স্মৃতি সত্তায় প্রবল টান, এফোঁড় ওফোঁড় তোলপাড় মনোজগৎ, ঘুম ঘুম রূপকথার মতো যে শুয়ে ছিল নিশ্চিন্তে মনের কোন গভীর গোপন কুঠুরিতে, কে জানতো সে ছিল এমন স্বপনচারিণী? অতলান্ত অবচেতনে তার যে এমন অগাধ বিচরণ তাতো এতদিন এতটুকুও বুঝতে পারিনি!! রানী মৌমাছির জন্য যেমন মৌচাকে তৈরী করা হয় ‘আম্ব্রোসিয়া’, পুষ্টিকর খাদ্যের কুঠুরি, সকল শ্রমিক মৌমাছির নাগালের বাইরে সযত্নে রক্ষিত, ঠিক তেমনিই আমার ভেতরে এভাবে সযত্নে রাখা ছিল গোচা লা ট্রেকের এতো স্মৃতি, এ আমি কল্পনাও করিনি।
লিখবো বলে যখন এই গোচা লা ট্রেকের ছবিগুলো বের করলাম, হুড়মুড়িয়ে কোথা থেকে সব্বাই চলে এলো। এ জামা ধরে টানে, তো ও প্রায় অনশনে বসার অবস্থা! কি করি? কিংকর্তব্যবিমুড়!!! কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলামনা কি করবো? তিনবার আমি এই রাস্তায় গেছি, কোন বারেরটা লিখবো? শেষমেশ ঠিক করলাম শেষ বারের ট্রেকের খুঁটিনাটিই লিখবো, সাথে তার আগের দুবারের স্মৃতিচারণা। ওই ভালো বাংলায় (!!) যাকে ফ্ল্যাশব্যাক বলে। বেশ সিনেমার মতো ফিরে ফিরে যাবো আমার পুরোনো স্মৃতির কাছে নতুন স্মৃতি নিয়ে রোমন্থন করতে করতে।
তো যা বলছিলাম, ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে যাওয়া ঠিক হলো আবার গোচা লা ট্রেকে। এর আগে একেবারে কিছু না জেনে গেছিলাম ২০০৩ এ, তারপর বেশ অনেকটা জেনে ২০০৮ এ। ২০০৩ এ জোংরি পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছিলাম একেবারে অজানা কোনো কারণে, বোধহয় শুনেছিলাম যে খুব কঠিন জোংরির পরের রাস্তা। এছাড়াও সেবার আমরা তেমন তৈরী হয়েও যাইনি, খাবার-দাবারেও টান পড়েছিলো। ২০০৮ এ আমরা পুরোটাই করতে পেরেছিলাম।
২০১৩ য় আমার খুবই কাছের দুজন মানুষকে হারিযেছিলাম। তার মধ্যে একজন আমার ট্রেকের শিক্ষাগুরু। কিছুই ভালো লাগছিলনা, ভীষণই মুষড়ে পড়েছিলাম। আমার ট্রেকের বন্ধুরা প্রস্তাব দিলো আবার গোচা লা যাওয়ার। আমরা ঠিক করলাম যে এই গোচা লা ট্রেকে আমরা আমাদের দাদা কাম বন্ধু, যাকে আমরা হারিযেছি, তার স্মৃতিচারণ করে, পুরনো স্মৃতি নাড়াচাড়া করে তাকে শ্রদ্ধা জানাবো।
শুরু হলো প্রাক-ব্যবস্থাপনা, টিকিট কাটা, যোগাড়যন্ত্র করা। প্রথমেই পড়লাম মুস্কিলে। ২০০৮ এ সিকিমের ইয়াকসামের আং শেরপা সব ব্যবস্থা করেছিলেন। এবারো ওনাকেই বলা হয়েছিল। আমরা রওনা হওয়ার ঠিক দুদিন আগে উনি জানালেন যে উনি পারবেননা, বিদেশি বড় টিম আসছে, উনি তাদের সব দায়িত্ব নিয়েছেন, তাই উনি অপারগ!!! আসল কারণ হলো টাকার চেয়ে ডলার দামি!! তবে এই মানুষটার অন্য পরিচয়ও আছে, সেটা পরে বলছি। যাই হোক, তখন আমাদের শিরে সংক্রান্তি। বহু জায়গায় যোগাযোগ করেও কিছুই সুরাহা হলোনা। আমরা দার্জিলিং মেলে চেপে বসলাম। ছোট্ট করে জানিয়ে রাখি এই গোচা লা ট্রেক শুরু হয় ইয়াকসাম থেকে।
রাতে ট্রেনে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম যে আং শেরপা কেন এরকম করলো? এতো বিশিষ্ট ভদ্রলোক!!! ২০০৮ এ যখন গেছিলাম উনি সব ব্যবস্থা করেছিলেন। মনে আছে সন্ধে হয়ে গেছিলো তখন। পেলিং পেরিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস এর ওখানে রাস্তা ভেঙে নিচে চলে গেছে। উনি গাড়ি পাঠিয়ে আমাদের ইয়াকসাম নিয়ে এসেছিলেন। ওনার নিজের ছোট হোমস্টে, সেখানেই ছিলাম। রাতে গল্প করতে করতে জেনেছিলাম উনি দুবার এভারেস্ট ক্লাইম্ব করেছেন। টাকা পয়সার অভাব আর বয়সজনিত কারণে এখন এই হোমস্টে চালান, আর ট্রেক এর ব্যবস্থা করেন। এতটাই সেনসিবল মানুষ উনি যে আমরা যেদিন ২০০৮ এ গোচা লা ট্রেক করে ফিরেছিলাম, আমরা বাঙালি, বহুদিন মাছ খাইনি ভেবে উনি রাতে ভাত আর ট্রাউট মাছের ঝোলের ব্যবস্থা করেছিলেন। ভাবা যায় !!! সেই মানুষ কিনা শেষ মুহূর্তে আমাদের এরকম ডোবালেন। তাহলে কি এই ৬ বছরে ওনার এতো পরিবর্তন হয়েছে? চিন্তা করতে করতে বুঝেছিলাম যে অত বড় একজন পর্বতারোহী জীবনে কি পেয়েছেন? কিছুই না, উনি তো এই ট্রেক এর ওপরই নির্ভরশীল, ফলে যেখানে বেশি টাকা পাবেন, উনি তো সেদিকেই যাবেন। আমরা যখন ওনাকে প্রাপ্য সন্মান দিতে পারিনি, তখন উনি ওনার ব্যাপারটুকু তো বুঝে নেবেনই, এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছি। ঘুম ভাঙলো ভোরের মৃদু আলোয় আমার প্রিয় উত্তরবঙ্গে। আঃ ট্রেনের দরজার কাছে গিয়ে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলাম। ছোট ছোট চা বাগান গুলো পেরোচ্ছি, দূরে আবছা নীলচে সবজে পাহাড়, এসে গেছি এনজেপি।
জোড়থাং ।
এনজেপি নেমেই মন ভাল হয়ে গেল। গাড়ি ভাড়া করা হল। সেবক এর আগে তিস্তার পারে ছোট রেস্তোরাঁতে মোমো খাওয়া হল। জোড়থাং এ দুপুরে অসাধারণ মুরগির ঝোল ভাত আর একটু বিয়ার খাওয়া হল। এসব যখন এক এক করে হতে শুরু করল, মন খারাপ রাও যেন টাটা বাই বাই করে একটু ঘুরে আসতে গেল অন্য কোথাও, আমরাও দেখতে দেখতে গেজিঙ চলে এলাম এবং পথ হারালাম। মনে পরে গেল আগেরবারের রাস্তায় আটকে যাওয়া, আশীষদার (যে দাদা আর কোত্থাও নেই) পাগলামো, আমাদের ক্যাপ্টেন এই সারা রাস্তা পাগলের মত অরেঞ্জমেন্টের জন্য ফোন করে গেল। অবশেষে পাওয়া গেল কাটুক নামের একটি ছেলের নাম, যে নাকি খুব ভালো ছেলে। রাস্তা হারিয়ে ঘুরে ঘুরে যখন ইয়াকসামে ঢুকলাম, তখন সন্ধ্যে প্রায়। দেখলাম অনেকটাই বদলেছে ছোট্ট সুন্দর গ্রামটা।
ইয়াকসাম
এই সুন্দর গ্রামটার ওপর একটু আলোকপাত করি। গেজিং সাবডিভিসিনের মধ্যে এই গ্রাম। এটাই ছিল সিকিমের প্রথম রাজধানী। ১৬৪২ সালে ফুতসং নামগয়াল এই সিকিম রাজ্য তথা রাজধানীর প্রতিষ্ঠা করেন। ইয়াকসমে ঢুকে একটু এগোলেই দেখা যাবে একটি ছোট টিলা ওপরে উঠে যাচ্ছে। ওই টিলার ওপরে একটি সুন্দর মনাস্ট্রি। ওখানেই তিনটি পাথরের ওপর তিনজন সন্ন্যাসী ধ্যানে বসেছিলেন বলে কথিত আছে এবং ওখানে বসেই এই সিকিম দেশটির প্রতিষ্ঠা করেন। ওই টিলা ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে ঢুকলে বিশাল একটি লেক পড়বে। এতো সুন্দর লেক খুব কম দেখা যায়। ওপরের সুন্দর মনাস্ট্রি ছাড়াও নিচে আরেকটা মনাস্ট্রির কাজ প্রায় শেষ। অনেক হোমস্টে বেড়েছে, ছোট খাটো বাজার হয়েছে। আমরা বাজারের কাছেই একটা ছোট্ট হোমস্টে নিলাম। কাটুককে ফোন করে আসতে বলা হল, তখনও আমরা জানিনা টেন্ট, কুক, বাসনপত্র সব জোগাড় হবে কিনা? আমরা কাল বেরোতে পারব কিনা?
কাটুক আসার আগেই আমরা কাঁচা বাজার সেরে ফেললাম। ওই আলু, পিয়াঁজ, রসুন, আদা, চাল, ডাল, তেল, নুন এইসব। কাটুক এলো তখন রাত প্রায় আটটা, পাহাড়ে চারিদিক নিস্তব্ধ। কাটুক এলো আর মন জয় করে নিল। মিষ্টি একটি ছেলে, ঠিক ওর নামের মতোই। আং শেরপার নাম শুনেই সেলাম ঠুকলো আর আমরা যা বলছি তাতেই রাজি হয়ে যেতে লাগল। কিন্তু না, ওর বৌ ছিল ওর সাথে, সে কিছুতেই সব কিছুতে রাজি হতে দিলনা। সে এক অপূর্ব কথোপকথন। আমরা ধরুন বললাম যে তাহলে তুমি টেন্ট এর জন্য কত নেবে? ও বললো এতো, সাথে সাথে ওর বৌ ওকে পাশে ডেকে নিয়ে সিকিমিসে ফিসফিস করলো, ও ফিরে এসে বললো, নেহি সাব থোরা জাদা লাগেগা!!! অবশেষে ঠিক হল, আমরা আটজনের দল, তার সাথে ও যাবে, একজন কুক কাম পোর্টার যাবে, সাথে দুটো খচ্ছর আর তার মালিক। টেন্ট আমরা একটা এনেছি, বাকি ও দেবে, স্টোভ, কেরোসিন আর বাসনকোসনও দেবে, সব মিলিয়ে আমাদের পার হেড ট্রেক করার খরচ হিসেব করে দেখা গেলো পাঁচ হাজার করে পড়বে। সবিস্তার ট্রেকের খুঁটিনাটি হাঁটতে হাঁটতেই নয় বলবো।
ইয়াকসামে হোমস্টে
চলে গেল কাটুক, আমরাও শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালবেলা ফরেস্ট অফিস থেকে পারমিট করে কাটুক আর ক্যাপ্টেন পরে রওনা হবে, তার জন্য কাটুককে আমাদের ফটো আর পরিচয়পত্রের কপি দিয়ে দেওয়া হল। শুয়ে শুয়ে আবার মনে পড়লো আশীষদাকে, মনে পড়লো ২০০৩ এর সেই প্রথম গোচা লা ট্রেকিং এর কথা। এই ইয়াকসমে এসে সেবার ছিলাম হেলিপ্যাডের দিকে। ফরেস্ট পারমিট অফিস হল লেক পেরিয়ে, সে সব করে রওনা হয়েছিলাম অনেক বেলা করে। ২০০৮ এ আবার ভীষণ গুছিয়ে ট্রেক হয়েছিল। এই আং শেরপার সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ করে সব ঠিকঠাক করে ট্রেক শুরু করেছিলাম। মনে আছে আশীষদার পেছন পেছন পোর্টার দুটো সারাক্ষণ ঘুরঘুর করতো প্রসাদ পাওয়ার লোভে আর আশীষদা ওদের সাথে একদম বন্ধুর মতো মিশে যেত। আজ এই ছোট্ট ইয়াকসমে গহন গভীর রাতে আবার ভীষণ মনে পড়ছে তোমায় …
‘যে দুঃখ পুরোনো তাকে কাছে এসে বসতে বলি আজ
আমি বসে আছি, আছে ছায়া, তার পাশে যদি দুঃখ এসে বসে
বেশ লাগে, মনে হয়, নতুন দুঃখকে বলি, যাও
কিছুদিন ঘুরে এসো অন্য কোনো সুখের বাগানে
নষ্ট করো কিছু ফুল, জ্বালাও সবুজ পাতা, তছনছ করো
কিছুদিন ঘুরে দুঃখক্লান্ত হও, এসো তারপর
পাশে বসো
এখন পুরোনো এই দুঃখকে বসার জায়গা দাও
অনেক বাগান ঘুরে, মানুষের বাড়ি ঘুরে, উড়িয়ে-পুড়িয়ে
এ আমার কাছে বসতে চায় কিছুদিন থাক
শান্তি পাক, সঙ্গ পাক এসো তারপর
ও নতুন দুঃখ তুমি এসো তারপর’
চলবে …
পরবর্তী পর্বগুলো পড়তে চাইলে
গোচা লা ট্রেকঃ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে (পর্ব ২)
গোচা লা ট্রেকঃ নেড়া আবার বেলতলায় (পর্ব ৩)
গোচা লা ট্রেকঃ সন্ধ্যে যেখানে রাত্রির সন্ধানে (পর্ব ৪)
গোচা লা ট্রেকঃ জোঙ্গরির রাত-ভোর (পর্ব ৫)
গোচা লা ট্রেকঃ কোকচুরাঙ ছুঁয়ে থানসিং (পর্ব ৬)
গোচা লা ট্রেকঃ ধূসর রূপের পান্ডিম (পর্ব ৭)
গোচা লা ট্রেকঃ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় (পর্ব ৮)
গোচা লা ট্রেকঃ ফিরে চলা ঘুম ঘুম রূপকথা ছেড়ে (শেষ পর্ব)
লিখেছেনঃ শুভময় পাল। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স শুভময়ের প্রিয় জায়গা। অজানা, অচেনা জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘোরা নেশা শুভময়ের।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
