বাংলার বেশির ভাগ মানুষের বসবাস গ্রামে আর এই গ্রামের মানুষেরাই মুলত উৎপাদক শ্রেণী। কিন্তু আমাদের সমাজে এই উৎপাদক শ্রেণীই আজকে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও অবহেলিত। তাদেরকে এই বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি দিতে বাইরে থেকে ধার করে আনা কিংবা চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন মডেল যে কোন কাজেই আসবে না, সেটি আজ স্পষ্ট। অপর দিকে শহরের মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, বিলাসিতা, সকলকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা বা পরস্পর বিচ্ছিন্নতা ক্রমেই বাড়ছে যা রোগের মতো আমাদের সমাজে ছড়াচ্ছে, অথচ পরম আদরের সাথে তাকেই আমরা লালন করছি। আত্মবিলাসী এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে এসে সকলকে নিয়ে বৃহৎ-এর মাঝে নিজেকে যুক্ত করে সকলের মঙ্গলের জন্যই চাই এক বৃহৎ আন্দোলন আর সেখান থেকেই শুরু গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন এর। গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন এবং গ্রাম ভিত্তিক পর্যটন হতে পারে পর্যটনের এক নতুন দিগন্ত।
২০০৬ সালে ৭ জন মিলে শুরু করে অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের কার্যক্রম, যেখানে পরে যোগ দেন আরো অনেকেই। এরই মাঝে বর্ষা মৌসুমে শুরু হয় যমুনার ভাঙ্গন। ঘর বাড়ি ভেঙ্গে অনেক মানুষ যেমন হয় সহায় সম্বলহীন তেমনি অনেক কৃষকের আবাদি জমিও যায় পানির তলায়। তাদের জন্যে কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পাঠাগার থেকে। ঢাকার একটা ভ্রমণ দল বন্যা কবলিত এলাকায় চিড়া, গুড়মুড়ি ইত্যাদি নিয়ে সাহায্য করতে চাইলে অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের পক্ষ থেকে তাদের বলা হয় তাদের উদ্যোগটা মহতী এতে কোনো সন্দেহ নাই কিন্তু অত্র এলাকায় এ ধরণের সাহায্য মানুষের কোন উপকারে আসবে না। তার চেয়ে যদি বন্যা পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনে সহায়তা করেন তাহলে গ্রামের মানুষের অনেক উপকারে আসবে। তারা এতে রাজি হন।
পাঠাগারের সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করে। সাহায্যের জন্য পাওয়া টাকার পরিমাণ ছিল পঞ্চান্ন হাজার। ঠিক হয় যদি প্রতি পরিবারে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয় তাহলে ১১০টি পরিবারকে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে এবং এ টাকা তাদের কাজেও আসবে। তখন বাজারদর অনুযায়ী ৩০০ টাকায় ৫ কেজি জালা (ধানের চারা গাছের স্থানীয় নাম) পাওয়া যায়। যা থেকে ৮/১০ মণ ধান পাওয়া সম্ভব, ৪ সদস্যের একটি পরিবার যা দিয়ে অনায়েসে ১ মাস চালিয়ে নিতে পারবে। বাকি ২০০ টাকা সার ও জমি পরিচর্যার কাজে লাগবে। অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের কঠিন শর্ত ছিল এ টাকা দিয়ে অবশ্যই কৃষি কাজ করতে হবে। পাঠাগারের সদস্যরা এ ব্যাপারে নজরও রাখে। প্রায় ৮০ ভাগ লোক এ টাকার সঠিক ব্যবহার করেন আর বাকি ২০ ভাগ লোক আর্থিক অনটনের কারণে ঐ টাকা অন্য খাতে খরচ করে ফেলেন। ফসল উঠার পরে তারা নিজেরাই বলেছিল, তারা গড়ে ১০ মণ করে ধান পেয়েছিল। আর ঐ ধান থেকে যে খড় হয়েছিল তার মূল্যই হবে প্রায় ৫০০ টাকা।
২০০৭ সালে সিডর আঘাত হানে বিস্তীর্ণ দক্ষিণ অঞ্চলে। আবারো অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের পক্ষ থেকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সদস্যরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ৩০০০ টাকা ও ৫ মণ চাল উঠায়। কিন্তু বিপদ হয় এগুলো পাঠানো নিয়ে। পরে উপজেলা কর্মকর্তার সাথে কথা বলে সরকারের ত্রাণ তহবিলে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু মনে সন্দেহ জাগে এগুলো যথাসময়ে যথাযথ লোকের কাছে পৌঁছবে কিনা?
অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের সদস্যরা তখন ভাবেন যদি ঐ এলাকায় অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের মতো একটা সংগঠন থাকতো আর তাদের সাথে যদি যোগাযোগ থাকতো তাহলে এই সামান্য কটা জিনিসই এই বিপদের দিনে কতই না কাজে আসতো। এই ভাবনা থেকেই শুরু হয় নানা জায়গায় পাঠাগার তৈরির কাজ। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নাটোর, বদলগাছি, মধুপুর, সখিপুর, ভূঞাপুরসহ নানা জায়গায় কেন্দ্রীয় প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে থাকে পাঠাগার। বিছিন্নভাবে যে পাঠাগারগুলো গড়ে উঠছে অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগার তাদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে। খাগড়াছড়ির অরং পাঠাগার এ রকম একটি পাঠাগার। যুথবদ্ধভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই পুরো কার্যক্রমের নাম দেওয়া হয় ‘ গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন ’।
পাঠাগারগুলো গড়ে উঠে স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে। এলাকার প্রয়োজন, চাহিদা, ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে স্থানীয়রাই সিদ্ধান্ত নেন কী হবে তাদের কর্ম পরিকল্পনা, কেমন হবে তাদের কার্যপদ্ধতি। গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন কোনো ক্রমেই পাঠক তৈরির আন্দোলন নয়। যদি পাঠক তৈরি হয়ই সেটি তার বাড়তি পাওনা। এর আসল কাজ হলো প্রথমে গ্রামের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা। তারপর সকলকে নিয়ে স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে সবচেয়ে সস্তায়, সহজ বিকল্প উপায়ে অতিদ্রুত তার সমাধান করা। স্বল্প অথচ সংঘবদ্ধ মানুষগুলোর নিরন্তর প্রচেষ্টার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন ’। কারণ ঐ মানুষগুলোর কাছে পুরো গ্রামটাই একটা পাঠাগার। গ্রামের মানুষগুলো হলো বই আর কলম হলো গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ যা দিয়ে সে রচনা করতে পারে গীতাঞ্জলির মতো এক একটা গীতাঞ্চল।
গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন শহরের নাগরিকদের জন্যে গ্রামকে বুঝার একটু সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামের পর্যটন শিল্পকে বিকাশ করার ব্যপারেও সমান উদ্যোগী। প্রতিটি গ্রামে গ্রামে যে পাঠাগারগুলো গড়ে উঠছে তাকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে স্থানীয় পর্যটন শিল্প। এই পাঠাগারগুলো তাদের গ্রামের ঋতু বৈচিত্র্য, পালা পাবর্ন, উৎসব, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি নানা বিষয়কে মাথায় রেখে ভ্রমণ পরিকল্পনা করবে। এই সব পরিকল্পনার কথা প্রচার করবে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। আশা করা যায় অনেক ভ্রমণপিয়াসী মানুষই তাতে সাড়া দিবে।
ভ্রমণপ্রেমী শহুরে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পাঠাগারগুলো ইতিমধ্যেই যে সব উদ্যোগ নিয়েছে তা হলোঃ
১. অতিথিদের থাকার সুব্যবস্থা।
২. পরিস্কার, পরিছন্ন টয়লেট।
৩. নিরাপত্তার সু-ব্যবস্থা।
৪. গ্রামের যে সমস্ত লোকজ সম্পদ আছে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য মনোযোগী হওয়া। হস্ত ও কারু শিল্পের একটা সংগ্রহশালা গড়ে তোলা।
৫. পালা গান, জারি গান, সারি গান, ধুয়া গান, সং যাত্রা, কবি গান, লাঠি খেলা, নৌকা বাইচ, ষাড়ের লড়াই, নানা ধরণের পিঠা, ঐতিহ্যবাহী খাবার ইত্যাদির ব্যবস্থা করা।
আমাদের দেশে পর্যটন শিল্প বিকাশের একটা বড় বাধা হলো – স্থানীয়দের দূর্ব্যবহার এবং অসহযোগিতা। প্রায়শঃই দেখা যায় যুক্তিহীনভবে পর্যটকদের কাছ থেকে অর্থ খসিয়ে থাকে স্থানীয়রা। কোন কোন সময় বাজে ব্যবহারও করে থাকে। অথচ প্রতিটি গ্রামে পর্যটন শিল্প এবং গ্রামের লোকজনের সহযোগীতামুলক মনোভাবের বিকাশ ঘটাতে পারলে পর্যটকদের খরচ অনেক কমে যাবে। নিরাপত্তার আশ্বাস পেলে অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে যাবে এইসব পর্যটন গন্তব্যগুলোতে। এতে যেমন স্থানীয়রা উপকৃত হবে তেমনি দুর-দুরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটা হবে আনন্দের।
এসব কিছুই মাথায় রেখে, এই পর্যন্ত ৩টি ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছে ‘ গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন ‘ এর মাধ্যমে। আপনি পরিবার বা স্বজন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ‘ গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন ‘ এর মাধ্যমে পর্যটনবান্ধব গ্রাম গুলোতে। আর আগামীতেও এ ধরণের ভ্রমণের আয়োজনের ধারাবাহিকতায় আশার আলো নিয়ে পাশে থাকবে গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।