অবাক করা ছোট ছোট কিছু লেক এই জায়গাটিকে করে তুলেছে আকর্ষণীয় এক ভ্রমণ গন্তব্যে। তুর্কি ভাষায় পামুক্কালের অর্থ হল তুলোর প্রাসাদ। দূর থেকে এই তুলোর প্রাসাদ, পামুক্কালে জায়গাটিকে দেখলে মনে হয় যেন তুলা দিয়ে বানানো এক শ্বেতশুভ্র প্রাসাদ। তুরস্কের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের দেনিজলি প্রদেশে মেন্দেরেস নদীর উপত্যকার সবুজ প্রান্তরের মাঝে, হিয়েরাপোলিসের ধ্বংসাবশেষের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এই তুষার-শুভ্র পামুক্কালে। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে।
খুব ছোটবেলায় যখন কোন একটা ভ্রমণ বিষয়ক পত্রিকায় পামুক্কালের ছবি দেখি, ভেবেছিলাম এটা মনে হয় বরফে ঢাকা কোন জায়গা। উষ্ণ আবহাওয়ার দেশের মানুষ হওয়াতে সেই শৈশব থেকেই স্বপ্ন ছিল এক সময় এই বরফে ঢাকা জায়গাটা তে বেড়াতে যাবার। একটু বড় হয়ে যখন জানলাম এটা আসলে বরফের জায়গা নয়, বরং সাদা রঙের খনিজ লবণ ক্যালসিয়াম কার্বনেটের স্তর তখন এটি দেখার আগ্রহ যেন বেড়ে গেল আরও বহুগুণে। অবশেষে এক দিন হাজির হয়ে গেলাম পামুক্কালের ছোট্ট ছোট্ট লেক গুলোর সামনে।
হিয়েরাপোলিসের ধ্বংসাবশেষ পার হয়ে যখন পামুক্কালেতে লেক গুলোর সামনে দাঁড়ালাম, কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝতেই পারছিলাম না প্রাচীন রোম সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পেরিয়ে এ কোন স্বপ্নের জগতে এসে পৌঁছলাম। যতদূর দৃষ্টি যায় সাদা বরফের মত পাহাড়, কিছু কিছু জায়গায় জমে যাওয়া ঝর্ণা, আর স্তরে স্তরে টেরাসের বেসিনে জমে আছে নীল পানি, তৈরি করেছে ছোট ছোট নীল লেক। চেনা জগতের কোন কিছুর সাথেই মিল নেই এই জায়গার। মনে হল যেন স্বপ্নে চলে গেছি অচেনা, অজানা এক রাজ্যে। খেয়াল করলাম এক পাশে অনেক ভীড় পর্যটকদের। সেখানে সবাই পা ভেজাচ্ছে খনিজ পানিতে। অতি আগ্রহী কেউ কেউ গোসলও করছে।
পামুক্কালের টেরাসের বেসিনের নীল পানিতে দর্শনার্থীদের ভিড়। ছবি: ড. জিনিয়া রহমান।
এত ভীড় দেখে আমি অপেক্ষাকৃত নির্জন অংশটির দিকে হাঁটতে থাকলাম। ছোট্ট একটা পার্ক পেরিয়ে সামনে কিছু বসার জায়গা পেলাম। সেখানে কিছুক্ষণ বসে উপভোগ করলাম জায়গাটা। এর পরে আরও একটু সামনে আগাতেই দেখি দারুণ সুন্দর কিছু লেকের টেরাস, কিন্তু সেখানে কোন দর্শনার্থী নেই। সেটা দেখে আমি মনের আনন্দে কিছুক্ষণ সেই টেরাসগুলোতে পা ভিজিয়ে বেড়ালাম।
মনে হচ্ছিল যেন আমি আমার শৈশবে ফিরে গিয়েছি, যেখানে অন্য কোন ভাবনা নেই, যেখানে এক শ্বেত শুভ্র রাজ্যের রাজকন্যা আমি। একটু পরে বাঁশীর শব্দ শুনে কল্পনা থেকে ফিরে এলাম বাস্তবে। এক পুলিশ অফিসার বাঁশী বাজিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। ফিরে গিয়ে শুনলাম এই এলাকা দর্শনার্থীদের জন্য নিষিদ্ধ। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়তে পারে সেই অংশ তাই সেটা আলাদা করে রাখা হয়েছে। তুলোর প্রাসাদ পামুক্কালের সৌন্দর্যে বিমোহিত আমি খেয়ালই করিনি যে এই অংশটা আলাদা করে রাখা।
ধীরে ধীরে ক্যালসিয়াম কার্বনেট জমে জমে তৈরি হয়েছে পামুক্কালে। ছবি: ড. জিনিয়া রহমান।
পামুক্কালের বিস্তীর্ণ জলাভূমি পাললিক শিলা দ্বারা নির্মিত। যার ঢেউ খেলানো আকৃতির মধ্যে বৃষ্টির জল টলমল করে চলে অনবরত। এই লেকগুলো প্রায় ২০ লাখ বছরের পুরনো। বহু বছর আগে এখানে ভূমিকম্পে মাটিতে ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ফাটল দিয়ে মাটির নিচের ক্যালসিয়াম কার্বনেটে ভর্তি গরম পানি বেরিয়ে এসে উপরে জমা হত। পানি বাষ্প হয়ে গেলে শুধু ক্যালসিয়াম কার্বনেটের স্তর জমা হত। ধীরে ধীরে ক্যালসিয়াম কার্বনেট জমে জমে তৈরি হয় লেকগুলোর কাঠামো আর সেখানে বৃষ্টির পানি জমে সৃষ্টি হয় সাদা লবণের বিশাল বিশাল স্তরে ছোট্ট ছোট্ট জলাধার।
বিশ্বাস করা হয় যে এই লেকগুলোর পানিতে গোসল করলে কোন রোগ হয়না এবং যৌবন ধরে রাখা যায়। হাজার বছর ধরে পামুক্কালের জলে মানুষ গোসল করে আসছে। গাইডের মুখে শোনা, যে মিশরের রানীরা এইসব লেক থেকে পানি নিয়ে গোসল করতেন। তবে পরিবেশ রক্ষার্থে এখন অল্প কিছু লেকে গোসল করা যায়। বাকিগুলোতে গোসল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পানির নিচের জমা হওয়া পলিকে ক্ষতিসাধনের হাত থেকে রক্ষার জন্যে পামুক্কালের জলধারায় জুতা পরে নামা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পামুক্কালে, জনপ্রিয় এক ভ্রমণ গন্তব্য। ছবি: ড. জিনিয়া রহমান।
হাজার বছর ধরে লবণের স্তর জমে তৈরি হয়েছে পামুক্কালে। ছবি: ড. জিনিয়া রহমান।
পামুক্কালের ছোট ছোট নীল লেকদের সাথে লেখিকা
পামুক্কালের টেরাস থেকে শহরের দৃশ্য। ছবি: ড. জিনিয়া রহমান।
খনিজ পানির লেকগুলো থেকে কিছু খনিজ মেশানো পানি নিয়ে এসেছিলাম যদি রোদে পোড়া চামড়াটা কিছুটা ঠিক করা যায় এই আশায়। তবে শুধু পানিই নয়, সাথে আরো নিয়ে এসেছি তুলোর প্রাসাদ পামুক্কালের অমূল্য কিছু মুহূর্তের স্মৃতি, ব্যতিক্রমী এক জায়গা দেখার এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা যা মনকে সুস্থ, সতেজ আর চির কিশোরী করে রাখবে।
গুগল আর্থে পামুক্কালের অবস্থান।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।