বিকেলের সোনালী রোদটা যাই যাই করেও একটু আধটু লেগে আছে প্রায় ৩১৩৩ ফুট উঁচু তিংদৌলতে পাহাড়ের একেবারে চূঁড়া ঘেঁষে। ক্রমশ কমে আসছে এপাড়ের উপত্যকার আলো। অনেকটা উচুঁতে ঐ এক চিলতে রোদ্দুরের লুটোপুটি দেখা গেলেও পাহাড়ের এ ধারটায় বেশ সন্ধ্যা সন্ধ্যা একটা আমেজ। যদিও নিয়মিত পাহাড়ে আসা আমাদের কাছে তা তেমন নতুন কিংবা অসুবিধার কিছু নয় এবং এখনও যতটা আলো তাতেই মাইল খানেক দূরে দেখতে পাওয়া কুয়াশা জড়ানো ঘরগুলো যে একটা গ্রাম তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। তবে সমস্যাটা হলো- আমরা কেউ বুঝতে পারছি না ওইটাই আমাদের রাইখ্যিয়াং-এর বাড়ি জারুছড়ি কি না! তদুপরি আমরা যে পথ ধরে এগোচ্ছি সেই পথেই ঐ গ্রাম কিনা তাও একটা বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন। আর তা যদি না হয় তাহলেই শুরু আসল সমস্যার।
বাংলাদেশ-বার্মার সীমান্তবর্তী লম্বোক-রো রেঞ্জের এই অংশটায় এর আগে আমরা কেউ কখনও আসিনি। তাই অন্ধকার নেমে গেলে শুধু জি.পি.এস-এর ওপর নির্ভর করে পথ চলা কিংবা নির্দিষ্ট কোনো গ্রামকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সাপ-খোপ কিংবা অন্যান্য বন্য প্রাণীদের আক্রমণের সম্ভাবনাটা না হয় ভুলে থাকলাম কিন্তু সীমান্তবর্তী এই জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকা উগ্রপন্থীদের আক্রমণের আশংকাটা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তার সাথে বাড়তি পাওনা হলো হাঁড় কাঁপানো শীত, যার নমুনাটাও ইতিমধ্যেই বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।
আমাদের সাথে তাবু, রেশন, স্লিপিং ব্যাগ এবং সেই সাথে আগামী আরো অন্তত ৮ দিন চলার মতো পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা আছে ঠিকই কিন্তু এর আগের বেশ কটা রাত রুমা খালের বিভিন্ন জায়গায় তাবুতে থেকে থেকে সবাই প্রচন্ড ক্লান্ত। তার উপর গতরাতে রুমানা পাড়ায় লিয়াং এর ঘরে বেশ আরাম আয়েশে ছিলাম তাই কারো চোখেই আপাতত ক্যাম্পিং-এর কোন পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছেনা। অগত্যা পা চালানো ছাড়া গতি কি!
কান ঝালাপালা করা ঝিঝির ডাক আর বুনো ঘ্রাণ গায়ে মেখে, শন আর বাঁশের ঘন বনকে পাশ কাটিয়ে আবারও হাঁটা শুরু। পথ খুবই ভালো আর তেমন চড়াই-উৎরাইও নেই। বেশ দ্রুততার সাথেই হাঁটছি সবাই। আমি দু-একটা ছবির আশায় বারবার পিছিয়ে পড়লেও বাকী সবার সাথে তাল রেখে চলার চেষ্টাটাও চালিয়ে যাচ্ছি একই সাথে। সন্ধ্যার আলোটা এখনও সেই আগের মতোই স্থির, শুধু তিংদৌলতের মাথা থেকে সূর্যটা তার শেষ আলোটুকু তুলে নিয়ে কবে বিদায় নিয়েছে তা টের পাইনি এতক্ষণ।
শন আর বাঁশের বনটা ছাড়িয়ে এখন একটা বেশ বড়সড় গাছপালায় ঘেরা জঙ্গল পার করছি। হঠাৎ কিছুদূর সামনে থেকে রুহী ভাইয়ের কন্ঠ ‘আর বেশি নাই। আমরা মনে হয় গ্রামের কাছাকাছি কোথাও আছি’!! এক দৌড়ে পথের বাঁকটা ঘুরতেই দেখি রুহী ভাই একটা বেশ সুন্দর ব্রীজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সুন্দর ব্রীজ বলতে আমাদের মাথায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের তৈরি ব্রীজের যে ধারণাটা আসে তেমন কিছু ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রায় শুকনো একটা ঝিরির উপরে পুরোনো ভেঙে পড়া বিশাল একটা গাছ আর তার দুপাশে বাঁশের রেলিং লাগানো ব্রীজ কিংবা গাছের তৈরি সাঁকো যাই হোক না কেন, দেখে মনে হচ্ছিল এরচেয়ে সুন্দর আর কিছু এই মুহুর্তে আমাদের চোখের সামনে নেই।
ব্রীজটা দেখে বুঝলাম সত্যিই আর বেশি পথ বাকী নেই। নিঃসন্দেহে কোনো একটা গ্রামের কাছাকাছি কোথাও আছি আমরা। সেই সকাল বেলা রুমানা পাড়া থেকে রওনা দিয়েছিলাম। ক্লান্তিহীনভাবে হেঁটেছি প্রায় পুরোটা দিন! ক্ষুধার যন্ত্রণায় পেটের ভেতরের ইঁদুর-বিড়ালেরা মরে ফসিল হয়ে গেছে সেই কবেই। প্রচন্ড ভারী ব্যাকপ্যাকটা ছুড়ে ফেলে দেয়ার প্রবল ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও সেটা এখনও আমার কাঁধে বেশ বহাল তবিয়তেই আছে। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত এমন একটা মুহুর্তে একটুখানি বিশ্রাম আর খাবারের ব্যাবস্থার জন্য মনে হচ্ছে নির্দ্বিধায় পুরো পৃথিবীও দিয়ে দিতে পারি।
সাঁকোটা পেরিয়ে কিছুদূর এগোতেই কয়েকজন মানুষের সাথে দেখা। যেহেতু এ দিকটায় ট্রাভেলার কিংবা ট্রেকারদের তেমন আনাগোনা নেই তাই আমাদের দেখে হাজারো প্রশ্ন আর কৌতুহল এই সহজ-সরল মানুষগুলোর মনে ঘুরপাক খেতে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্নের সামনে দাঁড়ানোর মতো মানসিক স্থিরতা আমাদের নেই আর তাই প্রবল বিস্ময়ে হা হয়ে যাওয়া মুখগুলোকে কোন সুযোগ না দিয়েই জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘দাদা, জারুছড়ি আর কতদূর?’ ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়া আমাদের অবস্থা দেখেই কিনা জানি না, কোনো বাড়তি কিছু না জিজ্ঞেস করেই তাদের একজন ভাঙা ভাঙা বাংলায় জানালেন, আমরা ঠিক জায়গাতেই এসে পৌঁছেছি, আর সামান্য কিছুদূর হাঁটলেই জারুছড়ি। একগাল হেসে ধন্যবাদ জানানোর সময় জানা গেল এই দাদাদের সবার বাড়ি জারুছড়িতেই এবং উনারা বেশ সোৎসাহের সাথেই আমাদের নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হবার ব্যাপারে আগ্রহী।
আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য মূলত রাইখ্যিয়াং নদীর উৎসমুখ খুঁজে বের করা এবং রাইখ্যিয়াং-এর উৎসমুখ থেকে ভাটির দিকে পুরো নদী ধরে হেঁটে যাওয়া। দাদাদের সাথে রাইখ্যিয়াং নদী এবং এই অঞ্চলের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে বলতে জঙ্গলটা ছাড়িয়ে একটা খোলা মাঠের মতো জায়গায় এসে পৌঁছাতেই সন্ধ্যার আধো অন্ধকার গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকা অসাধারণ সুন্দর গ্রামটা দেখে আমাদের আনন্দ যেন আর ধরে না!
ইতিমধ্যেই আমাদের দেখতে পেয়ে গ্রামের মানুষজনও এগিয়ে এসেছে অনেকে। এ দিকটায় ট্রাভেলারদের আনাগোনা নেই বলেই আমাদের ব্যাপারে পুরো গ্রামের মানুষের কৌতুহলের কোনো শেষ নেই। এ প্রশ্ন, সে প্রশ্ন! আমরা সরকারি লোক নাকি এমনি বেড়াতে এসেছি, নদী ধরে হেঁটে যাওয়াতে আমাদের কি লাভ এমন হাজারও প্রশ্ন তো রয়েছেই। তার সাথে আমরা কার বাড়িতে থাকব, কি খাব তাও যেন এই দারুণ আন্তরিক মানুষগুলোর কাছে একটা বিশাল ভাবনার বিষয়।
বেশ ভাবনা চিন্তার পর অবশেষে ঠিক হলো গ্রামের কারবারি ইয়াংরোং ম্রো দাদার বাসায় আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। ইয়াংরোং দাদা ও দেখলাম খুব উৎসাহী। পাহাড়ি কচু আর মুরগীর সাথে ধোঁয়া উঠা গরম ভাত সেই সাথে আমাদের সবার ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত আরাম আয়েশের ব্যবস্থা সবকিছুই হয়ে গেল যেন নিমিষেই। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে, গ্রামের লোকদের সাথে জম্পেশ আড্ডা পিটিয়ে, পরদিন খুব ভোরেই ইয়াংরোং দাদা সহ রাইখ্যিয়াং নদীর উৎসমুখ এবং রাইখ্যিয়াং-এর সাথে যুক্ত অন্যান্য কিছু ঝিরিতে ঘুরোঘুরির স্বপ্ন বুনতে বুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।
এরপরের সবকিছুই যেন সত্যিকারের স্বপ্নই ছিল। প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ক্যাম্পিং, ঠান্ডায় জমে যাওয়া পা নিয়ে সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েও ঝিরি পথে হাঁটা, বারবার পথ ভুল, জঙ্গল কেটে পথ তৈরি করা, ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়েও হাসি মুখে পথ চলা, এই শীতের সময়েও অবাক করে দেওয়া জোঁকের অত্যাচার, পাহাড়ের সরল মানুষগুলোর সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার আনন্দ, এমন হাজারও আনন্দ বেদনায় মেশানো অভিযানটা শেষ করে এসেছি সেই কবেই। কিন্তু এখনো আমাদের সবার নাকে চোখে সেই আদিম বুনো পাহাড়ি পথের গন্ধ। এখনো মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে মনে হয় স্লিপিং ব্যাগের ভিতরেই আছি। এখনও তীব্রভাবে মনে হতে থাকে আজ সারাদিন কতটুকু পথ পাড়ি দেয়া যাবে।
এমন সব স্বপ্নীল অনুভবে অনুরণিত মন নিয়ে এখনো বারবার পাহাড়ে যাই ঠিকই, কিন্তু সেই দারুণ সুন্দর দিনগুলো, সহজ ভাবনায় বিভোর থাকা জারুছড়ির সেই সব মানুষ আর রাইখ্যিয়াং-এর বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা অসাধারণ সব সৌন্দর্যের তীব্র সম্মোহন আবার, আরো একবার সেই একই পথে হারানোর নেশায় বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে আজ এবং এখনও….!!!
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।