চলেছি সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় । গোকিও লেক পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘে ঢেকে যাচ্ছিল গোকিও সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডাও বাড়ছিল। অগত্যা ঠাই লজের ঘরেই। রাতে ডিনারে আড্ডায় দারুণ সময় কাটলো পূর্বা শেরপার জাপানী ক্লাইম্বিংদল ও অস্ট্রেলিয়ান একটি ট্রেকিং দলের সাথে। বিশেষ করে নির্দিষ্ট সময়ে মূখাভিনয়রের মাধ্যমে চিরকুটে আসা বিষয়টা নিজের দলের সহ খেলোয়াড়দের বোঝানোর উত্তেজক খেলাতেই কেটে গেলো সময়। অনেকেই সিদ্ধান্ত নিলো গোকিওরি থেকে এভারেস্টের মাথায় সূর্যোদয় দেখতে রওনা দেবে খুব ভোরেই। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে একটু সকাল সকালই বের হবো।

সকালে গোকিওরির জন্য প্রস্তুত হয়ে রুম ছেড়ে বের হতেই মন্ত্রমুগ্ধ হলাম চো-য়ুর শ্বেতশুভ্র রুপ দেখে। কিন্তু আফসোস হল এই ভেবে যে আগে জানলে গোকিও থেকেই চো-য়ু শৃঙেগর ওপর সূর্যোদয় দেখা যেত। যাইহোক চড়াই শুরু করা হল গোকিওরির লক্ষ্যে। পাশ দিয়েই একটি রাস্তা চলে গিয়েছে রেঞ্জো লা পাস অতিক্রম করে রেঞ্জোপোখারী হয়ে পুনরায় নামচে বাজার। পাখির চোখে এরিয়াল ভিউয়ে অপূর্ব লাগছিলো গোকিওকে, সাথে তাউজান ও পুরো গ্লেসিয়ারটাই। কিন্তু রিতে পৌঁছতে পৌঁছতেই চুড়ান্ত হতাশ করে একটু দেখা দিয়েই মেঘের আড়ালে ঢেকে গেলো এভারেস্ট। সে যাই হোক এই উচ্চতায় পৌঁছানোটাও একটা আলাদা ভালো লাগা কারণ ট্রেকিং এর সাথে অলটিটিউড অঙগাঙিগভাবে জড়িত। দ্রুত নেমে এসে গ্লেসিয়ার বরাবর একটু এগিয়ে গেলাম চো-য়ু বেসের দিকে। তবে গোকিও থেকেই চো-য়ুকে  এতটাই রাজকীয়ভাবে দেখা যায় যে খুব একটা না এগিয়ে ফিরে এলাম গোকিও লেকের দিকেই।

রোদ উঠেছে ঠান্ডাও অনেক কম। জুতো-মোজা খুলে অনেকদিন পর যেন একটু আয়েশ করে বসার সুযোগ পেলাম। পাশেই জাপানী দলের একজন টাইমলেপ্সে চো-য়ুকে ধারণ করছিলেন। বেলা বাড়তেই মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিলো চো-য়ু। ইতোমধ্যে ওই জাপানী দলটি সহ অনেকেই রওনা দিয়েছে থাগনাগের দিকে। আমরাও যাবতীয় বিল পরিশোধ করে দুপুর ১২টায় রওনা দিলাম। কিছুটা চড়াই ভাঙগতেই শুরু হল সামান্য তুষারপাত। এরপর একেবারে অনেকটাই নীচে নেমে পৌঁছালাম নাগজুম্বা গ্লেসিয়ারে, প্রথমে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলেও  জানতাম এটাকেই আমাদের আড়াআড়ি ভাবে অতিক্রম করতে হবে যদিও দূর দূরান্তেও কেউ নজরে পড়লনা এই রুটে।

গ্লেসিয়ারের ওপর পায়ের ছাপ নেই বললেই চলে অগত্যা ভরসা সেই পাথর সাজিয়ে বানানো রাস্তার মার্কের। এদিকে গ্লেসিয়ার হোয়াট আউট হওয়ার দিকে। বুঝলাম দ্রুত পার হতেই হবে। নিজেই অবাক হলাম নিজের হাঁটার স্পিডে। বোল্ডারের ওপর দিয়ে ঝড়ের গতিতে পার হয়ে যাচ্ছি একটার পর একটা  হাম্প আর গ্লেসিয়ার পুল। অচেনা নির্জন যেই রাস্তায় হারিয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে সেখানের ট্রেকে আমার আলাদাই ভালোলাগাটা আবার ফিল করতে পারছিলাম এবারও। মাত্র ১ ঘন্টাতেই প্রায় গ্লেসিয়ার পার হয়ে পৌঁছে গেলাম উল্টোপাশের রিজটাই। দূরে দেখা যাচ্ছিলো পূর্বা শেরপার দলটাকে। আরেকটা দল তখন থাগনাগ থেকে গোকিওর দিকেও আসছিলো। আমরাও দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম রিজটার মাথায়। এরপর হালকা উৎরাই একটা ভ্যালী বরাবর। কিন্তু মাত্রারিক্তভাবে তুষারপাত শুরু হল। অনেকেই পাথরের খাঁজে আশ্রয় নিলেও আমার ভালোই লাগছিলো ট্রেক করতে। বেলা ২টার কিছু সময় পরেই পৌঁছে গেলাম থাগনাগ।

পাখির চোখে গোকিও।

থাগনাগের লজের মালিকের নামও পূর্বা শেরপা। তিনি নিজেও ক্লাইম্বিং গাইড। গরম জল কেনার হাত থেকে বাঁচার জন্য এখানে বুদ্ধি খাটাতে গিয়ে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হল। পূর্বা দাজুর কাছে সঙগী দাদার সামান্য অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে গরম জল চাইতেই তিনি বোতলে জল ভরে দিলেন ঠিকই কিন্তু একটু পরেই রুমে এসেই তিনি বলতে শুরু করলেন যে পাহাড়ে সামান্য মাথা ব্যথাও অবহেলা করা ঠিক নয়। মাত্র ১০০০ ডলারে হেলিকপ্টার অগ্রীম বলে রাখবেন কিনা, দেরী করলে আবহাওয়ার কারণে আগে না জানিয়ে রাখলে পরে বিপদে হেলিকপ্টার নামতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

সকালের প্রথম রোদের পরশে।

কিন্তু আমরা তো জানি আদতেও এরকম কোন ব্যাপারই নয় এছাড়াও আমাদের আর্থিক ক্ষমতাও নেই পঞ্চাশ হাজার খরচ করে হেলিকাপ্টার ডাকার। অনেক কথা খরচ করে ওনাকে বোঝাতে পারলাম যে সামান্য মাথা ব্যথাই ওটা আর একান্তই সমস্যা হলে একটা অতিরিক্ত দিন এখানে থেকে তবেই চোলাপাস পার হবো। তিনি অক্সিজেন লেভেল ও হার্টবিট কাউন্টিং একটা মেশিন আঙগুলে লাগিয়ে দেখলেন এক্ষেত্রে আমার ও দাদার দুটোই নর্মাল। রাতে আবার দেখা হল জাপানী দলটির সাথে। সাথে বিরাট কোহলীর। কোস্টারিকা থেকে একজন ট্রেক করতে এসেছেন যিনি হুবহু বিরাটের মতই দেখতে। রাতে ঘুমনোর আগে আজ ইশ্বরের কাছে আজ প্রার্থনা করলাম আগামীকালের ১০০% সুস্থতার আশায়। কারণ আগামীকাল আমাদের পরীক্ষা নেবে এই রুটের সবচেয়ে কঠিন অংশ চোলা পাস।

হিমালয়ের উচ্চতায় বৌদ্ধের শান্তির বাণী।

গোকিওরির পথে।

গোকিও রি।।

চলবে…

সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (১ম পর্ব)
সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (২য় পর্ব)
সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৩য় পর্ব)
সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৫ম পর্ব)
সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (৬ষ্ট পর্ব)

লিখেছেন তাপস কুমার রায়। স্বাস্থ্যদপ্তরে এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন। নেশা- ক্রিকেট, ট্রেকিং, ইতিহাস ও একটু আলাদা টাইপ অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ আর সাপ।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (পর্ব ৩)
লক্ষ তারার মেলা

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (পর্ব ৩)
লক্ষ তারার মেলা

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

সাগরমাথার নিজস্ব আঙিনায় (পর্ব ৩)
লক্ষ তারার মেলা

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!