মুহুরী প্রকল্প। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে অবস্থানের কারণে এক সময় বর্ষা মৌসুম এলেই প্লাবিত হতো ফেনী জেলার ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, ফুলগাজী, সোনাগাজী এবং চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার কিয়দংশ। বর্ষায় প্লাবন আর আকস্মিক জলোচ্ছ্বাসের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পাবার লক্ষ্যে এবং সেচ নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মুহুরী নদীর মোহনা -র কাছেই ১৯৭৭-৭৮ অর্থ বছরে শুরু হয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প মুহুরী প্রকল্প

ফেনী নদী, মুহুরী নদী এবং কালিদাস পাহালিয়া নদীর মিলিত প্রবাহকে আড়ি বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ৪০ ফোক্ট বিশিষ্ট একটি বৃহদাকার পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরী করে এই এলাকায় বন্যার প্রকোপ কমানো ও অতিরিক্ত সেচ সুবিধা প্রদানের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল মুহুরী সেচ প্রকল্পের। এর সুবিধা এখন ভোগ করছেন সেখানকার অধিবাসীরা এবং সেই সাথে সারা দেশের মানুষ কারণ এই প্রকল্পের জন্যেই এই এলাকা পরিণত হয়েছে একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকায়।

গুগল ম্যাপে মুহুরী প্রকল্পের অবস্থান। 

মুহুরী প্রকল্প, অদূরে বায়ুকল। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

ঢাকা থেকে ফেনী হয়ে যখন সোনাগাজিতে মুহুরী বাঁধের ওপর পৌঁছালাম, দিগন্ত রেখায় বঙ্গোপসাগরের আভাস দেখে মুহূর্তে মিলিয়ে গেল পথের সব ক্লান্তি। বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে প্রবাহমান পানির স্রোতের দিকে তাকিয়ে থেকেই যেন কাটিয়ে দেওয়া যাবে অনন্তকাল। ভীষণ বেগে তিন নদীর সম্মিলিত প্রবাহ বাঁধ পেরিয়ে ছুটে চলছে সমুদ্রের পানে, এক মুহূর্ত তার তর সইছে না, নেই এক মুহূর্তের বিশ্রাম। মুহুরী নদীর মোহনা -য় পানির স্রোতের সম্মোহন কাটিয়ে মত্ত হয়ে গেলাম ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন ফাঁদ পেতে মাছ ধরার দৃশ্যে। এই প্রকল্পের চারপাশেই গড়ে উঠেছে মাছ চাষ প্রকল্প আর প্রায়শই ঘেরের পাড় ভেঙ্গে বা স্রোতে ভেসে আসা মাছ ধরার আশায় জাল পেতে অপেক্ষা করে স্থানীয়রা।

মুহুরী নদীর ওপরে বাঁধ। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ।

হাঁটতে শুরু করলাম বাঁধের ওপর দিয়ে। পা ফেলছি আর ভাবছি যখন এই বাঁধ ছিলনা প্রমত্তা নদী দুকূল ভাসিয়ে পৌঁছাত তার শেষ গন্তব্য সমুদ্রে, সাথে নিয়ে যেত দুপাড়ের মানুষের আশা ভরসা, আর হাহাকার। আজ বাঁধ দেওয়ার ফলে সেই হাহাকারের জায়গায় আজ নদী শুনতে পায় দুপারের মানুষের আনন্দ উল্লাস। বাঁধটা পেরোলেই আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে ইট বিছানো এবড়ো থেবড়ো পথ যার দুপাশ জুড়ে রয়েছে গাছের সমাহার। মনে হবে যেন এই বন্ধুর পথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে উপলব্ধি করা যাবে জীবনের অনেক না জানাকে। দক্ষিণে বিস্তীর্ন মাঠ এবং বন বিভাগের সবুজ বেষ্টনী রয়েছে। বাঁধ পেরিয়ে নীচের দিকে নামলেই নদীর ধার ঘেঁষে বানানো হয়েছে কিছু বসার জায়গা। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে দুদণ্ড এখানে বসে জিরিয়ে নিতে পারবেন।

দর্শনার্থীদের জন্য এখানে রয়েছে অস্থায়ী কিছু দোকান যেখানে আপনি পাবেন জনপ্রিয় চটপটি, ফুচকা বা ঝালমুড়ি মাখা। সবুজ কচি ডাব দেখে আর লোভ সামলানো গেলনা। মাত্র ২৫ টাকায় একটি ডাব খেয়ে প্রাণ জুড়ালাম। ডাবের সাথে বাড়তি হিসাবে পেলাম ডাবের মালাই। সবুজ গাছ গাছালিতে পূর্ণ এই জায়গায় কিছুক্ষণ প্রাণ ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে উঠে বসলাম ঘাটে বাঁধা নৌকায়। মুহুরী নদীর বুকে ভেসে চলছে নৌকা আর তাকিয়ে দেখছি চারপাশের প্রকৃতি আর জীব বৈচিত্র্য। পাখিপ্রেমীদের জন্য আদর্শ গন্তব্য মুহুরী প্রকল্প। এখানে প্রায় একশোরও বেশি দেশি প্রজাতির পাখি ছাড়াও অতিথি পাখিরও দেখা মেলে। পাখির ছবি তুলতে চাইলে খুব ভোরে পৌঁছাতে হবে মুহুরি প্রকল্পে।

মুহুরী নদীর তীর ঘেঁষে একটু খানি বিশ্রামের জায়গা। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

মুহুরী নদীতে নৌভ্রমণ। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

এখানকার জলাশয়ে আছে হাজার হাজার পাখি। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

বিভোর হয়ে উপভোগ করছিলাম সবুজ প্রকৃতি আর পাখিদের কলকাকলি, কিন্তু এক সময় পেট জানান দিল ক্ষুধা লেগেছে। বাঁধের দুই পাশেই রয়েছে বেশ কিছু খাবার হোটেল। এখানে সাশ্রয়ী মূল্যে পাবেন বিভিন্ন ধরণের খাবার। পাবেন নদীর বা ঘেরের নানান জাতের তাজা মাছ। স্থানীয়দের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে মৎস্য চাষে বিপ্লব ঘটিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় মৎস্য চাষ এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এ মুহুরী প্রজেক্ট এলাকা। বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য প্রকল্প গড়ে তুলেছে অনেকেই। স্থানীয়রা সবাই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মৎস্য প্রকল্পের সাথে জড়িত। পরিচিত একজনের মৎস্য চাষের ঘেরে গেলাম। সেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষ করা হয়।  প্রতিদিন ১০০ টনেরও বেশি মাছ এ এলাকা থেকে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, পার্বত্য এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়। এ অঞ্চলের মানুষের শতভাগ মাছের চাহিদা পূরণ করে মুহুরী প্রকল্প থেকে। তাই বেড়াতে গেলে মাছ খেতে ভুলবেন না যেন।

মুহুরী সেচ প্রকল্প। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

মুহুরী সেচ প্রকল্পের মাত্র ৫০০ গজ দূরে খোয়াজের লামছি গ্রামে দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অবস্থিত। ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলেও অল্প কিছুদিন চলার পর নানা অজুহাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলেও বায়ুকল কিংবা উইন্ডমিল গুলো তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। গোধূলির  শেষ আলোয় দিগন্ত রেখার সাথে তাল মিলিয়ে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে বায়ুকলগুলো। আর তাই মুহুরী প্রকল্পে গেলে সূর্যাস্ত না দেখে ফেরাটা ঠিক হবে না।

সূর্যাস্তে মুহুরী সেচ প্রকল্পের রূপ। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

বাংলাদেশের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন কেন্দ্ৰ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে মুহুরী প্রকল্প এলাকা। বহুল প্রচলিত পর্যটনস্থল গুলোতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় এড়াতে অনেকে খুঁজছেন নতুন নতুন ভ্রমণ গন্তব্য। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মাঝে অবস্থানরত এই মুহুরী প্রকল্প হতে পারে এক আদর্শ পর্যটনস্থল। এখানে এলে পাবেন আদিগন্ত জলরাশির বিপুল স্রোতের খেলা, সবুজ গাছ গাছালি, হাজার নাম না জানা পাখির কলতান। আশে পাশের মাছের ঘেরগুলোর সৌন্দর্যও দেখার মত। একটি বেলা মুহুরী নদীর ধারে শুয়ে, বসে, নদীতে নৌকায় ভেসে কাটিয়ে আবার ফিরে যাবেন ব্যস্ত নাগরিক জীবনে।

মুহুরী প্রকল্পে যেতে হলে ঢাকা থেকে সরাসরি ফেনীর বাস ধরতে পারেন। ড্রিম-লাইন, স্টার-লাইন ইত্যাদি বাস পাবেন সায়দাবাদ থেকে। ভাড়া ৩০০ থেকে ৩৮০ টাকা। নামবেন মহীপালে। আবার চাইলে চট্টগ্রামগামী বাসেও উঠতে পারেন, বারইয়ার হাট নেমে যেতে পারেন, এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বাস ভাড়া দিতে হবে। এছাড়া কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী যে কোন ট্রেনে আপনি যেতে পারেন। নেমে যাবেন ফেনী রেল স্টেশনে।
ফেনী থেকে মুহুরী প্রজেক্ট যাবার উপায় দুটি:
১) ফেনী লালপোল হতে বাস যোগে (মিল্লাত পরিবহন, ফারাবি ট্রান্সপোর্ট, জয় পরিবহন, প্রতিশ্রুতি পরিবহন ইত্যাদি) হয়ে সোনাগাজী উপজেলা সদর পর্যন্ত যাবেন। অত:পর সোনাগাজী উপজেলা সদর হতে বাস যোগে বাদামতলী পর্যন্ত যেতে হবে। তারপর বাদামতলী হতে রিক্সায় করে দর্শনীয় স্থানে পৌঁছান যায়।
২) ফেনী মহীপাল মোড় হতে সিএনজি অটোরিকশায় করেও দর্শনীয় স্থানে যাওয়া যায়।
রাস্তা পুরোটাই ভালো তবে বাঁধ এলাকা শুরু হবার পূর্বে বেশ খানিকটা রাস্তা ভাঙ্গা। মুহুরী প্রকল্পকে পর্যটন বান্ধব করতে অতিসত্বর রাস্তা মেরামত করা প্রয়োজন।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

ক্যাসপারের জংলী বাবাক্যাসপারের জংলী বাবা
তুলোর প্রাসাদ, পামুক্কালেতুলোর প্রাসাদ, পামুক্কালে

About the Author: Aoezora Zinnia

সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস এন্ড ফিস ব্রীডিং বিভাগে কর্মরত আওজোরা জিনিয়া ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। একসময় প্রবাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত জিনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছেন অসংখ্য দেশ। পর্বতারোহণ নিয়েও রয়েছে তার দারুণ দারুণ সব স্বপ্ন। আর সেই পথ ধরেই তিনি ছিলেন মাউন্ট বাটুর, মাউন্ট ফুজি, মাউন্ট কানামো সহ বিভিন্ন পর্বতারোহণ অভিযানে। বনের সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়, ঝিরি, ঝর্ণার প্রতি তীব্র ভালোবাসার টানে সুযোগ পেলেই ছুটে বেড়ান থেকে পাহাড়, প্রান্তর থেকে প্রান্তর, বুনোপথ থেকে বুনোপথে।

Sharing does not make you less important!

ক্যাসপারের জংলী বাবাক্যাসপারের জংলী বাবা
তুলোর প্রাসাদ, পামুক্কালেতুলোর প্রাসাদ, পামুক্কালে

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

ক্যাসপারের জংলী বাবাক্যাসপারের জংলী বাবা
তুলোর প্রাসাদ, পামুক্কালেতুলোর প্রাসাদ, পামুক্কালে

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!