‘চন্দ্রমালা, রাজকন্যা, মুখ তুলে চেয়ে দেখ- শুধাই, শুন লো,
কি গল্প শুনিতে চাও তোমরা আমার কাছে,- কোন গান বলো,
আমার সোনার খাঁচা খুলে দাও, আমি যে বনের হীরামন;

রাজকন্যা শোনে নাকো- আজ ভোরে আরশিতে দেখে নাকো মুখ,
কোথায় পাহাড় দূরে শাদা হয়ে আছে যেন কড়ির মতন, –
সেই দিকে চেয়ে- চেয়ে দিনভোর ফেটে যায় রূপসীর বুক’

প্রেকচু, কোকচুরান- স্বপ্নের অন্য নাম

শুভ্র নীল আকাশের কোলে উজ্জ্বল পান্ডিম আর কাঞ্চনজঙ্ঘার ঘুম ঘুম রূপকথা ছেড়ে শুরু হল আমাদের বিষণ্ণ ফিরে চলা । সবাই আনমনা, চুপচাপ চলেছি। পেছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা নির্নিমেষ তাকিয়ে আমাদের দিকে। আমরা হাঁটছি আর পেছন ঘুরে ঘুরে দেখছি। এই লালচে স্বপ্নের বিস্তার, ওই সুনীল আকাশ আর দুধসাদা পাহাড়, সব ছেড়ে আজ আমাদের ফিরে চলা । ২০০৮ এ আমরা সমিতির পরে এগোতে পারিনি। এবার আমরা গেছি তারও পরে, কিছুটা আনন্দ আর অনেকটা ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘা বুকে নিয়ে এক আকাশ মন খারাপ নিয়ে পেরোচ্ছি ছোট্ট খোলা, টপকাচ্ছি পাথুরে পথ। প্রতিবারের মতো এবারও নিচ্ছি মিষ্টি শপথ, আবার আসিব ফিরে।

পেরোলাম থানসিং, পৌঁছলাম সেই অবাক করা জঙ্গলে। আজও বরফ ঝুলে আছে গাছে, বয়ে চলেছে চারিদিকে ছোট ছোট সোঁতা, ঘন দীর্ঘ পাইন বুকে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে আশ্রয় দিয়েছে শ্যাওলা-মসকে। যাওয়ার সময় এগুলো দেখেছি নতুনকে দেখার আনন্দে, ফিরে চলা র সময় এদেরকেই দেখছি স্বজন হারানোর বেদনায়। বেলা যে পড়ে এলো, পা চালাতে হবে এবার।

উঁকি মেরেছিলো পান্ডিম

এই বিষন্ন মনের সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশেও ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। জঙ্গল পেরিয়ে প্রেকচুর সামনে দাঁড়িয়ে। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে মন খারাপ বয়ে নিয়ে আসছে সেও। উত্তাল ঢেউ, বিপুল জলরাশি চলেছে কুল ছাপিয়ে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই, পেছনদিকে তাকিয়ে দেখি মেঘ ছুঁয়েছে গাছ। বিষন্নতা ছড়িয়ে পড়েছে বিন্দু বিন্দু সমস্ত কোকচূড়ান জুড়ে। পৌঁছলাম কোকচূড়ান, আজ এখানেই থাকা। ওই স্বপ্নের তপোবনে, হলুদ পাথর জলের তলায়, সবুজ শ্যাওলা মাখা ঘাস, মাটি, ছোট্ট কাঠের সাঁকো, প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে। উঠে এলাম বারান্দায়, কান্নায় ভেঙে পড়লো আকাশ। আশ্রয় নিলাম বড় লম্বা টানা ঘরটায়। কাঁচের জানালা, ভিজে কোকচূড়ান। প্রেমে পড়লাম আবার।

গোলাপী গুরাস

২০০৮ এ যেহেতু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছিলাম তাই কোকচূড়ান পৌঁছেছিলাম বেশ আগে, আকাশ সেদিনও ছিল বিষন্ন, কিন্তু কান্নায় ভেঙে পড়েনি, অভিমানে থমথমে মুখে জরিপ করছিলো আমাদের। ওই কাঠের ব্রিজের পাশে বসেছিলাম বহুক্ষণ। আশীষদা প্রসাদ বানিয়ে সবাইকে বিতরণ করেছিল। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমেছিল কোকচূড়ান এ, সেই প্রথমবার ভালোবেসেছিলাম।

কুয়াশা ঢাকা মোনাস্ট্রি- সোকা

এবার সেই বৃষ্টি চলতেই থাকলো। পান্ডিম মাঝে উঁকি দিয়েছিল, আবার অভিমানে চলে গেলো মেঘের আড়ালে। ২০০৮ এ এই ট্রেকার্স হাট ছিল বেশ সুন্দর, প্রায় নতুনের মত। ২০১৪ তে তার বেশ দৈন্যদশা। অনেক গল্পকথা এই হাট ঘিরে। যদিও আমরা কোন ভূতের উপদ্রব পাইনি। সারারাত কেটে গেছে গল্পে, গানে। পরদিন ভোর। মন খারাপ একটু কম। কোকচূড়ান তার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিলো সারারাত। এখান থেকে আর জোঙ্গরি হয়ে ফিরতে হয়না। সরাসরি এক রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে ফেদাঙ। ২০০৮ সালেও এই রাস্তায় প্রচুর শক্ত হয়ে যাওয়া, গলে যাওয়া বরফ পেয়েছিলাম, এবারও তাই। খুব সাবধানে, কোথাও বা সরসরিয়ে স্লিপ কেটে পৌঁছলাম ফেদাঙ। সেখান থেকে সোকা। সারাটাদিন আকাশ মেঘে ঢাকা, সোকার রাস্তা, মনাস্ট্রি কুয়াশায় মুখ লুকিয়ে। এক জাপানি ভদ্রলোককে দেখলাম একটি ছোট টিলায় ধ্যানমগ্ন। ছোট্ট খাওয়ার জায়গা, মেঘ, কুয়াশা, তোম্বা আর আগের দুবারের স্মৃতিচারণে সোকার রাত মায়াবী।

মন খারাপের দিস্তা- এলাম সোকা

পরদিন নেমে যাব ইয়াকসাম। সারাটা রাস্তা আশীষদা ছুঁয়ে ছিল আমাদের। আমরাও ছুঁয়ে ছিলাম আশীষদাকে। মন কেমনেরও একটা মাধুর্য্য থাকে, সব গল্পেরই থাকে শেষ। শুধু শেষেরও একটা শেষ থাকে, তাই দিয়েই এ বিশাল ঘ্যানঘ্যানে স্মৃতিচারণের রেশটুকু টেনে চলে যাব। যেহেতু পরদিন ইয়াকসাম নেমে যাব, তাই সোকাতেই হলো বড়াখানার আয়োজন। মানে ওই আমরা, পোর্টার গাইড সবাই মিলে একটু খাওয়াদাওয়া আর স্মৃতিচারণ। কাটুক, আমাদের গাইড, আগেই একটু টালমাটাল ছিল, ওকে যখন সন্ধেবেলা আমাদের সাথে আড্ডা মারতে বলা হলো, ও একটা কথাই বারবার বলছিলো ‘লেকিন ম্যায় এক বাত বলনা চাহাতা হুঁ, আপলোগ বহত আচ্ছে হো’। আমরা কতটুকু ‘আচ্ছা’ জানিনা, এই মানুষটা যে বহতই ‘আচ্ছা’ সেটা সন্দেহাতীত সত্য।

‘অবিরল ঘাস শুধু ছড়ায়ে র’য়েছে মাটি কাঁকরের ‘পর,
খড়কুটো উল্টায়ে ফিরিতেছে দু’একটা বিষন্ন চড়াই,
অশ্বত্থের পাতাগুলো প’ড়ে আছে ম্লান শাদা ধুলোর ভিতর;
এই পথ ছেড়ে দিয়ে এ-জীবন কোনোখানে গেলো নাকো তাই’

অন্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে

গোচা লা ট্রেকঃ পিনাকেতে লাগে টঙ্কার (পর্ব ১)
গোচা লা ট্রেকঃ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে (পর্ব ২)
গোচা লা ট্রেকঃ নেড়া আবার বেলতলায় (পর্ব ৩)
গোচা লা ট্রেকঃ সন্ধ্যে যেখানে রাত্রির সন্ধানে (পর্ব ৪)
গোচা লা ট্রেকঃ জোঙ্গরির রাত-ভোর (পর্ব ৫)
গোচা লা ট্রেকঃ কোকচুরাঙ ছুঁয়ে থানসিং (পর্ব ৬)
গোচা লা ট্রেকঃ ধূসর রূপের পান্ডিম (পর্ব ৭)
গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)

লিখেছেনঃ শুভময় পাল। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স শুভময়ের প্রিয় জায়গা। অজানা, অচেনা জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘোরা নেশা শুভময়ের।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)
বর্ষায় ভ্রমণেবর্ষায় ভ্রমণে সাবধানতা

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)
বর্ষায় ভ্রমণেবর্ষায় ভ্রমণে সাবধানতা

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)
বর্ষায় ভ্রমণেবর্ষায় ভ্রমণে সাবধানতা

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!