‘শুভময়দা, প্লিজ এটাই লাস্ট, এই সিগারেটটা খেয়েই হাঁটতে শুরু করবো’ অলরেডি চারবার এই অনুরোধ রেখে ফেলেছি, এটা পঞ্চমবার! যখন এই গোচা লা ট্রেকে আসার প্ল্যান হচ্ছে তখন সবাই বারণ করেছিল আমায়। কি যে দুর্বুদ্ধি হলো আমার, জোর করে দলে ছেলেটাকে ঢুকিয়েছিলাম। ২০০৩ এর ঘটনা আমায় কোনো শিক্ষাই দেয়নি বোঝা যাচ্ছে। ২০০৩ এ যে নতুন এসেছিলো সে সোকার পর যেতে পারেনি, কিন্তু এরকম ভোগায়নি। আমি ভেবেছিলাম যে আমার হেব্বি অভিজ্ঞতা এ রাস্তায়, আগে দুবার এসেছি, ঠিক এ ছেলেটাকে নিয়ে চলে যাবো। এই গোচা লা ট্রেকের পরিকল্পনার শুরু থেকে খুব ধরেছিলো, আমিও ভাবলাম যাক না প্রথম ট্রেক, তাও আবার গোচা লা ট্রেক।  দোনোমোনো করে রাজি হয়েছিলাম পুরোনো সঙ্গীসাথীদের আপত্তি সত্ত্বেও। সেই মৈত্র মহাশয়ের মতো ওর মাকে কথাও দিয়েছিলাম ফিরিয়ে নিয়ে আসবো ছেলেকে। হায়, সে কি আর পারবো? আমিই কি আর ফিরতে পারবো? এসব মনে মনে বকবক করছি আর মুখে ওকে গালাগালি দিয়ে ভূত ভাগাচ্ছি। ও বেচারি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলেছে আর আমার বকুনি উপেক্ষা করে একের পর এক সিগারেট খাওয়ার অনুমতি নিচ্ছে।

কোনোরকমে ফেদাঙ এর কিচেন হাট এর বারান্দায় সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হাটে কে বা কারা তালাচাবি দিয়ে দিয়েছিলো, সেসব ভেঙে ভেতরে ঢুকে তীব্র তুষারপাত এড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছি। কাঠের ফাঁক দিয়ে তীব্র ঝোড়ো হাওয়া আর বরফের অনন্ত স্রোত আমাদের ভিজিয়ে দিয়েছে। ওই টুটাফুটা আস্তানাতে বাধ্য হয়ে পঞ্চকোট পরেই শুকনো থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি প্রায় দুঘন্টা হলো। সঙ্গীরা তারও ঘন্টাখানেক আগে থেকে এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। অথচ শুরুটা আজ একেবারেই চকচকে, ঝকঝকে ছিল।

আজ আমাদের যাওয়ার কথা ছিলো সবমিলিয়ে ১২ কিমি। নামেই ১২ কিমি, আসলে আজ হলো এই ট্রেকের সবথেকে কষ্টকর হাঁটা। বাখিম (৮৬৫৪ ফুট) থেকে সোকা (৯৭০১ ফুট) মাত্র ২ কিমি, কিন্তু উচ্চতা ১০৪৭ ফুট! বুঝতেই পারছেন কতটা স্টিপ এই ট্রেইল! আবার সোকা থেকে ফেদাঙ মাত্র ৬ কিমি কিন্তু ফেদাঙ এর উচ্চতা ১২,০৮৩ ফুট মানে এই ৬ কিমিতে উঠতে হবে ২৩৮২ ফুট!! শেষ ৪ কিমি ফেদাঙ থেকে জোঙ্গরি (১৩,০২৪ ফুট), উঠতে হবে প্রায় ১০০০ ফুট, কারণ দেওরালি টপ পর্যন্ত উঠে আবার নেমে জোঙ্গরি পৌঁছতে হবে।

শক্ত বরফ জমে, সোকা থেকে ফেদঙ-২০০৮

বাখিম থেকে যখন বেরিয়েছিলাম সকাল ৭টা নাগাদ, তখন ঝকঝকে রোদ্দুর, আস্তে ধীরে ঢুকে পড়েছিলাম আমার নিজস্ব নন্দনকাননে মানে সোকার রাস্তায়। নন্দনকাননও হার মানবে, সঙ্গের ছবিগুলো দেখলে আশা করি আপনারাও একমত হবেন। বাখিম থেকে বড় বড় ওক গাছের জঙ্গল পেরিয়ে একটা সুন্দর মাঠের মতো জায়গা, এঁকেবেঁকে রাস্তা গেছে। এ রাস্তা ২০০৩ এ ছিলনা। মাঠের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। ওই ফুলের সাজ দেখতে দেখতে বাঁদিকে ঘন জঙ্গলে ঢুকে পড়লে হয়ে গেলো। আর বেরোবার পথ পাওয়া মুশকিল। ২০০৩ এ যখন এসেছিলাম, তখন শুনেছিলাম তার কিছুদিন আগেই সন্ধেবেলা এক জার্মান দম্পতি এ রাস্তা দিয়ে সোকা যাচ্ছিল, বাঁদিকে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে, তারপর আর তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ঘটনা যখন শুনছি গাইডের মুখে, তখন সন্ধ্যে উত্তীর্ণপ্রায়। আজও মনে আছে কি ভয়ে ভয়েই না এ রাস্তাটা গেছিলাম! সেবার সরাসরি ইয়কসম থেকে সোকা গেছিলাম। ২০০৮ এ বাখিমেই ছিলাম, এবারের মতোই, সেবার গোটা রাস্তাই ভালো আবহাওয়া পেয়েছিলাম ফেদাঙ পর্যন্ত, তারপর আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেছিলো।

ফেদাঙ- ২০০৮

এবার এতো ঝকঝকে সকাল দেখে মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেছিল। ফুলে ফুলে ভরা রাস্তা পেরিয়ে ছোট্ট গ্রাম সোকায় ঢুকে মনের আনন্দে ছোট্ট একটি বাড়ি কাম রেস্তোরাঁ থেকে একটু ডিম ভুজিয়া খেয়ে ফেললাম কারণ খাবার নিয়ে তো ফেদাঙ্গে আসার কথা কুকের। তারপর আস্তে আস্তে চা খেতে খেতে ছোট্ট গ্রামটার সকালের সৌন্দর্য মনপ্রাণ ভরে নিয়েছিলাম। আবার ফিরে ফিরে এসেছিলো ২০০৩, ২০০৮! ২০০৩ এ সেই ভর সন্ধেবেলা গ্রামে ঢুকেছিলাম। ট্রেকার্স হাট এ জায়গা ছিলোনা।  তার সামনের উঁচু জায়গায় টেন্ট খাটিয়ে রাতে ছিলাম। ভোরবেলা এক মায়াবী আলোয় ভরে গেছিলো টেন্ট। বাইরে বেরিয়ে সেই প্রথম পান্ডিমকে অতো পরিস্কার দেখেছিলাম। ২০০৮ এ এখান থেকে পাকদন্ডী বেয়ে ওঠা শুরু করতেই সেই মালবাহী ইয়াক পাগলের মতো দৌড়ে সব মালপত্র ফেলে নিচে চলে গেছিলো। পেছন পেছন আশীষদার সেই প্রাণান্তকর দৌড়! সব সব মনে পড়ে যাচ্ছিলো এক এক করে।

নস্টালজিয়ার টুপটাপ শব্দের মাঝে এক আকাশ রোদ্দুরকে সাক্ষী রেখে ছিমছাম পুকুর আর তার পাশে মোনাস্ট্রিকে পাক দিয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম পাকদন্ডী। ধীরে ধীরে নিচে সোকা গ্রামটি এক অনবদ্য কবিতায় পরিণত হচ্ছিল। টলটলে জল, পাশে মনাস্ট্রি, ছোট ছোট ঘর-বাড়ি, মাঝখান দিয়ে ক্ষীণ একটা রাস্তা। উঠে এসেছিলাম ফুলে ফুলে ভরা ছোট্ট শ্যাওলা ভরা মাঠটায়, যেখানে কোনোদিন সূর্যের আলো পড়েনি বলে আমার ধারণা। একটু বিশ্রাম নিলাম সেখানে, কুক ও ইয়াকরা ধরে ফেললো আমাদের। সব সঙ্গীসাথী এগিয়ে গেলো আমাদের ফেলে। ওরকম তো প্রতি ট্রেকেই আমি পেছনে পড়ে থাকি। ফলে এই স্বাভাবিক ব্যাপারটায় কোনো অস্বাভাবিকতাই পাইনি।

বাখিম থেকে হাঁটা শুরু, ২০১৪

সেই নতুন ছেলেটি আর আমি মনের আনন্দে হাঁটা শুরু করলাম। ওকে সাথে নিয়েই আমি চলছিলাম। শুরু হলো প্রাণান্তকর চড়াই, শুরু হলো রোডোডেন্ড্রনের গাছ আর কাঠ ফেলা কাদা কাদা সিঁড়ি সিঁড়ি পথ। ও তো নতুন, তাই সবেতেই বিস্মিত হচ্ছিলো। আর হবে নাই বা কেন? আমিওতো আবারো অবাক হচ্ছিলাম। নিচে শুকনো লাল ফুল পড়ে ঝুঁকে আছে সব গাছ, ফুলে ভরা, তার মাঝখান দিয়ে পথ গিয়েছে বেঁকে। উঠতে উঠতে এসে পড়লাম সেই চ্যাটালো পাথরের কাছে। বিশাল বড় পাথর, সবাই বিশ্রাম নেয় ওখানে। যখন পৌঁছলাম তখনও এক সঙ্গী ছিল সেখানে। আমরা যেতে ও উঠে হাঁটা লাগালো। তখনি আকাশ ঘোলা হয়ে এলো। গাছের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলো নিভে গেলো। আমি একটু প্রমাদ গুনলাম কারণ ফেদাঙ তখনো অনেক দূর! ওকে তাড়া দিয়ে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললাম, সেই প্রাণান্তকর চড়াই ধরে। টুপটাপ শিল পড়া শুরু হলো আর তার পাঁচমিনিটের মধ্যেই শুরু হলো বরফ পড়া। ও তো আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো, আর আমি সিঁদুরে মেঘ দেখলাম। ২০০৮ এও এই রাস্তায় বরফ ছিল, তবে তা পুরনো, রাস্তা জুড়ে সে বরফ শক্ত হয়ে পড়েছিল, সূর্যের আলো ঢোকেনা বলে বরফ গলতেও এ রাস্তায় অনেক সময় লাগে।

ম্যাগনোলিয়া-২০১৪

এবার ব্যাপারটা একটু গম্ভীরই মনে হচ্ছিল। আকাশ পরিষ্কার, পুরোনো বরফ ঢাকা রাস্তায় হাঁটা, আর বরফ পড়ছে এমন অবস্থায় হাঁটার মধ্যে পার্থক্য অনেক। তাই সিঁদুরে মেঘের প্রসঙ্গ গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে পেঁজা তুলো নামতে লাগল। সাথে শুরু হলো প্রবল হাওয়া। পাতা, ডাল বরফে ডুবে যেতে লাগলো, আর আমাদের হাঁটা তত ধীর হতে লাগল। আমি যত ওকে তাড়া দিই, তত ও বলতে লাগল, আরে তুমি এতো সুন্দর দৃশ্য দেখেও তাড়া দিচ্ছ কেন? ওকে বোঝাতে পারছিলামনা বিপদটা ঠিক কতখানি। জায়গায় জায়গায় পুরোনো শক্ত আধা গলা বরফের ওপর নতুন নরম বরফ পড়ছিল, আর ও সেই নিয়ে খেলা শুরু করলো। বকাবকি করে করে ক্লান্ত আমিও হাঁ করে খানিকক্ষণ এই প্রাচীন গহন জঙ্গলের অপার্থিব শোভা দেখতে লাগলাম। সে যে কি শোভা, বলে বোঝানো যাবেনা। ঝুপঝুপ টুপটাপ শব্দ, সাথে শোঁশোঁ হাওয়ার আওয়াজ নিঃঝুম এই জঙ্গলকে আরো যেন নিঃশব্দ করে তুলেছে, গাছের ডালে, পাতায়, ঝুলে থাকা শ্যাওলায় বরফের আস্তরণ পড়ছে অনবরত, ক্রমশ একটা রঙিন দৃশ্যকল্প সাদা-কালো হয়ে উঠছে।

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আবার তাড়া লাগালাম, আবার চলা শুরু হলো। বরফ পড়ার জোর বাড়ল আরো। কিছুদূরের কোনো কিছুই আর দেখা যাচ্ছিলনা। তখনও ছেলেটি বিপদ টের পায়নি, তবে হাওয়ার জোর বাড়ায়, আর বরফ পড়ার হার ক্রমশঃ বাড়তে থাকায় ও ও একটু জোরে হাঁটতে চেষ্টা করছিল। যাইহোক, এই সব করে, অনেক হাঁচোড় পাঁচর করে পৌঁছলাম ফেদাঙ। একটা মোটামুটি বড় মাঠ, আমরা যে দিক দিয়ে উঠে এলাম, তার উল্টো দিকে রাস্তা ক্রমশঃ ওপরে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে। তার বাঁদিকে একটা কিচেন হাট আর ডানদিক থেকে উঠে এসেছে গোচা লা করে ফেরার রাস্তা। অবশ্য এসব বর্ণনা আমি দিলাম আগের দুবারের দেখার স্মৃতি থেকে। ২০০৩ এ এখানে যখন এসেছিলাম মেঘে ঢাকা ছিল, খাবার দাবার প্রায় কিছুই ছিলনা, মনে আছে আমাদের সাথে কৌটোর মাছ ছিল। সে ভীষণ এক গন্ধওলা মাছ, সেই খেতে বাধ্য হয়েছিলাম। আর ২০০৮ এ এখানে বেশ মৌজ করে দুপুরের খাওয়া খেয়ে টুকটুক করে হাঁটতে শুরু করেছিলাম দেওরালি টপের দিকে।

যাক, সেসব অতীত। তো ওই প্রচন্ড বরফের ছাঁটের মধ্যে দৌড়ে দৌড়ে এসে ঢুকেছিলাম কিচেন হাটে, যে হাটের কথা লেখার শুরুতেই বলেছি কেউ কোত্থাও নেই। ফেদাঙ সাদা সং সেজে একা বসে আমাদের প্রতীক্ষায়। না না ভুল ভেবেছিলাম, তিন সঙ্গী আমাদের অপেক্ষায় ছিল ওই হাটে। আমরা পৌঁছতে ওই ঝোড়ো বরুফে আবহাওয়ায় ওরা খাবার বের করে দিয়েছিল, বলেছিলো বাকিরা সব রওনা হয়ে গেছে জোঙ্গরির দিকে, ওরা আমাদের জন্য থেকে গেছে। কোনোরকমে গলাধঃকরণ করলাম সেই খিচুড়ি, আর অসহায় দেখতে লাগলাম আরো আরো আবহাওয়া খারাপ হচ্ছে। বরফ পড়া কমা তো দূরের কথা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। আমরা খাওয়া শেষ করতে ওরা বেরিয়ে পড়েছিল ওই দুর্যোগে কারণ টেন্ট, স্যাক সবই চলে গেছে জোঙ্গরি। যে করেই হোক জোঙ্গরি পৌঁছতেই হবে আজ, নাহলে এখানেই বরফ সমাধি। ওরা বলে গেছিল, ওদের পেছন পেছন বেরিয়ে পড়তে। আমি ভেবেওছিলাম তাই কিন্তু বাদ সাধলো নতুন ছেলেটি। সে কিছুতেই তখন যাবেনা, একটু দুর্যোগ কমলে বেরোবে।

সোকা, ২০১৪

সেই থেকে একের পর এক সিগারেট আর মুখ চুন করে তাকিয়ে তাকিয়ে গালাগাল শোনা চলছে। কিন্তু সে ভুলবার নয়, কিছুতেই নড়ানো যাচ্ছেনা তাকে। দুঘন্টা পার হয়ে গেছে এই ফেদাঙ্গে, কমার কোনো লক্ষণ নেই, বরফ পড়া বেড়েই চলেছে।  সঙ্গীরা বেরিয়ে পড়েছে তাও মিনিট পনের হয়ে গেছে। সেই তখন থেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ভিজে চলেছি আর বেরনোর উদ্যোগ নিচ্ছি, কিন্তু বেরোতে পারছিনা।

ছেলেটি এই পঞ্চম সিগারেট খেয়ে (আমিও কাউন্টার নিয়েছি প্রতিবারই, আমি কি অকুতোভয় নাকি?) ওই বরফভরা বারান্দায় একদম বসে পড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। আমি হতভম্ব, প্রচন্ড চিন্তায় পড়ে গেছি আমিও। বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছেনা, চারিদিক সাদা বরফ-বৃষ্টিতে। পেঁজা তুলোর ভাব কমে কখনো সাদা বালির ঝড়, কখনো আবার তুলোর তান্ডব। বাঁদিকে পাহাড়ে যে রাস্তা উঠছে তার শুরুটুকুও নজরে পড়ছেনা। কিন্তু বেরোতে আমাদের হবেই, নাহলে এখানে সারারাত থাকলে মারা পড়ে যাব। এসব যখন ঘটছে তখন বিকেল প্রায় চারটে। ঘনান্ধকার চারিদিক, শুধু শোঁ শোঁ শব্দ, আর ঝুপ ঝুপ, টুপটুপ বরফ পড়া। আলো আর বেশিক্ষণ থাকবেনা, হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে ওই ভীত সন্ত্রস্ত কান্না মাখামাখি মানুষটাকে জোর করে ঠেলে বাইরে বের করলাম। শুরু হলো একপা-দুপা করে হাঁটা। মাঠ পেরিয়ে সাদা ঝোপে ভরা চড়াই চড়তে শুরু করলাম একদম আন্দাজে। ওকে আগে দিয়ে আমি পেছনে, ও হয়তো আমার চার-পাঁচ হাত আগে আছে, কিন্তু ওকে তো দেখতে পাচ্ছিইনা, জুতোর ছাপও মিলিয়ে যাচ্ছে।

বারবার ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়ছে, ওই বরফ-পাতের মধ্যে সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছে, আর ব্যর্থ হয়ে আকুল চোখে যেটুকু দেখতে পায় দেখছে। এই করতে করতে আমি একটু এগিয়ে গেছি, পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলামনা, ভাবলাম কিছুই তো দেখা যাচ্ছেনা, একটু দাঁড়াই, ও আমায় দেখতে না পেলে ভয় পেয়ে ঠিক তাড়াতাড়ি আসবে, এই ভেবে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। না! বরফের চুপচুপ আওয়াজ ছাড়া আর কিছু তো নেই।  নিঃসাড়ে ভিজছে চারপাশের গাছপালা। সুড়ঙ্গ মতো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে, এ পৃথিবীতে কেউ জানতে পারবেনা আমি এখানেই হারিয়ে গেলে। এইসব ভাবছি, হঠাৎ মনে হলো, আরে অনেকক্ষণ হয়ে গেল তো, ছেলেটা কোথায় গেল? চারিদিক অন্ধকার, সন্ধ্যে নেমে আসছে বরফের বুক বেয়ে। বুক ঢিপঢিপ করে উঠলো, কিছুই তো জানেনা বেচারি, অন্যদিকে চলে গেল নাতো? আমি তো গত দুবারের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে অন্ধের মতো আন্দাজে হেঁটে চলেছি, ও তো কিছুই জানেনা। ফিরতে শুরু করলাম আবার পেছন দিকে, একরাশ ভয় আর আশংকাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে।

আপাততঃ আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে। বাংলা মেগাসিরিয়াল ঢঙে পর্ব শেষ করলাম তবে পার্থক্য আছে। আমি যখন বসে এ লেখা লিখছি তার মানে নিরাপদেই ফিরেছিলাম ফলে অত উৎকণ্ঠিত হওয়ার কিছু নেই বরং ভাবতে পারেন, এরপর কি হলো? ওকে খুঁজে পেলাম? কি অবস্থায় পেলাম? যদি পেয়েও থাকি, আমরা উদ্ধার পেলাম কি করে? নিজেরাই ওই দুর্যোগে পথ খুঁজে যেতে পারলাম? নাকি কোনো দেবদূত আকাশ থেকে সংকেত পাঠালো?
ভাবুন ভাবুন, একটু ভাবা অভ্যাস করুন।

বিঃ দ্রঃ ওই সময়ের কোনো ছবি তোলাই সম্ভব হয়নি, ক্যামেরা ব্যাগের মধ্যেই ছিল সেই বরফ পড়া শুরু হওয়ার পর থেকেই, যখন ঠিক পড়া শুরু হয়েছে তার একটা আছে।

চলবে …

অন্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে
গোচা লা ট্রেকঃ পিনাকেতে লাগে টঙ্কার (পর্ব ১)
গোচা লা ট্রেকঃ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে (পর্ব ২)
গোচা লা ট্রেকঃ সন্ধ্যে যেখানে রাত্রির সন্ধানে (পর্ব ৪)
গোচা লা ট্রেকঃ জোঙ্গরির রাত-ভোর (পর্ব ৫)
গোচা লা ট্রেকঃ কোকচুরাঙ ছুঁয়ে থানসিং (পর্ব ৬)
গোচা লা ট্রেকঃ ধূসর রূপের পান্ডিম (পর্ব ৭)
গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)
গোচা লা ট্রেকঃ ফিরে চলা ঘুম ঘুম রূপকথা ছেড়ে (শেষ পর্ব)

লিখেছেনঃ শুভময় পাল। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স শুভময়ের প্রিয় জায়গা। অজানা, অচেনা জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘোরা নেশা শুভময়ের।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

গোচা লাগোচা লা ট্রেকঃ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে (পর্ব ২)
বরফগোচা লা ট্রেকঃ সন্ধ্যে যেখানে রাত্রির সন্ধানে (পর্ব ৪)

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

গোচা লাগোচা লা ট্রেকঃ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে (পর্ব ২)
বরফগোচা লা ট্রেকঃ সন্ধ্যে যেখানে রাত্রির সন্ধানে (পর্ব ৪)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

গোচা লাগোচা লা ট্রেকঃ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে (পর্ব ২)
বরফগোচা লা ট্রেকঃ সন্ধ্যে যেখানে রাত্রির সন্ধানে (পর্ব ৪)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!