকাশ ফ্যাকাসে সবে, ওখানে একটি বিদেশী ছেলে আর মেয়ে শুধু আমাদের আগে পৌঁছেছিল। অদ্ভুত, অবাক হয়ে দেখেছিলাম ওই মেয়েটি আমাদের স্কুলে যাওয়ার অ্যালুমুনিয়ামের সুটকেসের থেকে এক এক করে কাঁচের চারকোণা টুকরো বের করছে। আর ওই তীব্র ঠান্ডায় এঁকে চলেছে অপূর্ব সব দৃশ্য। আমরা দাঁড়াতে পারছিলামনা ওই ঠান্ডায়, তখন জামাকাপড়ও এতো ঠিকঠাক ছিলনা, আর মেয়েটি একমনে ওই সূর্যোদয় এঁকে চলেছিল তুলির সূক্ষ্ম টানে। তারপর ২০০৮ এ তো সেই বিবাহবার্ষিকীর ভোজ খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে ভোরে কোনোরকমে উঠেই দে দৌড়।
ব্ল্যাক কোবরু
এসব ভাবছি, আর হাঁটছি কাটুকের পেছন পেছন। ২০০৩ এ রাতে যখন এই রাস্তা দিয়ে গেছিলাম তখন কিছুই জানতামনা। অন্ধকারে বোঝাও যাচ্ছিলনা। গাইডের পেছন পেছন গেছিলাম। কোথাও কোথাও গাইড বলেছিল বলে হামাগুড়িও দিয়েছিলাম। ফেরার সময় সকালের আলোয় সব দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছিলো। ওরে বাবা, এই রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে? এ তো সরু রিজ, দুপাশে ঢাল কতদূর নেমে গেছে!!! আর কোনোদিন আমি যাবনা এই রাস্তায়, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। ২০০৮ এ তো ভোজ খাওয়ার আনন্দে ভোরে উঠে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। খানিকদূর যেতেই যখন রাতের অন্ধকারেও ওই সরু রাস্তাটা আন্দাজ করতে পারলাম, তখন আবার আত্মারাম খাঁচাছাড়া!! কি করব, একা তো আর ফিরতেও পারবনা, চলেই গেলাম সেবারও!! এবার আবার!! বারবার তিনবার। রাতে অতো কষ্ট নিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার সময় কেন জানিনা এই রাস্তার কষ্টের কথা মাথায় ছিলোনা তাই বলে ফেলেছিলাম আমি যাবোই- এখন আফসোস!!
যাক চলেছি অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে। মনের মধ্যে আরেকটা জিনিস খচখচ করে বিঁধছে। কাল ওই বিপর্যয়ে পরে জামাকাপড় তো বেঁচেছে, কিন্তু ক্যামেরা? ভোররাতে উঠে ক্যামেরা ঠিক আছে কিনা দেখতে গিয়ে দেখলাম শাটারই পড়ছেনা! সবাই বললো ঠান্ডায় আর কালকের বরফের জন্য। আমিই আমাদের গ্রুপের স্টাফ ফটোগ্রাফার। ক্যামেরা বিগড়োলে তো সব ছবি গেল? এই রাতে বেরিয়েছি ক্যামেরা রেখেই। ছবি পাবনা এই সূর্যোদয়ের, সে তাও সহ্য হবে, কিন্তু একেবারেই খারাপ হলে? বাকি পুরো রাস্তার ছবি? মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে হেঁটে চলেছি টপের দিকে।
ওই দেখা যায়..
জোঙ্গরি টপের একটা অদ্ভুত মজা আছে। সামনেই পূর্বদিকে ছোট ছোট পাহাড় সূর্যোদয়ে আটকে দেয় ফলে ভালভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা, পান্ডিম এগুলোর ওপর আলোর নাচন বোঝা যায়না। এই টপের অবস্থানটা এমনই যে কোনাকুনি বিখ্যাত সব পাহাড়গুলো দেখা যায়, বোঝাও যায় কিন্তু পাহাড়ের ওপর সূর্যের খেলা দেখা যায়না। কিন্তু মজাটা হলো এখান থেকে যা দেখা যায় তা আবার অন্য কোনো টপ থেকে সূর্যোদয়ের সময় দেখা যায়না। আলোআঁধারী, অদ্ভুত এক চরাচর জোড়া আলো, মায়াবী এক সকাল নেমে আসে এখানে।
ভাবতে ভাবতে, বিড়বিড় করতে করতে উঠে এসেছি অনেকটা। এখান থেকে সেই রিজটা শুরু। সোজা এগিয়ে যেতে হবে। খুব উঁচুনিচু আর নেই কিন্তু সরু এক ট্রেইল। আকাশ অল্প পরিষ্কার হয়েছে। সাদা বরফ জমা জুনিপারের ঝোপ নিচে নিচে। চলেছি মোহাবিষ্টের মত। আস্তে আস্তে আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে। ওই তো বাঁকটা নিয়ে ওপরে উঠলেই জোঙ্গরি টপ! উঠে এলাম ধীরে ধীরে। কিছু মানুষ এসে গেছেন। ওই মোটামুটি আমাদের নিয়ে ১০-১২ জন। পেছনে ছোটছোট পাহাড় পূর্বে সূর্যকে খানিক আটকে দিয়ে অদ্ভুত এক স্যিলুয়েটের সৃষ্টি করেছে আর সামনের দিকে সব বিখ্যাত পর্বত আবছা সূর্যালোক নিয়ে একে একে চোখের সামনে ফুটে উঠছে। ওই তো কাঞ্চনজঙ্ঘা একটু পেছন দিকে দেখা যাচ্ছে। তার বাঁপাশে পান্ডিম। তারও অন্যপাশে কোবরু, কোবরু ডোম, ব্ল্যাক কোবরু, নরসিংহ সব একে একে উঁকি মারছে। আস্তে আস্তে কমলা রং আকাশ ছাইছে। নিচে জলভরা মেঘের ওপর তার এক অসম্ভব সুন্দর প্রতিফলন। আলোয় চারিদিক ক্রমে উদ্ভাসিত। ক্রমশ বরফ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে আলো, তাকিয়ে থাকা যাচ্ছেনা। শুরু হলো অসম্ভব ঠান্ডা হাওয়া, এলোমেলো তীব্র হাওয়ায় আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছেনা। হাত গ্লাভসসহ পকেটের মধ্যে। ধীরে ধীরে নামতে হবে এবার। জোঙ্গরির চারপাশে তখন শুধু নামজাদা পাহাড়ের ভিড়। ধীরে ধীরে নামছি, আর পেছন ফিরে দেখছি। ‘ আজ এক নতুন সূর্যোদয়; অতীতের লেবাস ঝরে গেছে মুহূর্তেই, আলোর সোনালী আঙুল আর ঘুম জড়ানো চোখের সাথে সাথে।’ নেমে আসছি আর চোখের সামনে ক্রমশঃ ফুটে উঠছে সুন্দরী জোঙ্গরি তার বরফমাখা আঁকবাঁক, পাথরমোড়া সর্বাঙ্গ নিয়ে।
বিঃ দ্রঃ ফিরে ক্যামেরা সচল পেয়েছিলাম। জোঙ্গরি টপের সব ছবিই ২০০৮ এর, ক্যামেরা সাথে ছিলনা ২০১৪ তে, আগেই বলেছি আর ফিরে ক্যামেরা সচল পেয়ে জোঙ্গরি সুন্দরীর ছবি তুলেছি ২০১৪ তে।
চলবে …
পূর্ববর্তী পর্বগুলো পড়ুন এখানে
গোচা লা ট্রেকঃ পিনাকেতে লাগে টঙ্কার (পর্ব ১)
গোচা লা ট্রেকঃ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে (পর্ব ২)
গোচা লা ট্রেকঃ নেড়া আবার বেলতলায় (পর্ব ৩)
গোচা লা ট্রেকঃ সন্ধ্যে যেখানে রাত্রির সন্ধানে (পর্ব ৪)
গোচা লা ট্রেকঃ কোকচুরাঙ ছুঁয়ে থানসিং (পর্ব ৬)
গোচা লা ট্রেকঃ ধূসর রূপের পান্ডিম (পর্ব ৭)
গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)
গোচা লা ট্রেকঃ ফিরে চলা ঘুম ঘুম রূপকথা ছেড়ে (শেষ পর্ব)
লিখেছেনঃ শুভময় পাল। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স শুভময়ের প্রিয় জায়গা। অজানা, অচেনা জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘোরা নেশা শুভময়ের।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।