জানিনা আপনাদের হয় কিনা? শীত শেষ, পাতা ঝরছে অবিরাম, হালকা হালকা ঠান্ডা হাওয়া সকালবেলার দিকে, বেলা গড়াতেই আস্তে আস্তে রোদের আর গরমের ভাব টের পাওয়া যাচ্ছে, এই রকম একটা সময়ে ছুটির দুপুরে ভীষণ পুরোনো কথা মনে পড়ে। ছোটবেলার, বড়বেলার- তিস্তার বাঁধ, প্রথম প্রেমিকা, দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া, আর যারা জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তারা ঘুরে ফিরে আসে। ভীষণ মন কেমন করে ওঠে, আবার সেই মন কেমন ভাবটা মনের ভেতর কেমন একটা সুখও এনে দেয়। একটা শিরশিরানি ভালোলাগা আর খারাপলাগা পাশাপাশি মনে এসে বাসা বাঁধে। মার্চের শেষে আর এপ্রিলের শুরুতে পুরোনো কথারা ভেসে ওঠে অবচেতন থেকে, আর আমরা ট্রেকিঙে যাই ঠিক এই সময়েই। গোচা লা ট্রেকও ব্যতিক্রম নয়। সেই ২০০৩ বা ২০০৮ বা ২০১৪, সব বছরই এপ্রিলেই গেছি গোচা লা ট্রেকে, আর লিখতেও বসেছি সেই একই সময়ে প্রায়, তাই পুরোনো স্মৃতিতে উপচে পড়ছে মনের কুঠুরি। যদি বেশি বকে ফেলি, এক কথা ঘুরেফিরে আসে, একটু ক্ষমাঘেন্না করে পড়ে ফেলবেন।

নেট থেকে সংগৃহীত। শুধু দিনগুলো আলাদা।

তো সেই ২০১৪ র এপ্রিলে ইয়কসামে সকাল হল। সাজসাজ রবে সব গোছগাছ সারা হল। যেগুলো অপ্রয়োজনীয় তা একটি বড়ো বস্তায় বন্দি করে যে হোমস্টেতে উঠেছিলাম সেখানেই রেখে দেওয়া হল কারণ নেমে এসে তো এখানেই রাত্রিযাপন করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় মানে যেগুলো ট্রেকের সময় লাগবেনা যেমন বাড়ি থেকে পরে আসা জামাকাপড়, চটি-জুতো ইত্যাদি।  ঠেকে ঠেকে শিখেছি এসব। অকারণ মালের বোঝা বাড়িয়ে লাভ নেই। প্রথমদিকের ট্রেকিঙে অনেক ছোটোখাটো ভুল করতাম, যেগুলো পরে বিপদজনক আকার নিতো। তখন কম বয়স ছিল বলে সামলে নিয়েছি। এখন বয়স বেড়েছে, সক্ষমতা কমেছে, কিন্তু অভিজ্ঞতা বেড়েছে, তাই দিয়েই অক্ষমতাকে ব্যালান্স করি।

২০০৩ এ আরেকটা বড়ো ভুল করেছিলাম প্রথম দিন। আগেরদিন অনেক রাতে পৌঁছে পারমিশন করানো হয়নি, ফলত পরের দিন সবাই মিলে থেকে গেছিলাম। পারমিশন করে বেরোতে বেরোতে অনেক দেরি, আর প্রচুর রাস্তা প্রথম দিনই। প্রায় রাতের অন্ধকারে বাখিম ঢুকেছিলাম, বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছিলো। সে একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা! সেই থেকেই শিক্ষা নিয়েছিলাম, পরবর্তীকালে যত ট্রেক করেছি, আমাদের এক্কেবারে বাঁধাধরা ব্যাপার। আমরা সকালে শুধু চা খেয়ে লজেন্স, কাজু, কিসমিস পকেটে নিয়ে বেরিয়ে পড়বো। সাথে গাইড থাকবে, আর কুক ও অন্যান্য পোর্টার, খচ্ছর বা ইয়াক মালপত্র নিয়ে জলখাবার বানিয়ে আমাদের ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ধরে ফেলবে আর আমরা রাস্তায় ব্রাঞ্চ সারবো। এতে অনেকগুলো সুবিধা হয়, এক তো আমরা বেশ খানিকটা এগিয়ে যাই, দুই, আমরা এগিয়ে গেছি বলে কুকও তাড়াতাড়ি রান্না সেরে সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ে, তিন, দুপুরের পর থেকেই পাহাড়ে বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে, তার আগেই আমরা হয় পৌঁছে যাই গন্তব্যে বা গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছাই। ওহ আরেকটা ব্যাপার বলে রাখি, এই ট্রেকে পুলিশ পোস্ট থেকে পারমিশন নিতে হয় ফটো আইডেন্টিটি প্রুফ দেখিয়ে। আবার ফরেস্ট অফিসে এন্ট্রি ফী দিতে হয় যা আবার অনেক ভাবে আলাদা আলাদা করে লেখা থাকে টেন্ট, পোর্টার, ক্যামেরা ইত্যাদি। মোটামুটি এখন একেকজনের ৭০০ টাকা মতো এন্ট্রি ফী লাগে।

সুসায় খোলা ফলস।

উফফফ আমার যে কি হয়েছে? এক মালপত্র গোছাতে গিয়ে কত কিছু বকে ফেললাম! চলুন এবার বেরিয়ে পড়ি। আমাদের ক্যাপ্টেন আর গাইড পারমিশনগুলো করিয়ে নেবে, আমরা আগে এগিয়ে যাব। ওরা আর কুক একসাথে রওনা দেবে খাবার দাবার সমেত। আমাদের সাথে ইয়াক আর তার মালিক যাবে। আজ যাবো ১৪ কিমি দূরত্বে বাখিমে, ইয়কসমের উচ্চতা ৫৭০০ ফুট, ৰাখিম ৮৬০০ ফুট। এই দূরত্ব প্রথমদিন পার করা বেশ চাপের। তার থেকেও বেশি চাপের কারণ হলো রাস্তার অবস্থান, তার ওঠা পড়া; এ নিয়ে বিস্তারিত হাঁটতে হাঁটতে বলবো। প্রথমবার তো বাখিম ছিলাম বললামই। পরেরবার আগে থেকে সব প্রিপারেশন নেওয়াতে সোজা সোকা চলে গেছিলাম, সোকা ৰাখিম থেকে আরো ২ কিমি দূরে, উচ্চতা ৯৬৫০ ফুট। সাধারণত ট্রেক অপেরাটররা সাচেন বলে এক জায়গায় প্রথম দিন তাঁবু ফেলে। সাচেন হলো ৮ কিমি দূরত্বে অবস্থিত একটা ছোট মাঠের মতো জায়গা, যেখানে রান্না করা এবং বৃষ্টি হলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য একটা ছোট চারিদিক খোলা আস্তানা ছিল। এবার দেখলাম একটা ট্রেকার্স হাট তৈরী করা হয়েছে, যারা একবারে পারবেননা তারা সাচেন থাকতেই পারেন, তবে সাচেন একদম জঙ্গলের মধ্যে বদ্ধ জায়গা।

অনেক বকেছি, এবার হাঁটা শুরু করি। ইয়কসমের লেক পেরিয়ে রাস্তা ধরে শুরু হলো হাঁটা, গ্রামের শেষ দিকে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাড়ি, তার মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা। টুকটুক করে চলেছি। সবে সকাল ৭ টা, আড়মোড়া ভাঙছে গ্রাম, ঘুম ভেঙেছে পাহাড়ের, ঝকঝক করছে গাছপালা। খানিকদূর ওঠার পরেই সমতল রাস্তা প্রায়। এই রাস্তায় মজা হচ্ছে চারটে ব্রিজ পেরোতে হবে। প্রথম যখন ২০০৩ এ এসেছিলাম তখন প্রথম ব্রিজটা ভাঙা ছিল। আমাদের একেবারে নিচে নেমে আবার উঠতে হয়েছিল। সেকারণে বহু সময় নষ্ট হয়েছিল। প্রেক-চু (নদী) ও তার বিভিন্ন শাখা নদী এঁকেবেঁকে চলেছে পাহাড়কে আলিঙ্গন করতে করতে, আর রাস্তাও চলেছে কখনো তার থেকে বহু ওপর দিয়ে। আবার কখনো একদম নদীর কাছ দিয়ে মোটামুটি সমতল দিয়ে চলতে চলতে ডানদিকে একটা সুন্দর শেল্টার। এটা আগের দুবার আমরা দেখিনি। এই শেল্টার পেরিয়ে একটু একটু করে চড়াই শুরু। আমরা বেশ গল্প করতে করতে চলেছি। আস্তে আস্তে ঘন, আরো ঘন জঙ্গলে ঢুকছি।  মোটামুটি ঘন্টাখানেক পরে পড়লো প্রথম ব্রিজ। এই ব্রিজটা আমরা ২০০৩ এ পাইনি। নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ফা-খোলা বেশ গর্জন করতে করতে। ব্রিজ পেরিয়ে সুন্দর বসার জায়গা, কিন্তু আমরা তো বসব না খাবার এসে না পৌঁছনো পর্যন্ত।

ট্রেকিং রুট।

গল্প করতে করতে এগিয়ে চললাম ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। ঠান্ডা রাস্তা, হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগছে। গাছপালা ঘিরে আছে আমাদের, ছাতার মতো মাথার ওপরে ছায়া। খুব মনোরম উঁচুনিচু ট্রেইল, ক্রমশ ওপরে উঠছে, স্যাঁতস্যাঁতে জঙ্গুলে রাস্তা, মস ফার্নে ভর্তি। ডানদিকে পাহাড় আর জঙ্গল মিলেমিশে আছে আর বাঁদিকে নিচে প্রেক-চু’র গর্জন শোনা যাচ্ছে, আর তার ওপারের ঠাসবুনোট জঙ্গল হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এভাবেই আরো ঘন্টা দুয়েক হাঁটার পর হঠাৎ দেখি বাঁদিকে ছোট ছোট কয়েকটা ঝর্ণা নিচে প্রেক-চু তে মিশেছে। ঘন গাঢ় সবুজ জঙ্গলের ব্যাকড্রপে সাদা ঘন নীল জলের ঝর্ণা! আঃ কি অপূর্ব যে লাগছে! এই ঝর্ণার নাম সুসাই খোলা ফলস (tshushay), আর একটু খানিক এগোলেই এই সুসাই খোলার ওপর বিশাল লোহার ব্রিজ। এই খোলাই এখান থেকে গিয়ে এই ওপর থেকে ধীরে ধীরে নিচে নেমে ঝর্ণা হয়ে প্রেক-চু তে মিশেছে।

প্রায় ঘন্টা তিনের ওপর হাঁটা হয়ে গেছে। ১০ টা বেজে গেছে, প্রচন্ড খিদেও পেয়েছে। এইসব ভাবছি, হঠাৎ দেখি পুরো দল হাজির- ক্যাপ্টেন, গাইড আর খাবার সহ কুক! ছায়া ছায়া মনোরম একটা জায়গায় বসে পড়লাম। আলুর পরোটা আর আচার খেতে খেতে গল্প শুরু হলো। প্রথমবারে একটা ঘটনা ঘটেছিলো। সেবার আমাদের সাথে একজন নিউ রিক্রুট এসেছিলো, সে প্রথম থেকেই খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছিলো। তার আবার হাঁটুতে চোট। তাকে অনেক বলা হলো যে প্রথমদিন একটু ধীরে ধীরে চলাই ভালো। সে তো হনহন করে হেঁটে সবার আগে চলে গেল। এই সেকেন্ড ব্রিজে তাকে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল। এখানে এসে আর তাকে খুঁজে পাইনা। উল্টোদিক থেকে যারা আসছিলো, তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তারাও এরকম কাউকে দেখেনি। তাহলে গেল কোথায়? তারপর বেশ খানিকক্ষণ পরে দেখা গেলো সে আমাদের পেছন দিয়ে এসে উপস্থিত। কোথায় ছিল?

প্রেক চু।

শুনলাম ওই সেকেন্ড ব্রিজের আগে নিচে নদীর দিকে একটা রাস্তা নেমে গেছে। ও ভুল করে ওই রাস্তায় চলে গেছিল। যদিও খুব বেশি দূর যায়নি, কিন্তু টেনশনে, ভয়ে তার অবস্থা খারাপ, সে আর কিছুতেই যাবে না। খুব জোরজার করে, আমাদের সেবারের ক্যাপ্টেন প্রায় ঘাড়ে করে তাকে বাখিম পর্যন্ত নিয়ে গেছিল। পরদিন সোকা পৌঁছে থাকার ব্যবস্থা আছে দেখে সে বেঁকে বসল আর গেলই না। থেকে গেল ওখানেই। আমরা ফেরার সময় আমাদের সাথে নেমে এল। ২০০৮ এ আবার এসেছিল আমাদের সাথে। সেবার অবশ্য পুরোটাই করেছিল, যদিও কোকচুরানে সুন্দর ট্রেকার্স হাট দেখে আবার সে বেঁকে বসেছিল যাবে না বলে। সেবার ভূতের ভয় দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদিও খুব মজা করে বলছি, কিন্তু এরকম হয়। তবে সত্যিই ওর মনের জোর আছে, প্রথমবারের বিপর্যয়ের পরও দ্বিতীয়বার আসার সাহস দেখিয়েছিল।

প্রেক চু।

যাইহোক, খেয়েদেয়ে আবার রওনা হলাম। এইবার আমি ল্যাদ খেতে শুরু করলাম। চড়াই বাড়তে শুরু করলো, আগেও দুবার এসেছি, ফলে আমি দিব্যি জানি যে এরপরই আসল চড়াই শুরু, কিন্তু আমি ঢিকঢিক করতে করতে লটবহর নিয়ে সবার শেষে ঘন্টাখানেক হাঁটার পর তৃতীয় ব্রিজে এসে একটু ধাতস্থ হলাম। এটা খুব ছোট্ট একটা সিমেন্টের ব্রীজ। নিচ দিয়ে যে নদীটা বয়ে যাচ্ছে তার নাম মেনটগাং খোলা। প্রায় সাচেন চলে এসেছি, আর আধ ঘন্টা মতো লাগবে। সাচেনের একটু আগে থেকেই দেখছি কমলা, হলুদ টেন্ট। বাব্বা কত লোক আজ সাচেনে? দেখলাম বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ে সব দৌড়ে বেড়াচ্ছে; বুঝলাম কোনো স্কুল থেকে এসেছে। আলাপ হলো ওদের শিক্ষকদের সাথে। ৪০ জনের দল নিয়ে কলকাতার এক স্কুল এসেছে। কী যে ভালো লাগলো ওদের দেখে। রঙিন প্রজাপতির মতো সব জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওনারা ভেবেছিলেন জোঙ্গরি পর্যন্ত যাবেন কিন্তু দুএকটি বাচ্চার প্রবলেম হওয়ায় ওনারা ফেদঙ অব্দি যাওয়ার চেষ্টা করবেন। সাচেনে কাল এসেছেন, আজ থাকবেন তারপর আস্তে আস্তে উঠবেন, এটাই তো ট্রেকের মজা। যেটুকু পৌঁছনো যায়, সেটাই আনন্দের। ওদের সঙ্গে লজেন্স দেওয়া-নেওয়া করে আবার চলা শুরু।

সাচেন থেকে ট্রেইল নামতে শুরু করল, নামতে নামতে একদম প্রেক-চুর গায়ে পৌঁছে গেলাম। বড় ব্রিজ প্রেক-চু’র ওপর, এটাই ফোর্থ ব্রিজ, নিচে দিয়ে ভীষণ গর্জন করে বয়ে চলেছে নদী। অন্য পারে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিতেই হবে। যেন ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়- সবুজ ঠাসা জঙ্গল, ওক গাছের প্রাধান্য বেশি, নিচে সেই তিন-বীজ ওলা ফল পড়ে আছে। চুপচাপ খানিক বসলাম। বাঁ দিক দিয়ে ট্রেইল খাড়া ওপরে উঠে গেছে। এতো হেঁটে এখানে এসে প্রথমেই যারা এরকম খাড়া ট্রেইল দেখবে তারা ভয় পেয়ে যাবে। মনে পড়ে গেলো আশীষদার কথা। এইখানে অবধারিতভাবে প্রসাদ বানিয়ে ও নিজেও খেত আর পোর্টার এবং আমাদের মধ্যে যারা প্রসাদপ্রার্থী তাদের দিয়ে মৌজ করে টান লাগিয়ে বলে উঠতো- ‘ আরে এতো ভাবছিস কেন? এ রাস্তা কঠিন মনে হচ্ছে? কোনো চিন্তা নাই, শুধু চাপ দিবা, চলে যাবা, না গেলে খাবা কি?’ লিখতে গিয়েই ভয়ঙ্করভাবে তুমি ঘুরে ফিরে আসছো আশীষদা! ধুৎ, চলুন তো, উঠে হাঁটা শুরু করি।

প্রেক চু।

আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করলাম। এখন প্রায় দুটো বাজে, বাখিম পৌঁছতে আমার প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগবে। অন্যরা এগিয়ে যাক, আমি আস্তে হাঁটি। এ রাস্তায় চড়াই প্রচুর, আর ভীষণ ভীষণ সুন্দর জঙ্গল। এ দুটোর জন্যই আমার দেরি। আগে দুবার এসেছি বলে রাস্তাটা চিনি, তাই আরো তাড়াহুড়ো নেই। আমার মতো অলস লোকের এটাই তো আসল ল্যাদ করার সময়। উঠছি পা গুনে গুনে, ওপরে তাকাচ্ছিনা, তাহলেই তো মনে হবে, ওরে বাবা এতটা উঠতে হবে! থামছি প্রায়শই, থামলেই নিঝুম এক রূপকথা। আমি একা, পায়ের শব্দ থেমে গেলেই জঙ্গলের অন্য শব্দরা আস্কারা পাচ্ছে। টানা কিরকিট কিরকিট আওয়াজ, পাতার সরসর শব্দ, কোথায় দূরে পাখি ডাকছে। বিকেল গড়িয়ে গড়িয়ে ঢালু রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যের দিকে নামছে এই বিশাল জঙ্গলে, পাহাড়ে। নিচে প্রেক-চু’র সশব্দে বয়ে যাওয়া, কখনো ভীষণ গর্জন, কখনোবা মৃদু টানা আওয়াজ। এতো কপালও আমার ছিল?

এ ঝিমঝিম রাজ্যে আমার পা পড়েছে, আমি গর্বিত। নিজের মনে বকবক করতে করতে আমি হাঁটছি। বেশ ওপরে উঠে আসার পর একটা বড় বাঁক, প্রথম রডোডেনড্রন গাছ চোখে পড়ল এখানেই। শুরু হয়ে গেলো লীলাখেলা। আর চিন্তা কি? একটু পা চালিয়ে চলি এবার।

এসে পড়লাম বাখিম। ট্রেইলের গা দিয়ে ঢালু জমি নিচে নেমে গেছে। ওখানে একটি ছোট্ট দোকান এক বইনির, মানে এক নেপালি বোনের। দুটি বাচ্চা নিয়ে থাকে, আর দোকানদারি করে। ওই রুটি সবজি, ডিম এসব পাওয়া যায়, আর পাওয়া যায় মহার্ঘ বস্তু, ছাং আর তোম্বা। অসাধারণ বানায়। প্রথমবার যখন এসেছিলাম তখন ওর দোকানের সামনেই তাঁবু খাটিয়ে ছিলাম। নিচে প্রেক-চুর গর্জন আর আমাদের তাঁবু ঘিরে কুকুরের চিৎকার সারারাত আমাদের ঘুমাতে দেয়নি। ওই দোকান ছাড়িয়ে একটু এগোলেই বাঁদিকে ফরেস্টের দোতলা রেস্ট হাউস। শুনেই ভাবছেন তো তোফা ব্যবস্থা? আজ্ঞে না, ২০০৩ এ খুবই ভালো অবস্থায় ছিল, সেবার জায়গা না পেয়ে টেন্টে ছিলাম। ২০০৮ ও মোটামুটি ঠিকই ছিল, কিন্তু আমরা তো সোকায় ছিলাম সেবার।

বাখিম যখন ঢুকছি, তখন প্রায় সন্ধ্যা। ডানদিকে বইনির দোকানে টিমটিম করছে আলো, সেখানে আমাদের কেউ নেই। বুঝলাম এবার ফরেস্ট রেস্ট হাউস পাওয়া গেছে। খুব আনন্দ পেলাম, সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, কেমন যেন একটু ভূতুড়ে লাগছে। ভাবলাম আলো নেই বলে এরকম লাগছে। ওদের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ভেতরে ঢুকলাম… কেউ কোত্থাও নেই!! আমাদের দুয়েকজনের চেনা গলা ওপর থেকে পাচ্ছি, সঙ্গের হেড ল্যাম্প পরেই নিয়েছিলাম, ওটা দিয়েই দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকলাম। ওপর থেকে আওয়াজ পেলাম, সাবধানে উঠবি, সিঁড়ির সব ধাপ নেই! বলে কি? দেখলাম ও তাই… কাঠের ধাপগুলো ভেঙেচুরে গেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠলাম ওপরে, মুখে এক বন্ধু মোমবাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে। মেঝের কাঠের পাটাতন কোথাও আছে, কোথাও নেই। ওরে বাবা! থাকবো কি করে এখানে? একটা মোটামুটি ঠিকঠাক ঘর বেছেছে ওরা, সেখানে ঢুকলাম, ঘরের মোটামুটি সব পাটাতনই আস্ত আছে, শুধু মাঝখানে একটা বিশাল হা!!! মানে রাতে বাথরুমে যেতে হলে সোজা হা দিয়ে ঝাঁপ মারলেই নিচে! ভবলীলা সাঙ্গ!

দূরত্ব ও উচ্চতা, নেট থেকে সংগৃহীত।

যাক, জিনিসপত্র নামিয়ে গুছিয়ে বসলাম। মোমবাতির আলোয় মুড়িমাখা হলো, আর নিচে কাটুক, মানে আমাদের গাইড আর কুক রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। আমাদের নিয়মমতো আমরা ব্র্যান্ডির বড় মগ নিয়ে আড্ডায় বসে পড়লাম। শুনলাম ২০১১তে ভূমিকম্পে বাড়ির এই দশা হয়েছে। তিনবছরে আর হাতও দেয়নি। বাইরে নাকি দেওয়াল খুলে ঝুলছে। তবে কাটুক বলেছে বাড়ি ভাঙবেনা। সেই ভরসায় আমরা ভেতরে সেঁধিয়েছি। মনে পড়ে গেলো ২০০৮এ আমরা ফেরার সময় এখানে ছিলাম। ট্রেক শেষের যে বড়াখানা হয়, তা এখানেই হয়েছিল। মুরগি ওই বইনি সাপ্লাই দিয়েছিলো, ফাটাফাটি রান্না করেছিল, অনেক রাত পর্যন্ত গান, আড্ডা আর আশীষদার উদ্দাম নাচ… সাথে আমাদের তাল মেলানো… কোথায় চলে গেল সেসব… বাড়িটাও দুঃখে ভেঙে পড়েছে!

রাত ৯ টা নাগাদ খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা বাইরে এলাম একটু ঘোরাঘুরি করতে। পূর্ণিমা গেছে কদিন আগে। গাছগুলো চাঁদের আলোয় স্নান করছে। হলুদ বাড়িটা হঠাৎই মোহময় লাগছে। সামনের ওক গাছ আর দূরে দূরে রোডোডেন্ড্রোনেরা চুপচাপ জ্যোৎস্না মাখছে সারা শরীরে। ঘুম ঘুম চরাচর নিচে প্রেক-চু সঙ্গত করছে শুধু। মনে হচ্ছে কোথাও যেন আশীষদা আছে আশেপাশেই। ট্রেডমার্ক উবু হয়ে পাথরের ওপর বসে আছে, হাতে বিড়ি, আর অনর্গল বলে চলেছে পাহাড়ে হাঁটার স্বপ্নময় গল্প।

‘দাঁড়াবে- কথার কথা, শুয়ে থাকতে হবে
বন্ধু ও শত্রুকে ছেড়ে শুয়ে থাকতে হবে
একা একা, কোনোরূপ আসক্তিব্যতীত
হিরন্ময় আলো আসবে তোমাকে জানাতে
অভ্যর্থনা I
নিজেও জানো না
নিজের প্রাসাদ ছেড়ে কেন যে কুটিরে যেতে চাও!

যাওয়া ভালো, যেতে পারা ভালো !! ‘

চলবে …

অন্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে

গোচা লা ট্রেকঃ পিনাকেতে লাগে টঙ্কার (পর্ব ১)
গোচা লা ট্রেকঃ নেড়া আবার বেলতলায় (পর্ব ৩)
গোচা লা ট্রেকঃ সন্ধ্যে যেখানে রাত্রির সন্ধানে (পর্ব ৪)
গোচা লা ট্রেকঃ জোঙ্গরির রাত-ভোর (পর্ব ৫)
গোচা লা ট্রেকঃ কোকচুরাঙ ছুঁয়ে থানসিং (পর্ব ৬)
গোচা লা ট্রেকঃ ধূসর রূপের পান্ডিম (পর্ব ৭)
গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)
গোচা লা ট্রেকঃ ফিরে চলা ঘুম ঘুম রূপকথা ছেড়ে (শেষ পর্ব)

লিখেছেনঃ শুভময় পাল। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স শুভময়ের প্রিয় জায়গা। অজানা, অচেনা জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘোরা নেশা শুভময়ের।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

গোচা লাগোচা লা ট্রেকঃ পিনাকেতে লাগে টঙ্কার (পর্ব ১)
গোচা লাগোচা লা ট্রেকঃ নেড়া আবার বেলতলায় (পর্ব ৩)

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

গোচা লাগোচা লা ট্রেকঃ পিনাকেতে লাগে টঙ্কার (পর্ব ১)
গোচা লাগোচা লা ট্রেকঃ নেড়া আবার বেলতলায় (পর্ব ৩)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

গোচা লাগোচা লা ট্রেকঃ পিনাকেতে লাগে টঙ্কার (পর্ব ১)
গোচা লাগোচা লা ট্রেকঃ নেড়া আবার বেলতলায় (পর্ব ৩)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!