কানামোর কানামাছি। হঠাৎ সিদ্ধান্ত উচুঁ পর্বতে যাব। অনেক ঘুরাঘুরি করেছি, অনেক হেঁটেছি। কিন্তু এত উচুঁতে যাওয়ার পরিকল্পনা এই প্রথম। তাই ভাবনাটা অনেক বেশি। সিদ্ধান্ত হলো ভারতের হিমাচল প্রদেশের পর্বত কানামো। তাই লেখার নাম দিলাম কানামোর কানামাছি ।

কানামো কেন?
সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে কানামো পিকটা পুরোটা ট্রেকিং পিক, যেটা আমার মতো নতুনদের জন্য উপযুক্ত। দ্বিতীয়ত হচ্ছে এর সৌন্দর্য সম্পর্কে আমি যতটুকু শুনেছি ও নেটে দেখেছি, তাতে করে মনে হয়েছে আমি মর্মাহত হব না। আরও একটা ব্যাপার প্রকৃতি যতই রুক্ষ হোক না কেন, ব্যক্তিগতভাবে আমাকে তা টানেই। সাথে আছে তিব্বতীদের রঙিন মাটির ঘর, লেপার্ড, হিমালয়ান আইবেক্স, মুগ্ধ করার মত স্পিতির রুক্ষ ল্যান্ডস্কেপ।

৮-৯-১৬ সকালে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু। রাতটা কলকাতায় কাটিয়ে পরদিন চণ্ডিগড়ের ট্রেনে উঠে বসলাম। হাওড়া স্টেশনে যোগ হলো দীপংকর দে। যাত্রার শুরুতেই টের পেলাম বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। কিন্তু কোনো ভয় নেই। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। ট্রেনে উঠে নিজেদের গুছিয়ে নিলাম। সনি ভাইয়ের পরামর্শ আর হাজারো গল্পে কেটে গেল একদিন, দুই রাতের ট্রেনের সময়টা।

১১-৯-১৬ ভোরে চণ্ডিগড় নামলাম। দিপু আর সনি ভাই মানালি যাওয়ার গাড়ি ব্যবস্থা করার জন্য ব্যস্ত হলে ওই ফাঁকে আমি ফুটপাতে বসা এক খাবারের দোকান থেকে নুডুলস আর লাল চায়ের ব্যবস্থা করে ফেলি। চণ্ডিগড়ে নামার পরে আমার উল্লাসটা আরও বেড়ে গেল। নিঃশব্দ চণ্ডিগড় শহরের হালকা আলো, মৃদু ঠান্ডা বাতাস আর সাথের বন্ধুরা এই যেন অনন্য সাধারণ। যত কষ্টের যাত্রা হোক না কেন, আমি কখনো তা আনন্দহীন ভ্রমণে পরিণত হতে দিই না। তাই খাওয়া-দাওয়া, হাসি-আনন্দ আর ছবি তুলে শেষ দুপুরে পৌঁছে গেলাম মানালি।

সবাই যে যার মতো পরিচ্ছন্ন হয়ে আর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়লাম মানালি শহরটাকে দেখতে। ভালো ঠান্ডা ছিল। প্রচণ্ডভাবে লাল চা আমাকে টানছিল। লাল চায়ের প্রতি আসক্তি আমার চরমে। চা পান শেষে দেখা হলো জিনিয়া আপুর সাথে। প্রথম পরিচয়। আপু অসুস্থ। কানামো সামিটের উদ্দেশ্যে উনি ওখানে আছেন অন্য একটা দলের সাথে। উনার অসুস্থতা দেখে ওই মুহূর্তে সনি ভাই তার দায়িত্ব পালন করা শুরু করে দিলেন, যে কাজটা উনি সবার সাথে করে থাকে। আমাদের ওপর আইন জারি করা হলো, ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠতে হবে।

শারীরিক অনুশীলন হিসেবে মানালির পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে হবে। তাই ভোরে উঠে বের হয়ে এক কাপ লাল চা খেয়ে মানালির হিদিম্বা টেম্পল ঘুরে আসি। সনি ভাইয়ের উপদেশের ফলে জিনিয়া আপু সকালে ৭০ শতাংশ সুস্থ হয়ে আমাদের বৈঠকে যোগদান করলেন। সিদ্ধান্ত হলো পরবর্তী সব কার্যক্রমে জিনিয়া আপু আমাদের সাথেই থাকবেন। ১৩-০৯-১৬ ভোরে কাযা যাওয়ার পরিকল্পনায় আমরা সবকিছু গোছানো শুরু করলাম।

পরবর্তী যাত্রা কাজা-কিবের-কানামো বেইজ ক্যাম্প-কানামো সামিট। আর সেই কারণেই মানালি থেকে প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে নেওয়া। সনি ভাই ও দিপু সব করছে। তাই আমি নিজ থেকে ওদের দুজনের সাথে থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। নিজেদের কিছু গিয়ার, কিবের গ্রাম ও কানামো বেজ ক্যাম্পের জন্য রেশন, বেজ ক্যাম্পের প্রয়োজনীয় যা কিছু সব ব্যবস্থা করে ভোরে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম।

ভোরে সনি ভাইয়ের ডাকে উঠে পড়লাম। তৈরি হয়ে নিচে নেমে নিজেদের ভাড়া করা গাড়িতে সব জিনিসপত্র ও নিজেরা সেট হয়ে ভোর সাড়ে পাঁচটায় রওনা হলাম কাজার উদ্দেশে। বুঝতে পারলাম যতটা সামনে আগাব, ততটাই ঠান্ডা বাড়বে। তাই নিজেদের ঠিক সেইভাবে প্রস্তুত করে নিলাম। যদিও গাড়ির ভেতরে ঠান্ডায় ততটা কষ্ট পেতে হয় না।

মানালি থেকে লোকাল বাস করেও কাজা যাওয়া যায়। তবে সেটা অনেক কষ্টকর। কারণ এটা কোনো পিচঢালা পথ নয়। পাহাড়ের গা কেটে কেটে তৈরি পাথুরে এই রাস্তায় ঝাঁকুনির কোনো কমতি নেই। দলে পাঁচ থেকে ছয়জন সদস্য হলে অনায়াসেই নিজেরা ভাড়া করে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। চমৎকার একটা ভোরের শুরু। পাহাড়ের গায়ে ওই রকম সবুজ, হলুদ, সাদা রঙের ফুলগুলো চোখ আর মনকে শান্তি দিয়ে দিলো। গাড়ি ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে লাগল। চোখে যা দেখছি, তার সবটা বর্ণনা করা সহজসাধ্য নয়। মারহিতে নেমে নাস্তা করে একটু চারপাশটা দেখে নিলাম। তারপর আরও উপরে রোথাংপাসে (উচ্চতা ১৩ হাজার ৫০৮ ফুট) সবাই নেমে ঘুরাঘুরি করে ছবিও তুলে নিলাম।

রোথাং পাসে আমরা।

প্রাকৃতিক বৈচিত্রের অন্য এক রূপ। কাজা যাওয়া পর্যন্ত যা দেখেছি, তা সহজ ভাষায় পাথুরে পাহাড়। কিন্তু তা সৌন্দর্যহীন নয়। দুই চোখ যতদূর পর্যন্ত যাচ্ছে, পুরোটাই পাহাড়বেষ্টিত। একটু পর পর পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসছে বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়ের চূড়া। একেবারে ব্ল্যাক ফরেস্ট পেস্ট্রির মতো। নিচ দিয়ে সরু পথের মতো বয়ে গেছে নদী। পথে ছাত্রুতে দ্বিতীয়বারের মতো আবার একটু নাস্তা করে নিলাম। এরপর চলে এলাম চন্দ্রাতাল।

চন্দ্রাতাল লেক দেখার জন্য সবাই নেমে পড়লাম। বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে লেকে পৌঁছালাম। আহা সে কী পানির রং! পুরোটাই ছবির মতো। উত্তেজনায় লেকের পানি ধরে ফেলি, আর সাথে সাথে নিজের হাতটা বরফ হয়ে যায়। বেশ ঠান্ডা বাতাস, তবু চন্দ্রাতালের সৌন্দর্যে সব কিছু উপেক্ষা করে বেশ কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে উঠে পড়লাম গাড়িতে।

চন্দ্রাতাল লেকের সামনে আমরা।

যখন কাজা পৌঁছালাম, সন্ধ্যা হয়ে এলো। রুম নেওয়া হয়ে গেলে সবাই বিশ্রামে ব্যস্ত। রাতের খাবার খেয়ে সনি ভাইয়ের নির্দেশে সবাইকে কম গরম কাপড় গায়ে রেখে বাইরে কিছুক্ষণ হেঁটে আসতে হবে। সেটাই করলাম সবাই। আরও আইন জারি হলো ভোরে উঠে পাহাড়ে হাঁটতে হবে। আমাদের সাথে থাকা খালু একটু অসুস্থ হয়ে পড়ল। অক্সিজেনের ঘাটতিজনিত কারণে তিনি দুর্বল হয়ে পড়ে। ভোরে সবাই যথারীতি কাজায় বের হয়ে পাহাড়ের দিকে হাঁটতে চলে গেলাম। ফিরে এসে খালুর সুস্থতার জন্য লোকাল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হলো। আর আমরা কিবের যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম।

১৫-০৯-১৬ তারিখ কাজা থেকে কিবের চলে গেলাম পৌনে এক ঘণ্টায়। কিবের গ্রামে থাকা-খাওয়ার জন্য যে বাসাটার ব্যবস্থা করা হলো, সেই বাসার মালিক হলো থিনলে। অসম্ভব ভালো মনের মানুষ। কিবেরের বাড়িগুলো দেখেই আমার ভালো লেগে গেল। চারদিকে পাহাড় আর তার মাঝে ওই রং-বেরংয়ের বাড়িগুলো।

বাড়িগুলোর ছাদটা একটু বিশেষভাবে তৈরি। প্রথমে একটা কাঠের ছিলিং, তার ওপর মাচা, তার ওপর মাটি, তার ওপর ছোট ছোট গাছের টুকরো, তার ওপর আবার মাটি। এই প্রক্রিয়াটি মূলত অতিরিক্ত ঠান্ডা থেকে পরিত্রাণের জন্য। এর মধ্যে খাবারের আয়োজন হয়ে গেল। আর খাবারের ঘরটা এতটাই পরিপাটি ও সুন্দর যে, আমি ওই খাবার ঘরের প্রেমে পড়ে গেলাম।  ঘুমহীন রাত শেষ করে লাল চায়ের সাথে দিনের শুরু। আমাদের ঠিকমতো একটি এক্লিমাটাইজেশনের জন্য সনি ভাই আরও একদিন কিবের থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ভোরে তাই সবাইকে বেরিয়ে যেতে হয় হাঁটার অনুশীলনে। অনেকটা পাহাড়ে উঠে আবার নেমে আসি কিবেরের সেই ঘরে। পরের দিন বেইজ ক্যাম্পের প্রস্তুতি। প্রয়োজনীয় খাবার ও জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটো গাধা ঠিক করা হলো। সাথে গাইড হিসেবে থাকবে তেজিং। তেজিংয়ের সাথে শখ করে আমাদের সাথে থাকতে চাইল তেজিংয়ের বন্ধু রাহুল।

চলছি বেজক্যাম্পের পথে।

১৭-৯-১৬ তারিখে সাড়ে ৭টায় সব প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বেজ ক্যাম্পের উদ্দেশে। এখানকার এই পাথুরে পাহাড়ের গায়ে একটু পর পর লাল রঙের ছোট আকৃতির গাছগুলোকে মনে হয়েছে ফুলের তোড়া। হাঁটার মাঝে একটু বিশ্রাম আর ছবি তুলতে তুলতে বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছালাম বেজ ক্যাম্পে। ঠান্ডা বাতাস, তার সাথে দিনের রোদটা বড়ই আরাম দিচ্ছিল। খাবারের ব্যবস্থায় ঝেপে পড়ল তেনজিং ও রাহুল।

আমাদের বেজ ক্যাম্প।

আমরা আমাদের তাঁবুগুলো খাটিয়ে নিলাম। বেশ খানিক বাদে পাহাড়ের উপর থেকে নেমে এলো একটি ছেলে। সে হচ্ছে জিনিয়া আপুর দলের একজন সদস্য সজিব। কথা হলে জানতে পারলাম, সে কানামোর কাছাকাছি থেকে সামিট না করে ফিরে আসে অসুস্থতার কারণে। কিছুটা ভীত হলাম। সজিব ভাই ক্যাম্প থেকে যখন নিচে চলে আসে, তখন সে আমাদেরকে চিনি ও খিচুড়ি মিক্স প্যাকেট দিয়ে দেয়। সেটা পেয়ে আমি মহাখুশি। পাহাড়ে অন্তত এ রকম মনের মানুষ খুব প্রয়োজন। দুপুরের খাবার শেষ করে, বিশ্রাম পর্ব সেরে নির্দেশ হলো হাঁটতে যেতে হবে। নিজের স্বার্থেই সনি ভাইয়ের আদেশ পালন করলাম। বের হলাম আমি ও জিনিয়া আপু। সবাই তো হাঁটল ঠিকই। কিন্তু আমাকে সনি ভাই উঠিয়ে ছাড়ল এক পাহাড়ের চূড়ায়। উফ! কী যে কষ্টটা পেয়েছিলাম! তবে উপর থেকে কানামো লেক আর আমাদের ক্যাম্পটা দেখতে চমৎকার লাগছিল। ফিরে এসে নিজেই মুড়িমাখা তৈরি করে চায়ের সাথে সবাইকে নিয়ে খুব মজা করে খেয়ে নিলাম। পরের দিন কানামো সামিট। শুধু একটাই ভাবনা মনের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত পারব তো? সবাইকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হলো। মাঝরাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে। তাই সবকিছু মাথার কাছে গুছিয়ে নিয়ে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে নিলাম।

১৮-০৯-১৬ তারিখ রাত তিনটা। নিজেদের তৈরি করে নিলাম। তাঁবু থেকে বেরোতেই যেন ইচ্ছে হলো না। ঠান্ডা বাতাসটা আর গায়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সকল কিছু ভুলে গিয়ে বের হয়ে এক কাপ লাল চা খেয়ে নিলাম। দলের অন্যরা হালকা কিছু খেয়ে নিল। রাত সাড়ে ৩টায় সবাই বেরিয়ে পড়লাম। রাতের বেলায় আবহাওয়াটা ভালো থাকে। আর যত তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া যাবে, তত তাড়াতাড়ি সামিট শেষ করে বেজ ক্যাম্পে ফিরে আসা যাবে। কী এক অদ্ভুত রাত।  চারদিকে বিশাল বিশাল পাহাড়। সাতটা মানুষ। সামান্য একটু দূরে কী আছে, তা দেখা যায় না। তবে প্রাকৃতিক টর্চ লাইটের কারণে হাঁটা যাচ্ছিল ভালোই।

খুব সুন্দর একটি চাঁদ তখন আকাশে। তাই ১৫ থেকে ২০ মিনিট পরে ওই চাঁদের আলোতে পথটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঠান্ডা বাতাস আর রাতের অন্ধকারে বারবার মনে মনে আকুতি করছি, কখন এই রাতটুকু ইতি টেনে ভোরের আলো দেখা দেবে। সূর্য উঠার অপেক্ষাতে টুকটুক করে হেঁটে চলেছি। ধীরে ধীরে আবার শৈলরাজ্য স্পষ্ট হতে থাকল। নিজের মধ্যে প্রাণ ফিরে এলো। ছোট ছোট বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে অনেকটা পথ চলে এলাম। গিরির গায়ের সাথে আলো ছায়ার খেলাটা অপূর্ব। সূর্য কিরণ কখনো এই পাহাড়ে তো কখনো ওই পাহাড়ে।

কী অদ্ভূতভাবে পাহাড়ের বর্ণ পরিবর্তন করে দিচ্ছে। হেঁটে চলেছি আর বারবার ভাবনায় পড়ছি কানামো চূড়ায় পা রাখতে পারব তো? একটু সমতল, নিঃশ্বাস বড় বড়, সবাই পা মেলে বসে পড়লাম। এবার একটু বড় করে বিশ্রাম নিয়ে নিতে হবে। পানি আর শুকনা খাবার খেয়ে শরীরকে কিছুটা সক্রিয় করে নেওয়া হলো। চোখের সামনে শুধু উচুঁ পথ।

সনি ভাইকে বললাম, ‘ভাই আমি কি শেষ পর্যন্ত যেতে পারব?’ ভাই হাসি দিয়ে বললেন, ‘আরে কী বলেন, অবশ্যই পারবেন।’ ওই যে কানামো দেখা যাচ্ছে। তখন আমরা প্রায় পাঁচ হাজার ৪০০ মিটার উচ্চতায় আছি। সনি ভাইয়ের ওই এক হাজার ভোল্টেজের হাসিতে নিজেকে শেষবারের মতো তৈরি করে নিলাম, কানামোর কানামাছির খেলায়..চোখ বন্ধ করে দেখছি আবার চোখ খুললেও দেখতে পাচ্ছি, শুধু ধরতে পারছি না।

এক পা এগোলে দুই পা পিছলে যাচ্ছে। হুম, কানামোর চূড়ায় যাওয়ার শেষ যে খাড়া অংশটুকু, তা এ রকমই। পথজুড়ে শুধু ছোট ছোট পাথর। হাঁটতে হাঁটতে নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন টের পেলাম। নিজের শরীরটা যেন বেশ গতি খুঁজে পেল। খুব সুন্দর ছন্দ আর গতিতে আমি উপরে চলে যেতে লাগলাম। রাহুলের গল্প আর চোখের সামনে থাকা কানামোর হাতের পিঠের মতো চূড়াটার আকর্ষণে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে কানামোর গায়ে ঢলে পড়লাম। তখন থেকে ১০ মিনিটের অনুভূতিটা এই মুহূর্তে আমি জানাতে পারলাম না। কখনো কাউকে জানাতে পারবও না। বসে থেকে উপরওয়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। সব অনুভূতির একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেই সূত্রপাতে সনি ভাই ও আমি কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।

যখন নিজেকে সামলে নিয়ে কানামোর চূড়ায় আমি দাঁড়িয়ে, তখন আর নিজেকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। এই আমি কোথায়! আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি মানুষ অনেক কষ্টের পরে কোনো সাফল্য পেলে কেঁদে ফেলে। কিন্তু আমি কেন তার উল্টো? এখনো হাসি পাচ্ছে ঠিক যেমন কানামো চূড়ায় হেসেছিলাম। চারদিকের অদ্ভুত ওই সৌন্দর্যে আমি হেসে হেসে ভাবছিলাম, কীভাবে আমি এর সান্নিধ্যে এলাম। দিক নির্দেশনা, উচ্চতা মাপা, বাতাস মাপার কোনো যন্ত্রই আমার হাতে নেই। শুধু আমি দাঁড়িয়ে আছি শৈল চূড়ায়, যার সামনে তাকালেই আরও কত কত চূড়ার সমাহার। কোনোটা সাদা পেস্ট্রি তো কোনোটা কফি পেস্ট্রির মতো। আর নিচে তাকালে মনে হচ্ছে বরফের কুয়া।

কানামোর চূড়ায় আমরা যেদিক দিয়ে উঠেছি, তার উল্টো দিকটা একেবারে অন্যরকম। শত শত ফুট নিচে খাদ। পুরোটাই বরফের আবরণ। মনে হচ্ছে পিছলে নেমে যায়। আমরা কানামো সামিটের জন্য তার দক্ষিণ দিয়ে শুরু করলে একটা সময় পশ্চিম দিয়ে চূড়ায় পৌঁছানো হয়। আরেকটা দিক হলো উত্তরের লাদাখ দিয়ে সোমরিরি লেক হয়ে কানামো সামিট করা যায়।

বেশ কিছুক্ষণ অনেকের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। প্রায় ৪০ মিনিট পরে উঠে এলো শামিম, যাকে দেখে আমার হাসিতে পেট ফেটে যাচ্ছিল। কারণ সে আমার সাথে ঝগড়া করতে করতে নিজেই হয়রান হয়ে পড়ে। একটা সময় সে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। আর যখন জিনিয়া আপু চূড়ায় পা রাখল, সামনে গিয়ে আমি আপুকে জড়িয়ে ধরলাম। আপু আমাকে ধরে কেঁদে ফেলল। আগেই বলেছি অনুভূতির প্রকাশটা ঘটেই যায়। চূড়ায় দাঁড়িয়ে পর্বত রাজ্যে সবাই যেন সব কষ্ট ভুলে গেলাম। কীভাবে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল বুঝলাম না, ফিরে যে আসতেই হবে। সকলের ওই হাসিমুখ এখনো আমার স্পষ্ট হয়ে উঠে।

কানামোর সামিটে আমরা সবাই।

নিজের মধ্যে পরবর্তী এক নতুন স্বপ্ন বেঁধে নিয়ে, অনেকটা নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে নিচে নিমে আসার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। যে পথ ধরে গিয়েছি, সে পথ ধরে ফিরে এসেছি। অজানা পথটা এখন জানার পথ হলো। বেজ ক্যাম্পে ফিরে এলাম। তাঁবুতে ঢুকে মনে হলো, এ যেন নিজের নীড়ে ফিরে আসা। সেদিন ছিল পুরোপুরি পূর্ণিমা। অভিজ্ঞজনের কাছে শুনেছি, পাহাড়ে পূর্ণিমার সময়টা না হলেই বেশি ভালো। তাতে করে তারার আকাশটা পাওয়া যায়। তারা না থাকুক, ওই চাঁদটাতো আছে। রাতের তারা আর চাঁদ কোনোটাতেই আমার অভক্তি নেই।

১৯-০৯-১৬ তারিখ সবার চিন্তাহীন মুখটা বড়ই সুখকর। বেজ ক্যাম্পে সবাই মিলে চা নাস্তা করে নিজেদের সব জিনিস গুছিয়ে বেজ ক্যাম্প থেকে নিচে কিবের গ্রামে আসার জন্য আরও একবার হাঁটিহাঁটি পা পা শুরু করলাম। ফিরে এলাম কিবের গ্রামে। তারপর কাজা-মানালি-দিল্লি-কলকাতা-বাংলাদেশ। ফিরে আসার পথেও ছিল কিছু পাওয়া। অনেক অনেক আনন্দের মাঝেও কেন জানি মনটা মলিন হয়ে যাচ্ছিল। কোনো এক সুঁতোর টান আমায় টানছিল।

নেমে আসছি চূড়া থেকে।

নোট: উঁচু পাহাড়ে যাওয়ার জন্য অবশ্যই শরীর ও মন সুস্থ রাখতে হবে। তাই নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন প্রয়োজন। প্রযুক্তিগত নিয়মগুলো শেখার পাশাপাশি মনের জোরও রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, অতি উচ্চতায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য অবশ্যই এক্লিমাটাইজেশন করা। এই অভিযানে আমি আমার দলের প্রত্যেকটা সদস্যের কাছে চির কৃতজ্ঞ। সনি ভাইয়ের আনন্দ, জিনিয়া আপুর নীরবতা, শামিমের ঝগড়া আর দিপুর মুচকি হাসি কানামো অভিযানের  বিশেষ পাওয়া।

প্রয়োজনীয় জিনিস: ব্যাক প্যাক+ ডে প্যাক, ট্রেকিং বুট (অবশ্যই ভালো মানের), তিন সিজনস টেন্ট, স্লিপিং ম্যাট, স্লিপিং ব্যাগ, হেডলাইট, ক্যামেরা, জিপিএস, ওয়াকিং স্টিক, অতি ঠান্ডার জন্য ফেদার জ্যাকেট, হাত এবং পায়ের উলের মোটা মোজা, নাক কান ঢাকার টুপি, সানগ্লাস, নিজের চাহিদা অনুযায়ী ঠান্ডার পোশাক।

লিখেছেন আজিমুন আখতার সোনালি 

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

আন্ধারমানিকজার্নি টু আন্ধারমানিক
নীচে নামার গল্পনীচে নামার গল্প

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

আন্ধারমানিকজার্নি টু আন্ধারমানিক
নীচে নামার গল্পনীচে নামার গল্প

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

আন্ধারমানিকজার্নি টু আন্ধারমানিক
নীচে নামার গল্পনীচে নামার গল্প

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!