চৈত্র সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় হিন্দুদের ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজা । অন্যান্য পূজার চাইতে একটু ভিন্ন এই পূজা পালন। সেটার সাক্ষী হতেই এক চৈত্র সংক্রান্তিতে চলে গেলাম সাভারের নলাম গ্রামে।

কেন এই ভিন্নতা? চড়কপূজা নিয়ে কথিত আছে একটি উপকথা। চড়ক একটি ব্রত। চৈত্র মাসের শেষ দিনে শিবভক্ত বান রাজা উৎসব পালন করতেন । শিবের পূজাও ছিল তার অংশ। উৎসবে সঙ্গী সাথীদের সাথে নাচে গানে মত্ত হয়ে এক পর্যায়ে নিজের শরীরকে ক্ষত বিক্ষত করে সেই রক্ত নিবেদন করেন শিবের চরণে। শিব খুশী হন। এরপর থেকে শিব সম্প্রদায়ের ভক্তরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন শিবকে সন্তুষ্ট করার জন্য চড়ক উৎসবে রক্ত দিয়ে পূজা করে থাকেন। কীভাবে? একটি লাইটপোস্টের মতো কাঠ হচ্ছে চড়কগাছ। এই গাছটিকে সারাবছর পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। পঞ্জিকা অনুসারে চৈত্রসংক্রান্তির দিন ঢাকঢোল বাজিয়ে শিবের গান গেয়ে পানি থেকে তুলে আনা হয় চড়কগাছটি আর মাটিতে পুঁতে তার সঙ্গে দড়ি-কাঠ বাঁধা হয়। এরপর সন্ন্যাসীর পিঠে বড়শি গেঁথে চড়কগাছে ঝুলিয়ে ঘোরানো হয়। ঝরঝর করে রক্ত ঝরে সন্ন্যাসীদের পিঠ থেকে আর এভাবেই তারা প্রকাশ করেন তাদের ভক্তি।

সবুজে, শ্যামলে ভরা নলাম গ্রাম। ছবি: কালপুরুষ অপূ

এই চড়কপূজা -র উপকথা শুধু শুনেছি, কিন্তু চোখে দেখা হয়নি। এক বন্ধুর কাছে খবর পেলাম খুব বেশি দূরে নয়, ঢাকার কাছেই সাভারের এক গ্রামে প্রতি বছরই চৈত্র সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় চড়কপূজা। তাই এবার অন্য সব পরিকল্পনা বাদ দিয়ে চলে গেলাম সাভারের অদূরে নলাম গ্রামে। নবীনগর পেরিয়ে বাইশ মাইলে এসে উত্তরদিকের রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই এই গ্রাম। ইট কাঠের নগরী পেরিয়ে হঠাৎ করেই শুরু হয়ে যায় সবুজে, শ্যামলে ভরা এক গ্রাম, নাম তার নলাম। গ্রামের পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে বংশী নদী। যদিও দূষণের কারণে সেই নদীতে জলকেলি করার কোন উপায় নেই। গ্রাম ভরা গাছ গাছালি আর সবুজ ধানের ক্ষেত যা সোনালি হবার অপেক্ষায় আছে। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন বিকেলে গিয়ে পৌঁছলাম সেই গ্রামে। এই গ্রামেরই নিখিল দাদার অতিথি আমরা। নিখিল দাদা ছোট্ট একটা চায়ের দোকান চালান।

চড়ক পূজা উৎসবের ১০-১২ দিন আগে থেকে বিভিন্ন এলাকার পূজারীর মধ্যে ১৫-২০ জন সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরীসহ নৃত্যগীতের মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তিতে অংশ নেন। চড়ক পূজার ২ দিন পূর্বে পূজারীরা শ্মশানে গিয়ে পূজা অর্চনা করেন ও শেষে গৌরীর বিয়ে, গৌরী নাচ ও বিভিন্ন গান গেয়ে ঢাকের বাজনায় সরগরম করে রাখনে গোটা এলাকা। এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে।

নিশি রাতে পূজারত তান্ত্রিক। ছবি: কালপুরুষ অপূ

হিন্দু রীতি অনুযায়ী নিরামিষ দিয়ে তৃপ্তিভরে রাতের খাবার শেষ করলাম। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে গ্রামে একটু হাঁটতে বের হলে চোখে পড়ল পূজার প্রস্তুতি চলছে। নিয়ম অনুযায়ী পূজার আগের দিন নিশি রাতে তান্ত্রিক মন্ত্র দ্বারা কাঁচ পড়া দিয়ে জ্বলন্ত ছাইয়ের উপর কালী সেজে নৃত্য করে। অন্য ভক্তগণ নৃত্যের ছন্দে ঢোলক, কাশি, করতাল বাজিয়ে থাকেন। রাতে নীল পূজার পর সন্ন্যাসীরা সবাই থাকে নির্জলা উপোস। পরদিন বিকাল বেলা চড়কপূজা শেষে উপোষ ভাঙ্গেন তারা।

পরদিন চৈত্র সংক্রান্তি। চৈত্র সংক্রান্তির সকালটা শুরু হল মুড়ি, মুড়কি, চিড়া, বাতাশা, তাল মিছরি খাওয়ার মধ্যে দিয়ে। চা খেতে নিখিল দাদার দোকানে গিয়ে বসতেই চোখে পড়লো চড়কপূজা -র প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ঢাক ঢোল বাজিয়ে, নেচে গেয়ে নদী থেকে প্রায় ১০০ ফুট লম্বা চড়ক গাছ তুলে আনছে এক দল পূজারী। অন্য আরেক দল, যে জায়গায় গাছটা পোঁতা হবে সেই জায়গাটা সাফসুতরো করছে।

নদী থেকে তুলে আনা হচ্ছে চড়ক গাছ। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

গাছ লাগানো হয়ে গেলে এরপরে শুধুই অপেক্ষার পালা কখন শুরু হবে আসল পূজা। গাছের চূড়া থেকে বাঁশ বেঁধে তার সাথে মোটা লম্বা রশি যুক্ত করা হয়। পরে এই গাছের সাথে সংযুক্ত দড়িতে ঝোলানো হয় পিঠে বড়শী গাথা পূজারীকে।  তান্ত্রিক মন্ত্র পরে পূজারীর পিঠে বড়শী গেঁথে দেন। বিকেলে ধীরে ধীরে জনসমাগম শুরু হয়ে গেল চড়কপূজা -র স্থানে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সব আশে পাশের বড় গাছ গুলোতে উঠে জায়গা করে নিল। ঢোলের তালে তালে কালীর নাচ দিয়ে শুরু হল উৎসব। গাছের গোড়ায় চলল পূজা দেওয়ার পালা।

কালীর নাচ দিয়ে শুরু হয় চড়ক পূজা। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

যথা সময়ে পিঠে বড়শীবিদ্ধ সন্ন্যাসী চলে এলেন পূজামণ্ডপে। তাকে ঘিরে চলল ভক্তকুলের নৃত্য উৎসব। গাছের গোঁড়ায় প্রণাম করে সন্ন্যাসীর পিঠে বিদ্ধ বড়শী বেঁধে দেওয়া হল চড়ক গাছে।

তান্ত্রিক মন্ত্র পড়ে সন্ন্যাসীর পিঠে বড়শী বিঁধিয়ে দেন। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

পিঠে বড়শীবিদ্ধ সন্ন্যাসী প্রণাম করছেন চড়ক গাছকে। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

চরকি ঘুরার আগে পূজারত সন্ন্যাসী। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

চড়ক গাছের সাথে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে সন্ন্যাসীকে। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

চরকিতে বাঁধা সন্ন্যাসী। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ। 

তারপর ভক্তকুলের উলুধ্বনি, উল্লাস আর চিৎকারের মাঝে শুরু হল চরকি ঘুরানো। উৎসুক জনতার “বলারে ভাই সন্ন্যাসীরা দেবে” এই ধ্বনির সাথে তাল মিলিয়ে ঘুরে চলল চরকি। চরকিতে ঘুরন্ত সন্ন্যাসী দুহাত কপালে ঠেকাচ্ছিলেন আর মাঝে মাঝেই ভক্তকুলের মাঝে প্রসাদ বিলাচ্ছিলেন। এই ভাবে প্রায় ৬ মিনিট ঘুরানোর পরে সন্ন্যাসীকে নীচে নামিয়ে আনা হয়। ভক্তকুল হাত পেতে দেন সন্ন্যাসীকে নীচে নামিয়ে আনার জন্য। নীচে নামার পরে সন্ন্যাসীকে ঘিরে চলে উল্লাস নৃত্য। এরপরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সন্ন্যাসী আশীর্বাদ দিয়ে আসেন।

পিঠে বড়শী বিঁধিয়ে চরকি ঘুরছেন সন্ন্যাসী। ছবিঃ ড. জিনিয়া রহমান।

পূজা শেষে সন্ধ্যায় আমরা যাই সন্ন্যাসীর সাথে কথা বলতে। জানলাম পাশের গ্রামে তার বাড়ি। এবারেরটা নিয়ে চতুর্থ বারের মতো তিনি চড়ক গাছে চড়লেন। উনি জানালেন ভগবানের কৃপায় ওনার কোন ব্যাথা বোধ হয়নি। ভবিষ্যতেও ওনার আবার চড়ক পূজার ইচ্ছা আছে।

যদিও চড়ক পূজা হিন্দুদের উৎসব কিন্তু ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ভীড় জমিয়েছিল এই উৎসবে। এই উৎসবে উপস্থিত থেকে আমিও চাক্ষুষ সাক্ষী হলাম ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজার। প্রতি বছরই বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় তাই সামনের বছর আপনিও হতে পারেন এই পূজার একজন দর্শক।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

নুহাশপল্লীনুহাশপল্লী
সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (পর্ব ৩)

About the Author: Aoezora Zinnia

সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস এন্ড ফিস ব্রীডিং বিভাগে কর্মরত আওজোরা জিনিয়া ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। একসময় প্রবাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত জিনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছেন অসংখ্য দেশ। পর্বতারোহণ নিয়েও রয়েছে তার দারুণ দারুণ সব স্বপ্ন। আর সেই পথ ধরেই তিনি ছিলেন মাউন্ট বাটুর, মাউন্ট ফুজি, মাউন্ট কানামো সহ বিভিন্ন পর্বতারোহণ অভিযানে। বনের সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়, ঝিরি, ঝর্ণার প্রতি তীব্র ভালোবাসার টানে সুযোগ পেলেই ছুটে বেড়ান থেকে পাহাড়, প্রান্তর থেকে প্রান্তর, বুনোপথ থেকে বুনোপথে।

Sharing does not make you less important!

নুহাশপল্লীনুহাশপল্লী
সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (পর্ব ৩)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

নুহাশপল্লীনুহাশপল্লী
সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (পর্ব ৩)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment