ফিরছি সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনা থেকে। লবুচে থেকেই ফেরার পথে শুরু হল তুষারপাত। কিন্তু অবশেষে সফল হয়ে বাড়ি ফিরছি এই ভালোলাগায় তুষারপাতেও রীতিমত এক আলাদা ভালোলাগায় ফিরতি পথে চলছি। দেখতে দেখতে সেই দুই ট্রেইলের জংশন পার করে পৌঁছে গেলাম সেই বিখ্যাত শেরপাদের সমাধিক্ষেত্রে। এই প্রথম দক্ষিণ ভারতের একটি যুবক যুবতীদের জনাদশেক ট্রেকারের একটি দলের সাথে দেখা। কিন্তু খুশি হওয়ার পরিবর্তে রীতিমত ভারতীয় হয়ে কিছুটা লজ্জিতই হতে হল। যেখানে অনান্য দেশের ট্রেকাররা সমাধিক্ষেত্রগুলোয় হিমালয়কে ভালোবাসতে গিয়ে তার বুকেই চিরতরে চিরঘুমে হারিয়ে যাওয়া অভিযাত্রী, শেরপাদের সেই খোদিত ইতিহাস পড়ে তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিলেন, সেখানে এই দলটি সেখানে মোবাইলে গান চালিয়ে রীতিমত পিকনিকের মেজাজে।
দ্রুত নেমে আসলাম দুগলার দিকে। চিরচারিত রুট হওয়ায় দুগলার পথে ট্রেকারের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু এরপরেই ফিরচের পথে ফেরার পথটি মূল রাস্তাটি থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায় রীতিমত জনমানবশূন্য এই ট্রেকিংয়ের পথটি। তুষারপাতের মাঝে দুগলায় পরিবেশ প্রায় মেঘাচ্ছন্ন। গ্লেসিয়ারের এক বোল্ডার জোনের মাঝে বয়ে চলা জলধারার ওপর নির্মিত একটা ছোট ব্রিজ পার হয়ে, অন্যপাশের রিজটা ধরে ক্রমাগত নামতে থাকলাম। ক্রমাগত নিম্নমুখী এই পথে ট্রেক অনেক সোজা হলেও, হাঁটতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম যেই চরণ আমার একমাত্র ভরসা ছিলো এই পথে সেই চরণকেই মূল্য দিতে হয়েছে আমার সফলতার। তবে জুতো খোলার একেবারেই ইচ্ছে ছিলনা।
হেঁটে নেমে এলাম একটি বিশাল প্রান্তরে। বিশাল সমতল এই প্রান্তরের চারপাশে মেঘের আড়ালে তখন হিমালয়ের শৃঙগগুলো। ইয়াকের পদচারণায় কর্দমাক্ত এই প্রান্তরে হেঁটে বোঝার উপায় নেই এখনও প্রায় চারহাজার মিটার উচ্চতায় হাঁটছি। রীতিমত দার্জিলিং যাওয়ার পথে রোহিণীর কোন এলাকায় হাঁটছি যেন। অবশেষে তুষারপাতের মাঝে একটা সেটেলমেন্ট দেখে দাঁড়ালাম। সেখানে এক দিদির কাছে জানতে পারলাম এখান থেকে ফেরিচে আর মাত্র ২০-৩০ মিনিট দূরে। যাক নিশ্চিত হয়ে দিদির দোকানেই বসে পড়লাম একটু চায়ের আড্ডায়। চায়ের বিরতিপর আবার হেঁটে অবশেষে বিকেল তিনটায় ফেরিচে পৌঁছালাম।
ফেরিচে এই এলাকার শেষ গ্রাম হলেও বিশাল বিশাল হোটেল, আর চারিদিকে হোটেলের গায়ে ফ্রি ওয়াই-ফাই দেখে একে ঠিক ভারতের হিমালয়ের দূরবর্তী গ্রামগুলোর সাথে তুলনা করা যায়না। চারিদিকে পাশ্চাত্যের ট্রেকারদের ছড়াছড়ি। অনেকেই সফল হয়ে ফিরেছেন এদের মধ্যে। রীতিমত সকলেই পিকনিকের মেজাজে। কিন্তু আমরা ফেরিচে ছেড়ে আজকেই ট্যাংবোচে পৌঁছানোর লক্ষ্যে এগোতে থাকলাম। আর হাঁটতে পারছিলাম না কিন্তু বাড়ি ফিরতে হলে চেষ্টা করতেই হবে। ফোনের নের্টওয়ার্ক আসায় বাড়িতেও যোগাযোগ করতে পারলাম অনেকদিন পর। এদিকে সূর্য প্রায় অস্তাচলে। আজ আর এই পা নিয়ে থ্যাংবোচে পৌঁছানো যাবেনা বুঝতে পারলাম। তবে গোধূলির আলোয় সেই বিখ্যাত আমাদ্যব্লম শৃঙগকে দেখতে পেয়ে কিছুটা কষ্ট লাঘব হল। কিন্তু এরপর শুরু হল সমস্যা। রীতিমত ট্রেকারে গিজগিজ করছে লজগুলো। সবক্ষেত্রেই লজগুলোয় খোঁজ নিতে গিয়ে একই উত্তর, “থাকার জায়গা নেই।” অবশেষে অন্ধকারেই হেঁটে অনেক আবেদন নিবেদন করে দেবুচেতে থাকার জায়গা পেলাম। বুঝতে পারলাম অনেকক্ষেত্রেই লজের মালিকরা রুম ফাঁকা থাকতেও নেই নেই করে এই ভেবে যদি কোন বিদেশী ট্রেকারদের কাছে আমাদের মতন অবস্থায় অনেক বেশী রুমচার্জ নেওয়া যায়। যদিও আমাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোন অর্থ নেওয়া হয়নি।
রুমে প্রবেশ করে জুতো খুলতেই চোখ ছানাবড়া। পায়ের দশটা আঙগুল সহ পুরো পায়ের তালুটাই ক্ষতবিক্ষত। অনেক কষ্টে হেঁটে বাথরুমে পৌঁছে, জলে পা দুটো পরিষ্কার করে, আয়োডিন ওয়েটমেন্ট লাগিয়ে, গুনে গুনে দশটা বেন্ডএইড লাগিয়ে, নতুন মোজা একেবারে পায়ে গলিয়ে পরের দিনের সংঘর্ষের জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করলাম। রাতে চিকেনকারি সাথে ভাত অসাধারণ লাগলো তবে খাওয়ার সময় এক অপ্রস্তুত প্রশ্নে একটু মাথা গরম করেও ফেললাম। স্থানীয় একজন যিনি হয়তো বাঙলা ভাষাটা আগে শুনেছেন। তিনি আমাদের বার্তালাপ শুনে বলেই ফেললেন “আমরা কি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।” বাঙলা যে ভারতেও বলা হয় সেটা আর ক্লান্তির জন্য বোঝানোর ইচ্ছাও ছিলনা ওনাকে।
পরের দিন খুব সকালে রওনা দিলাম থ্যাংবোচের পথে। দেখতে দেখতেই মাত্র কুড়ি মিনিটেই পৌঁছে গেলাম সেই বিখ্যাত এবং এই এলাকার সবচেয়ে বড় থ্যাংবোচে মনেষ্ট্রিতে। পায়ের অবস্থা তথৈবচ। খুব সর্ন্তপনে নামছি অনেক ধীরে ধীরে। পরিবেশ যথেষ্টই মেঘলা। পরিকল্পনা হিসেবে আজ আমাদের স্যাংবোচে এয়ারপোর্টে পৌছাতেই হবে এবং সম্ভব হলে সেখান থেকেই আজকেই কার্গো হেলিকপ্টার পেলে ফাপলু যেতে হবে। কারণ পায়ের এই অবস্থায় আবার নামচে থেকে সেই ফিরতি তিনদিনের ট্রেকপথে হেঁটে ফেরার ইচ্ছে একেবারেই আমার ছিলনা। কিন্তু প্রায়শূন্য এই পথে পথচলতি দুএকজন গাইডের কাছে জানতে পারলাম আবহাওয়া খারাপের জন্য কাঠমান্ডু থেকে লুকলার সমস্ত ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ফাপলুর হেলিও আজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সাথে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলাম এই ভেবেও যে দু-তিন দিন এভাবে আবহাওয়া খারাপ থাকলে আমরা পুরোপুরিভাবেই এখানে ফেঁসে যাবো। এরমাঝেই দেখা এক ভারতীয় মুম্বাইয়ের সমবয়সি যুবকের সাথে।
বাইরের দেশে নিজের দেশের মানুষ দেখে সত্যি আমরা কখনও ভুলেই যাই যে আমরা কেউ বাঙালি ও মারাঠি। ঠিক মনে হচ্ছিল মুম্বাই এ তো আমার শিলিগুড়ির পাশের শহর। সাংস্কৃতিক, জাতিগত পার্থক্য ও ভৌগলিক বিশাল দূরত্ব ভুলে আমরা তখন যেন হয়ে ওঠি এক পরিচয়ের। আর সেই পরিচয় হল ভারতবাসী। মুহূর্তকালেই একাত্ম হয়ে গেলাম তার সাথে। বেশ কিছুক্ষন গল্পও হল। তারিখ হিসেবে ওইদিন আইপিএলে বিকেলে মুম্বাইয়ের সাথে চেন্নাইয়ের খেলা পড়েছিল। আমি ইয়ার্কি করে বললাম “তুমি উত্তেজক একটা খেলা ছেড়ে কি করতে এই হিমালয়ে কষ্ট করতে এসেছো।” সফলতার আশা রেখে অনেকদিনের পরিচিত একটি বন্ধুকে যেনো বিদায় জানিয়ে, অগত্যা ট্রেকপথে হাজার সমস্যাতেও প্রত্যেকবার উদ্ধার হয়েছি এই ধনাত্মক চিন্তায় সানাসা গ্রাম হয়ে অবশেষে পৌঁছালাম সেই জংশনে, যেখানে আমরা এভারেস্ট মেইন ট্রেইলটা থেকে গোকিও ট্রেইলটায় আলাদা হয়েছিলাম।
একটা পুরো রাউন্ড ট্রেকপথ সম্পূর্ণ করার খুশিতে উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে তাকলাম উর্দ্ধমুখী পথটার দিকে যেটা স্যাংবোচের দিকে চলে গিয়েছে। নীচেই সেই নামচের পথ। ভালো হবে এই আশা রেখেই স্যংবোচের পথ ধরলাম। কিন্তু খারাপ লাগছিলো সেই যে নামচের দোকানে কুড়িটাকা বাকি ছিলো সেটা যে আর পরিশোধ করা হলোনা। কি ভাববেন সেই বৃদ্ধা মহিলা! যে তিনি বাকি রেখে বিশ্বাস করলেন আমাদের আর আমরা তার পরিবর্তে আমরা তার অর্থই মেরে দিলাম।
অবশেষে ট্রেক প্রায় শেষের পথে এই উত্তেজনায় আর ওপরে ওঠার সময় পায়ের আঙগুলগুলোয় তুলনামূলক কমচাপ পড়ায় রীতিমত দৌড়েই ওঠে যাচ্ছিলাম এই পথে। এসে পৌঁছালাম স্যার এডমন্ড হিলারির নিজের হাতে গড়া ছবির মতন সাজানো সেই বিখ্যাত খুঞ্জুম গ্রাম ও হিলারি স্কুলে। এরপর এভারেস্ট ভিউ হোটেলের রাস্তা পার করে কিছুটা চড়াই ভেঙেগ অবশেষে নজরে পড়ল একটা বড়সড় ফাঁকা মাঠ যার চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন সামগ্রী। একেবারে মাঝেই অনেকদিন যাবৎ অব্যাবহৃত এয়ারস্ট্রিপ। বুঝতে পারলাম ৩৮০০ মিটার উচ্চতায় এটাই স্যাংবোচে এয়ারপোর্ট। ঘড়িতে তখন দুপুর সাড়ে বারোটা মাত্র।
স্থানীয়দের কাছে আগেই শুনেছিলাম পরিত্যক্ত এই এয়ারপোর্টটির পাশের এক হোটেল থেকেই হেলিকাপ্টারের জন্য যোগাযোগ করা সম্ভব। সেই হোটেলে পৌঁছেই যোগাযোগ করে আশাহত হলাম। তিনি ফোন করে জানালেন যে আজ হেলি আসার সম্ভাবনা খুবই কম আবহাওয়া খারাপের জন্য। কিন্তু ওনার নিজেরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী ফাপলুতে থাকায় তিনি নিশ্চিতভাবে আশাম্বিত করলেন যে আগামীকাল সকাল ৭ টায় আসবেই। অগ্যতা ব্যাগ রেখে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে বাইরে বেরিয়েছি। কিছুটা রোদ উঠেছে। উষ্ণতা অনুভব করে বোঝা মুশকিল যে আমরা এখনও প্রায় ৩৮০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছি। ঠিক যেন মনে হচ্ছিল কয়েকশো বছর পর এক আলস্য দুপুর কাটাতে বসে আছি যার সামনে আর কোন লক্ষ্য নেই।
লাঞ্চে দুপুরে ভাত শেষবার দশদিন আগে খাওয়া হয়েছিলো। অবাক হয়েই যেন ভাত দিয়ে লাঞ্চ সারছি। এরপর আলস্যভাবেই কাটলো বাকি দিনটা। তবে এখানেও অবাক করার মত বাকি ছিলো। কিছু নামী শেরপা এখানে এভারেস্ট ক্লাইম্বিং ল্যাডারে ঘরের চাল ঠিক করছিলো। ঘোড়া বাঁধা রয়েছে ক্লাইম্বিং রোপ আর ক্যারাবিনার দিয়ে। আর মাঝে মাঝে ছোট হেলিগুলো আসছিলো দিগন্তজুড়ে শব্দ করে। বারবার মনে হচ্ছিলো আমাদের যানটা নয়তো!
পরেরদিন সকালেই সবগুছিয়ে প্রস্তুত হলাম। সকালের তাপমাত্রা যথেষ্টই শীতল এয়ারপোর্ট। কিন্তু আজ আবহাওয়া একেবারে পরিষ্কার। চারিদিকে মনমুগ্ধোকর থাকসেরকু, কংডে, কুসুমকাংরুক মত বিখ্যাত শৃঙগগুলো উজ্জ্বল অস্তিত্বে বিরাজমান।
চলবে…
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (১ম পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (২য় পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৩য় পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৪র্থ পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৫ম পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৬ষ্ট পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৭ম পর্ব)
লিখেছেন তাপস কুমার রায়। স্বাস্থ্যদপ্তরে এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন। নেশা- ক্রিকেট, ট্রেকিং, ইতিহাস ও একটু আলাদা টাইপ অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ আর সাপ।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।