পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে গিয়ে প্রবল আক্রোশে ফেটে পড়া একটা উন্মাদ বুনো ঘোড়ার মত নদীটা দেখেই বুঝে গেলাম এবার আর হলোনা। অবশ্য সবসময় সব অভিযান সফল হবে এমন কোন কথাও নেই। তারপরও দু-একজন পাহাড়ি মানুষের আশ্বাস, দাদা আজ রাতে বৃষ্টি না হলে পানি কমে যাবে তারপর চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আপাততঃ আজকে আমাদের গ্রামে থেকে যান। কাল কোন একটা ব্যাবস্থা নিশ্চয়ই করা যাবে। তার উপর বেলা শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। সবার নিরাপত্তার কথা ভেবেই গ্রামে থেকে যাওয়াটাই আপাতত বুদ্ধিমানের কাজ বলেই মনে হচ্ছিল। গ্রামের লোকজন সবার আমাদেরকে নিয়ে বেশ কৌতুহলের কারণেই হোক আর ভবঘুরে আমাদের প্রতি ভালোবাসার কারণেই হোক, দারুণ আন্তরিক এক পাহাড়ি পরিবারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল খুব সহজেই। গোসল সেরে, সাথে করে নিয়ে আসা কফি বানিয়ে খেয়ে যখন সবাই পা ছড়িয়ে বারান্দায় বসে আছি তখন সন্ধ্যা।
সারা আকাশ আলোকিত করা তারাগুলোকে বারবার দেখেও মন যেন ভরছেনা। সবার মনে একটাই আকুলতা বৃষ্টিটা যেন আর না আসে। বৃষ্টি মানেই সব শেষ। আমাদের মন ভেঙ্গে না দেয়ার জন্যই হয়ত সে রাতে আর বৃষ্টি এলোও না। ভরপেট খেয়ে দেয়ে, গ্রামের মানুষদের সাথে জম্পেশ আড্ডা পিটিয়ে, ঝকঝকে তারা ভরা একটা আকাশকে বাইরে রেখে ঘুমাতে গেলাম একসময়।
বেশ ঝলমলে সকাল। ঘুমটাও বেশ ভালই হয়েছে। চা খেতে খেতে গল্প করছি। এর মধ্যে নাহিদ একবার নদীটা দেখে এসে জানালো ট্রেক করা যাবে। পানি অনেকটাই কমে গেছে। সবার চোখে মুখে বেশ একটা আনন্দ আনন্দ ভাব। যাক এযাত্রা হয়ত বেঁচে গেলাম। ব্যাকপ্যাকগুলো গোছানো শেষ করতে করতেই ধোঁয়া উঠা পাহাড়ি চালের ভাত আর মুরগীর মাংসটাও রেডী। আবার কবে এমন খাবার জুটবে জানিনা ভেবেই বেশ আয়েশের সাথে খেয়ে দেয়ে বের হলাম সবাই।
গ্রামের মানুষগুলো বেশ অবাক চোখেই দেখছে আমাদের। হয়ত ওরা ট্যুরিস্ট দেখে অভ্যস্ত না অথবা হয়ত ভাবছে এই পাগলগুলো কোথা থেকে মরতে এসছে কে জানে। সে যাই হোক, সবকিছু বেশ ভাল ভাবেই চলছে। কিন্তু এই ভালর সীমাটা যে খুব বেশী দূরে নয় তা বুঝতে এতটুকু দেরী হলনা। মাথার উপরের সেই ঝকঝকে নীল আকাশটা নিমিষেই উধাও তার বদলে ঘন কালো মেঘের মিছিল যেন আমাদের পথ চলা রুখে দাড়ানোর সংগ্রামে ব্যস্ত।
আমাদের অবাক হওয়া হয়ত তখনও কিছু বাকী ছিল কিংবা বলা যায় আমাদের অবাক হবার ষোলকলা পূরণ করতেই যেন পুরো আকাশটা ভেঙ্গে পড়ল আমাদের উপর। বৃষ্টি না, যেন শত সহস্র তীর ছুটে আসছে। বৃষ্টি আমার অনেক প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও এই মুহুর্তে, বিরামচিন্হের ব্যবহারকে উপেক্ষা করে ঝরতে থাকা নিষ্ঠুর বৃষ্টিটাকে এতটাই অসহ্য লাগছিলো যা প্রকাশের ভাষাজ্ঞান আমার জানা নেই। তারপরও হাঁটছি কারণ পথ যে একটাই। পেছনে ফেরার চেয়ে সামনে এগোনোটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
এতক্ষন অবাক হচ্ছিলাম বারবার কিন্তু আমাদের এই বারবার অবাক হওয়াটা হয়ত প্রকৃতির একঘেয়ে মনে হচ্ছিল। আর তাই আর অবাক নয় একেবারে হতবাক করে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েই যেন কিছুক্ষণ আগের দেখা প্রায় শান্ত নদীটাকে এমন উন্মাদ করে দিল যে সেটাকে দেখে আর যাই হোক, মাইলস্ এর গানের পাথুরে নদী বা পাহাড়ী মেয়ে কোনটাই মনে পড়ছেনা। দুপাশের দানব আকৃতির পাহাড়গুলোকে একটুও পাত্তা না দিয়ে, আমাদের চলার পথের কি হবে না হবে একটুও না ভেবে একপাল বুনো ঘোড়ার মত ছুটতে থাকা নদীটা দেখে আমাদের কারো মুখেই কোন কথা নেই।
বিস্ময়ের ঘোরটা কাটতেই প্রথম যে কথাটা মাথায় এলো সেটা হল এখান থেকে বেরুতে হবে, বের করতে হবে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা। নিষ্ঠুরের মত দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের খাড়া দেয়ালগুলো বেয়ে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। এখন একটাই উপায় একটা নৌকা বা এমন কিছু যোগাড় করা। কিন্তু এই নদীতে এই অবস্থায় একটা নৌকার আশা করার চেয়ে নিজের পিঠে দুইটা বা চারটা পাখা আছে কল্পনা করা ঢের সহজ মনে হচ্ছিল আমাদের কাছে। কিন্তু সব সমস্যাতেই কোন না কোন সমাধানের পথ হয়ত সবসময়ই থাকে আর সেভাবেই হয়ত অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই নৌকাটাও যোগাড় হয়ে গেল একসময়।
কিছুদূর এগিয়ে দেয়ার জন্য একপ্রকার জেদ করেই আমাদের সাথে গত রাতে যার ঘরে ছিলাম সেই পাহাড়ি দাদাও ছিল। সে যদি না থাকতো তাহলে আমাদের কপালে সেদিন কি জুটত জানা নাই। নেটওয়ার্কের ফাঁকফোকড় দিয়ে কিভাবে উনি উনার গ্রাম থেকে একটা ইঞ্জিন চালিত নৌকা যোগাড় করলেন তা জানার চেয়েও জরুরী খবর ছিল একটা নৌকা আসছে!!! আমাদের জন্য!!!!
নৌকার সমস্যা সমাধানের পর এবার সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা। আমরা ফিরে যাব কি না। নাকি আরো কিছুদুর চেষ্টা করব অথবা অন্য পথ ধরে কি বেরুনো যাবে!! ফিরে যাওয়া মানেই ক্ষতি। ফিরে গিয়ে নতুন কোন প্লান করে আবার কোথাও যাওয়া মানে সময় আর অর্থ দুটোরই অপচয়।
বান্দারবানে বিভিন্ন প্লান নিয়ে গেলেও আমরা যারা জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বেড়াই তাদের কাছে এটা এমন একটা জায়গা যেখানে প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গা এক এক রকম ভাবে সুন্দর আর তাই এখানে কোন সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের প্রয়োজন আমরা কখনই বোধ করিনি। অতএব, প্লান ভেস্তে গেল তো কি হয়েছে, এই আটকে পড়া থেকে ব্যাক ট্রেইল না করে সম্পূর্ন অচেনা পথ ধরে পালিয়ে পালিয়ে উদ্ধার পাওয়াটাই সবার কাছে বেশ সুখের মনে হচ্ছিল। নাহিদ ভাই তো বলেই ফেলল, ”ভাই আমি মজা পাইতেছি..!! ব্যাক করুম না..!! অভিযানের নাম পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা দিয়ে দেন আপাতত, বাকীটা দেখা যাক”। দলের একমাত্র মেয়ে অবনী জীবনে যার পাহাড়ি ঢলে আটকে পড়া তো দূরের কথা বড় কোন ট্রেকিং এ যাওয়ার অভিজ্ঞতাও নেই। সেও বলে কিনা ”ফিরে গিয়ে কি হবে..!! যাইতে পারলেই তো হয়….!!!” রিয়াদ ভাই বলল ”নো কমেন্টস্, আপনাগো ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা”। আমার কথা বলে আর কি লাভ। দাদাকে জানালাম ইচ্ছার কথা। বললাম আমাদের এমন কোন জায়গায় নামিয়ে দিয়ে আসেন যেখান থেকে আমরা আবার হেঁটে যেতে পারব।
একথা শুনে সে আর মাঝি দুজনেই বেশ অবাক, দুজনেরেই চেহারা দেখার মত!! যেন এই প্রথম শুনছে এমন কথা!! আমরা ওদের যতই বুঝাই আমরা পানি বেশী দেখলে নদী ছেড়ে দিব তারা বুঝবেনা। অবশেষে অনেক বুঝানোর পর তারা একটা শর্তে রাজী হল। শর্তটা হল ওরা আমাদেরকে একটা পাহাড়ি পথের মুখে নামিয়ে দিয়ে আসবে আমরা ঐ পথ ধরে বেরুনোর চেষ্টা করব এবং কোনভাবেই আমরা নদীতে যেন না নামি। বুঝলাম, মানলাম এবং রওনা দিলাম।
এরপর সেই সময় থেকে টানা চারদিন বিভিন্ন চড়াই উৎরাই, পথ ভুল, ঝড়ের রাতে পাহাড় চূড়ায় ক্যাম্পিং, শন, লতা পাতা আর বাঁশের জঙ্গল কেটে, অপরিচিত গ্রাম, ঝুম ঘর, দুই-দুইটা অপরিচিত গুহা (বৃষ্টির কারণে যার একটায় নামা সম্ভব হয়নি) ঘুরে আমরা একসময় বেরিয়ে এলাম আমাদের সবার পরিচিত ঝকঝকে সুন্দর জাদিপাই গ্রামে। সেই সব দিনের গল্প আরেকদিনের জন্য তুলে রাখলাম।
এই ট্রিপের নাম পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা হলেও প্রাপ্তিটা একেবারে খারাপ ছিলোনা। দুইটা দারুণ সুন্দর ঝর্ণা দেখার জন্য দ্বীপদা আর নাহিদের কাছে আমরা সবাই অনেক কৃতজ্ঞ। আর গুহাগুলোর জন্য কৃতজ্ঞ অনেক কঠিন নামওয়ালা দুই জন পাহাড়ী শিকারীর কাছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, তুমুল বৃষ্টি আর পথের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে পুরো পথের তেমন কোন ছবি তুলতে পারিনি। আর তাই অল্প কিছু ছবি দিয়েই কোনরকমভাবে ফেসবুক পেইজে শেয়ার করা পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা নামের অ্যালবাম-টা শেষ করতে হল।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
পড়ে পালিয়ে গেলাম
রাস্তা সবসময় পালিয়ে যাওয়ার জন্যেই… অতএব, পালিয়ে যাওয়ায় ক্ষতি নেই…. :) :)