চলেছি সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় । জোংলা থেকে আজ সকালে অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে ট্রেক শুরু করলাম। একে তো চোলাপাস পার করেছি। তারপর আজ সকলেই আশ্বস্ত করলেন তেমন চড়াই নেই খুব একটা। এছাড়াও টার্গেট অনুযায়ী সময় পেলে আজকেই আমাদের গোরখশেপ পৌঁছে এভারেস্ট বেসক্যাম্প করার কথা। সামনেই রাজকীয় অস্তিত্বে দাঁড়িয়ে চোলাৎসে। বেস থেকে চূড়ো পুরো পাহাড়টাকেই জোংলা থেকে দেখা যায়। যেন এভারেস্টের সেনাপতি দাঁড়িয়ে তার পাহারায়। জাপানীদের আলাদা আকর্ষণ এই শৃঙগটি জয় করার। সামান্য চড়াইয়ে একে একে দৃশ্যমান লোৎসে, নুপসে এরপর আবার সেই বিখ্যাত আমাদ্যাব্লম কিন্তু একেবারেই অন্য অ্যাঙ্গেলে।

জোংলার সকাল।

গ্লেসিয়ার ওপাশেই অনেকটা নীচে দেখা যাচ্ছিলো এই রুটের সর্বশেষ গ্রাম ফেরিচেকে। ওপাশ দিয়েই এগিয়ে দুগলা হয়ে এগিয়ে আসছে এভারেস্ট বেসক্যাম্পের মেইন ট্রেইলটাও। ঠিক যেন পাহাড়ের রাণীর আশিসে দাঁড়িয়ে পুমোরী শৃঙগটাও। সবকিছুই রাজকীয় পরিবেশ, পাহাড়। পাশ্চাত্যের ট্রেকারদের ট্রেকিং পোল, ড্রেসিং সবকিছুই পারফেক্ট। শুধু ভিখারি বলতে আমরাই। সাধারণ জ্যাকেট আর ট্রাকশুট। আর হাতে ইকোফ্রেন্ডলি গাছের ডাল ট্রেকিংস্টিকের বদলে। ওদের এনার্জি ড্রিংক আর চকলেটের বিপরীতে আমাদের ভরসা ছাতুর জল, ছোলা আর চিড়ে। ফিরতি নেপালী গাইডরা দেখেই বুঝতে পারছে “এরা বন্ধু রাষ্ট্রের গরীর ট্রেকার।”কিন্তু এই কয়েকদিনে কোন ভারতীয় ট্রেকারও চোখে না পরায় কেমন জানি থেকেও কিছু একটা নেই নেই অনুভূতিও হচ্ছিল মাঝে মাঝে।

সেই বিখ্যাত চোলাৎসে।

নেমে এলাম একটা সমান আইসফিল্ডে। সামনেই দুটো ট্রেইল মিশে গেলো একেবারে জংশনে। এরপর একটা বিশাল মাঠ বরাবর ট্রেক করে সকাল ১০টায় পৌঁছে গেলাম লবুচে। কিছু শুকনো খাবার খেতে শুধুমাত্র বসেছি একটা পাথরে,  একজন পেছন থেকে চিৎকার করে আমাকে সরে যেতে বললেন। কিছু বোঝার আগেই দেখি উড়ে এলো একটা হেলিকপ্টার। কোন ট্রেকারকে রেসকিউ করার জন্য। সত্যি পৃথিবীর হয়তো আর কোথাও এরকম ট্রেকিংরূট নেই যেখানে প্রতি মিনিটে মিনিটে আকাশযান উড়ে  যায়। হেলিকপ্টারের চালক আসনে বসেছিলেন একজন মহিলা। মিনিটখানেই সময়েই মধ্যেই যাত্রী নিয়ে উড়ে গেলেন বেসক্যাম্পের দিকে। এতদুর এসে অসুস্থতাজনিত কারণে এভারেস্টকে না দেখেই ফিরে যাবেন, তাই হয়তো অতিরিক্ত কিছু অর্থ দিয়ে চালককে রাজি করিয়ে বেসক্যাম্প সহ এভারেস্ট দর্শন করিয়েই নামচে ফিরবে হেলিটি।

পাহাড়ের রানী পুমোরী।

লবুচে থেকে হালকা চড়াইয়ের অনেকটা চওড়া এক মাঠ বরাবর হাঁটছি। রাস্তা বানালে ফোর-লেন তৈরী করা যাবে এখানে নিশ্চিন্তে। নেপালের এই পথে যেভাবে আভিজাত্যের বাড়বাড়ন্ত, তাতে কোনদিন এই পথটুকুতে ট্রেকিংয়ের সাথে অতিরিক্ত পাওনা হিসেবে মাউন্টেইন বাইকিং চালু করলে এতটুকুও অবাক করবে না কাউকে। মাঠের শেষাংশের পর একটু চড়াই পার করেই দৃশ্যপটে ভেসে এল সেই বিখ্যাত খম্বু গ্লেসিয়ার। দূরে দেখা গেলো গ্লেসিয়ারের বুকে লিংট্রেন শৃঙগটার ঠিক নীচে কিছু হলুদ রঙের টেন্ট। উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকটা সময়। অনেক অনেক দূরে হলেও এই প্রথম দর্শন তার বেসক্যাম্পের। উত্তেজনাপূর্ণ ভাবেই রীতিমত দৌড়েই এরপর বেশকিছু চড়াই উৎড়াই পার করে বেলা ১২টা নাগাদ দেখতে পেলাম এই পথের সর্বশেষ সেটেলমেন্টের। বিশাল একটা মাঠ, চারিদিকে পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙগগুলোর মাঝে গোরখশেপ।

অন্তিম জলধারায় প্রতিফলন।

নীচেই শোনা গোরকশেপে ট্রেকারের সংখ্যাগত কারণে থাকা খাওয়ার দাম আকাশছোয়া। কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের লজটাতেই ১৫৬টা ঘর থাকায় এটা আশ্বস্ত হলাম যে এই রুটে রাতে থাকার ব্যাপারে কোনদিনই কোন সমস্যা নেই। একটু দরদাম করে ৩০০ রুপিতেই ডাবল বেডরুম পাওয়া গেলো। রুমে ঢুকতেই আবহাওয়া নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন শুরু হল। ভয়ানক তুষারপাতের ফলে মাত্র ৫ মিনিটেই চারদিক একেবারেই শ্বেতাভ বর্ণ ধারণ করলো। রুমের বাইরে চলে আসলাম। পুরবা শেরপার দলটাও তুষারস্নাত হয়ে পৌঁছে গেছে এখানে। বেসক্যাম্প থেকে আরও দুজন নেমে এসেছিলো। ভারতীয় ভেবে উচ্ছলতার সাথে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম আমার ধারণা ভুল। মালয়শিয়া থেকে এসেছেন তারা।যদিও একজনের ঠাকুমা জন্মসুত্রে ভারতের দিল্লির নিবাসী। মোবাইলে নেপালী গান চালিয়ে অগত্যা গাইড পোর্টারদের সাথে আড্ডায় বসে পড়লাম কারণ নিশ্চিত যে আজকে আর বেসক্যাম্প যাওয়া হচ্ছে না। প্রায় ১ ঘন্টা পর তুষারপাত থামলে, বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম গোরখশেপের তুষারাবৃত মাঠে। সেখানে তখন চলছিলো স্থানীয়দের ফুটবল খেলা। পৃথিবীর সর্বোচ্চ মাঠে ফুটবল খেলায় সুযোগ কে আর ছাড়বে! যোগদান করতে তাই দৌড়ে গেলাম মাঠে। পাশেই পাহাড়ের রাণী পুমোরী তার গৌরবময় ঐশ্বরিক রুপে দাঁড়িয়ে।

প্রথম দর্শনে বেসক্যাম্প।

চলবে…

• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (১ম পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (২য় পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৩য় পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৪র্থ পর্ব)
• সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৫ম পর্ব)

লিখেছেন তাপস কুমার রায়। স্বাস্থ্যদপ্তরে এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন। নেশা- ক্রিকেট, ট্রেকিং, ইতিহাস ও একটু আলাদা টাইপ অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ আর সাপ।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

ভিসাভারতীয় ভিসা এবং পোর্ট সমাচার
বৈজ্ঞানিক গবেষণার নামে বিপুল সংখ্যক তিমি হত্যায় লিপ্ত জাপান।বৈজ্ঞানিক গবেষণার নামে তিমি হত্যায় লিপ্ত জাপান

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

ভিসাভারতীয় ভিসা এবং পোর্ট সমাচার
বৈজ্ঞানিক গবেষণার নামে বিপুল সংখ্যক তিমি হত্যায় লিপ্ত জাপান।বৈজ্ঞানিক গবেষণার নামে তিমি হত্যায় লিপ্ত জাপান

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

ভিসাভারতীয় ভিসা এবং পোর্ট সমাচার
বৈজ্ঞানিক গবেষণার নামে বিপুল সংখ্যক তিমি হত্যায় লিপ্ত জাপান।বৈজ্ঞানিক গবেষণার নামে তিমি হত্যায় লিপ্ত জাপান

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!